×

জাতীয়

দোটানায় শিক্ষা প্রশাসন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২১, ০৮:৩২ এএম

স্কুল-কলেজ খোলার বিষয় পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত শিক্ষামন্ত্রীর।

স্কুল-কলেজ খোলার দিনক্ষণ নিয়ে দোটানায় পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে এখনই স্পষ্টভাবে কিছু বলতেও পারছে না শিক্ষা প্রশাসন। তবে ছুটি আরো বাড়তে পারে বলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। নির্ধারিত সময়েই স্কুল যাতে চালু করা যায় তার প্রস্তুতি দেখতে কক্সবাজার সফরে রয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।

শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক সূত্র বলেছে, ৩০ মার্চ আসতে এখনো ১৫ দিন বাকি। এই সময়টুকু তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চায়। তারপরও যদি দেখা যায়, সংক্রমণ বেড়েই চলেছে তখন আরো ১৪ দিনের ছুটি বাড়িয়ে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত নেয়া হবে। ১৪ এপ্রিল থেকে রমজান শুরু হওয়ায় শিক্ষাপঞ্জিকা অনুযায়ী এমনিতেই এক মাসের বন্ধ থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরফলে ঈদের পরই অর্থাৎ মধ্য মে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে পারে প্রশাসন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি বাড়ায় ৩০ মার্চই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা এবং আবাসিক হল খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করে ১৭ মে থেকে হল এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা প্রশাসন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার।

সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকটি সূত্র ভোরের কাগজকে জানিয়েছে, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ছাড়া ওই সভায় উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলেছিলেন, দ্রুত স্কুল-কলেজ খুলে দিতে। এমনকী তারা ৭ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার জন্য একটি দিনও ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু একমাত্র শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এরপরই ওই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এই অপরাধকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এজন্য দ্রুত স্কুল খুলে দিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী স্কুল-কলেজ না খোলার যুক্তি দিলেও সভায় তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এরপর স্কুল-কলেজ খোলার জন্য ২৯ মার্চ ঠিক করা হয়। কিন্তু এদিন শবেবরাত থাকায় একদিন পিছিয়ে ৩০ মার্চ করা হয়। এখন করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ নাও খুলতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ওইদিন আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় শিক্ষামন্ত্রীর কথাকে আমলে নিলে আজকে এমন সংকটে পড়তে হত না। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে ৩০ মার্চই স্কুল-কলেজ খুলবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গত শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। তারমতে, ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সে বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের নিরাপত্তা আগে। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।

তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন পুনর্বিবেচনার কথা বলেননি। গতকাল রবিবার তিনি কক্সবাজারের সাহিত্যিকা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুনরায় চালু করার প্রস্তুতি পরিদর্শন করে বলেছেন, সারাদেশে মহামারি করোনা পরবর্তীতে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনরায় খোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই এই সময়ের আগেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকা দেয়া শেষ করতে হবে। পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ৩ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময় পর পর নিয়ম মেনে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ও পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা এবং হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার পালন করতে হবে।

এদিকে, এখন কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে বড় বিপদের শঙ্কা দেখছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এ বি এম খুরশীদ আলম। সবাইকে সতর্ক করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ, আক্রান্তদের অনেককেই আইসিইউতে ভর্তি করতে হচ্ছে। গেল দুই মাস আমরা স্বস্তিতে ছিলাম, তাই এখন আমরা কোনো কিছু মানছি না। সামনের দিকে আমরা আরো বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এমন কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা পুরো বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি।

এরআগে, গত বছর ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ১৬ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। প্রথম দফায় গত বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ করা হয় স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়। নির্ধারিত ছুটি শেষ হওয়ার আগেই বাড়ানো হয় ছুটি। করোনা সংক্রমণ বন্ধ না হওয়ায় এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বেড়েছে ধাপে ধাপে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩০ মার্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২৪ মে বিশ^বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার কথা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে খোলা হবে আবাসিক হলগুলো। আর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের টিকা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ। হবিগঞ্জের বাহুবলের মিরপুর এফএন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সরকারের নির্দেশনা পেয়ে স্কুল খোলার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি আমরা।

এদিকে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন সরকারের কাছে কোনো বেতন বা আর্থিক সুবিধা না পাওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন স্কুল-কলেজের ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা। সরকারের কাছে এমপিও সুবিধা না পাওয়া এ শিক্ষকরা আগে প্রাইভেট টিউশনি করে সংসার চালিয়ে নিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষক বিপদে পড়ে চলমান সময়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ বিক্রি করছেন রাস্তার ধারে ফলমূল বা কেউ কেউ করছেন দিনমজুরের কাজ। কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষার স্তরে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের অনেক শিক্ষক এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বর্তমানে অত্যন্ত সংকটে জীবন পার করছেন। বন্ধ থাকায় দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো করোনা ভাইরাসের এই সময়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হওয়ায় করোনাকালে ভাড়া দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরাও সংকটে রয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষক কোনো বেতন পাচ্ছেন না। অল্প কিছু শিক্ষক নামকাওয়াস্তে কিছু টাকা পান সরকারের কাছ থেকে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন প্রাইভেট টিউটররাও। চরম অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। এসব বক্তব্যের বিপরীতে শিক্ষা প্রশাসন বলছে, আগে জীবন পরে জীবিকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App