×

মুক্তচিন্তা

আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২১, ১২:০৫ এএম

একজন আদর্শবান সফল পিতার সন্তান হওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এবং সেই আদর্শকে ধারণ করা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরো কঠিন। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে, কী ছিল আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদের (১৯১৯-১৯৯০) সাফল্যের মূল ভিত্তি। এক কথায় এর উত্তর হলো তার শৃঙ্খলিত জীবন। বাবা যখনই বাসায় আমাকে একা পেতেন কাছে ডেকে নিতেন। জীবন ও ভাগ্য সম্পর্কে অনেক কথা বলতেন। সবসময় নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা বলতেন। একজন খানদানি পরিবারের সন্তান হিসেবে জীবন-জীবিকার জন্য বাবার এতটা সংগ্রামের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু He wanted to live a life এমন জীবন-যাপন করতে চেয়েছিলেন, যা হবে অর্থপূর্ণ। যে কারণে সংগ্রামকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। দুঃসংবাদ তাকে গ্রাস করেনি। তার জীবন ভাবনার অন্যতম ছিল সরলতা। অর্থবিত্তের মালিক হয়েও বিলাসিতা বর্জন করেছেন সারাজীবন। মনে হতো অর্থ উপার্জন করছেন মানুষকে এবং সমাজকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। গাড়িতে চড়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু নতুন মডেলের অনুসন্ধানে ছিলেন না। পুরনো মডেলের গড়িটিকে ঠিকঠাক করে চলতেন। নতুন ঢাকার জীবনের চেয়ে পুরান ঢাকার জীবনযাপনই তার পছন্দসই ছিল। জিন্দাবাহার, ইসলামপুর রোড, বাবুবাজার, আরমানিটোলা, বাংলাবাজারে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। সেই তখনকার দিনে জিন্দাবাহারের ‘আহমদ পাবলিশিং হাউস’ ছিল এক মননের প্রতীক। সেখানকার অধিবাসীদের জন্য সেটি ছিল এক গর্বের বস্তু। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর অনেক লেখকের আনাগোনা ছিল সেখানে। এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা আর আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ছিল জিন্দাবাহারের আহমদ পাবলিশিং হাউস। অনেকের কাছে এখনো বাবার আতিথেয়তার দিকটি শুনি। কোনোদিন কিছু না খেয়ে কেউ কোনোদিন আসেননি। নিজের পানের বাটা থেকে একটি পান বের করে দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ঢাকা শহরে হত্যাযজ্ঞের পর সকাল বেলা বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে শাঁখারীবাজার গিয়েছিলাম। সেখানে একটি ঘরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা এক গাদা শিশুর মৃতদেহ দেখে কেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল বাবার মুখখানা। সে মুহূর্তে কি মন্তব্য করেছিলেন মনে পড়ছে না। তবে এক ধরনের ভয়ভীতি তাকে ভর করেছিল। তাই তো হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে পাটুয়াটুলীতে মিলিটারি ভ্যানে অবস্থানরত এক পাকিস্তানি সেনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার বন্দুকটি কোথায় কখন জমা দেবে? তিনি বিচলিত ছিলেন এই ভেবে যে, তার নাম বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ফান্ডে চাঁদা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছে। শোনা যাচ্ছিল যে চাঁদা প্রদানকারী প্রত্যেকের বাসায় পাকিস্তানি বাহিনী হানা দেবে। বিকাল বেলা কারফিউ আরোপ করার পরপরই ইংলিশ রোডে পাকিস্তানি বাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল আমাদের জিন্দাবাহারের বাড়ির পাশেই আগুন লেগেছে। আশপাশের সব প্রতিবেশী অন্যত্র চলে যাচ্ছিল। বাবাকে অনেকে অনুরোধও করেছিলেন অন্যত্র সরে যেতে। তবে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মনে নেই। সেদিন রাতে লক্ষ্য করলাম, বাবা বারান্দায় একা নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছেন। জিন্দাবাহারের পুরো বাড়ির আলো  নেভানো ছিল। আমি ভেতরে ঘরে বসে আমার এক দুলাভাইয়ের সঙ্গে অন্ধকারে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনছিলাম। ভাষণের পর বারান্দায় এসে দেখি বাবা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। বললেন আস্তে কথা বলতে। পরে শুনেছি বুটপরা কয়েকজন সেনা নিচতলার প্রধান ফটকে এসেছিল। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটি জানাননি। পাকিস্তানি বাহিনীর এই অত্যাচার ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত বাবাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাই তো জুনের মাঝামাঝির দিকে যখন আমাদের গ্রামের বাড়ির প্রতিটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় তখন পাকিস্তানি বাহিনীর হুংকার ছিলÑ ‘মহিউদ্দীন সাব কাহা হ্যায়?’ মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি জয়ে তিনি উদ্বেলিত হতেন। ১৬ ডিসেম্বর সকাল বেলা যখন গাড়ি নিয়ে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট গেলাম তখন বাবার হাসিমাখা মুখটি ছিল যুদ্ধজয়ের এক অনুকরণীয় প্রতীক। এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, এক মিত্রবাহিনীর সৈন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার নির্দেশে গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিয়ে একটি শান্তিশৃঙ্খলা কমিটি গঠিত হয় সংখ্যালঘুদের জানমাল হেফাজতের জন্য। একবার দেখা গেল এক মেম্বারের নেতৃত্বে কিছু দুষ্কৃতকারী হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেটাকে বাবা সহজভাবে নেননি। মনে পড়ে তিনি এক মেম্বারকে বিচারকার্যের মাধ্যমে জুতাপেটা করেছিলেন। এই নিঃস্বার্থ বিচারের ফলে স্বাধীনতা অব্দি এলাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতন একেবারেই ছিল না। পরবর্তীতে দেখেছি বাবা রাতে বালিশের পাশে বন্দুক নিয়ে ঘুমাতেন। এভাবে বাবা হয়ে উঠেছিলেন উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এক উদার মনোভাবাপন্ন খাঁটি মুসলমান। তাই তো মৃত্যুর পর  সংখ্যালঘুদের আহাজারি ছিল এই বলে যে, ‘আমাদের আর কেউ নেই।’ একদিন বাংলা একাডেমির সচিব মেজর (অব.) মাইনুল হাসানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সদস্য পদ নবায়নের জন্য চাঁদা দিতে গিয়েছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক কবি মনজুরে মাওলার কথা উঠে এলো। বাংলা একাডেমির বর্তমান ঝকঝকে পরিবেশে উনার অবদান অনস্বীকার্য। নতুন নতুন বই প্রকাশ/বার্ষিক সভার ব্যাপারে সাহিত্যিক মনজুুরে মাওলার বেশ কিছু শর্ত ছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলাতেও এক ধরনের শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই যে এখন পাইরেটেড বইমেলায় বিক্রয় করা যাবে না বলে যে নিয়মটি চালু আছে সেটি তার আমলেই প্রবর্তন করা হয়। এককথায় উনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। আমার সঙ্গে মেলার কারণেই পরিচয় হয়। একদিন হঠাৎ করে বাংলা একাডেমির পরিচালক হাবিবুল আলম সাহেবের মাধ্যমে বাবার পুরো জীবনবৃত্তান্ত চেয়ে বসলেন। কেন তখন বুঝিনি পরে জানতে পারলাম প্রকাশনায় বাবার ঈর্ষণীয় সাফল্যে তাকে বাংলা একাডেমি থেকে সম্মান প্রদান করা হবে। এটি ছিল বাবার জন্য এক বিরল সম্মান। প্রকাশক হিসেবে তিনি বোধহয় প্রথম, যিনি এ ধরনের মর্যাদায় ভ‚ষিত হয়েছিলেন। মাইনুল হাসান সাহেবের অফিস কক্ষে আলাপচারিতার মাঝখানে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ এলেন। তার সঙ্গে সে রকম ঘনিষ্ঠতা আমার ছিল না। তবে সাহিত্যিক-সমালোচক হিসেবে তিনি আমার কাছে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আমি তার একজন শ্রোতা। কুশল বিনিময়ের পর উনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। বাবার কথা বললাম, বেশ অট্টহাসি দিয়ে তিনি বেশ মজা করে জিন্দাবাহারের আহমদ পাবলিশিং হাউসের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। একবার কবি আল মুজাহিদীর সঙ্গে দেখা হয়। বাবার সঙ্গে গিয়েছি বই প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে কবি আল মুজাহিদী বললেন, ‘আমরা একদিন আপনার বাসায় যাব।’ বেশ মজা করেই বাবার কাছ থেকে দাওয়াতটা নিয়েছিলেন। যথারীতি দাওয়াতে কবি মুজাহিদী ও মান্নান সৈয়দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেদিন নাকি বেশ সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা ছিল। যা হোক, কবি মান্নান সৈয়দ বললেন, টেবিলে ঠিকমতো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে মাঝে মধ্যে নাকি বাবা উঠে পাশের ঘরে যেতেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘হয়তো বা আমরা যাতে আরো সুখে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারি তারই একটি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।’ খাবারের পর dessert হিসেবে দেয়া পেঁপের হালুয়ার তিনি বেশ প্রশংসা করলেন। খাবারের পর্ব শেষ হওয়ার পর দুজনই তাদের দুটি বই প্রকাশের অনুরোধ করলেন। বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে।’ কথাগুলো বলার সময় কবি মান্নান সৈয়দের মুখে ছিল এক প্রাণবন্ত হাসি। এ ঘটনাটি উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লেখক-প্রকাশকের একটি নির্ভেজাল বন্ধনের দিকেই ইঙ্গিত দিলেন। এখন কি তেমনটি আছে? উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ প্রকাশক হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভ‚ষিত হন। অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ ট্রেজারার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App