×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত দৃঢ় হোক, রূঢ় হোক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২১, ১২:৪৯ এএম

বিগত কয়েক মাস ধরে কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছিল। সম্প্রতি আরেকটি হত্যাকাÐ সংঘটিত হওয়ায় সে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। এর আগে সেখানকার রাজনৈতিক সংকটে সাংবাদিকের মৃত্যু আমাদের থমকে দিয়েছিল। কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগে স্পষ্ট দুটি বিভাজন তৈরি হয়েছে। দুপক্ষই নিজেদের প্রকৃত আওয়ামী লীগ দাবি করে শক্তি প্রদর্শনেও তৎপর আছে কয়েক মাস ধরেই। ইতোমধ্যে সেখানে দলীয় শৃঙ্খলা তথা চেইন অব কমান্ড যাকে বলে তা বিনষ্ট হয়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অস্থিরতায় সাংবাদিকসহ একাধিক মৃত্যুই বলে দেয় সেখানকার পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে চ‚ড়ান্ত রকমের অসহিষ্ণু। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের এই অবয়ব দেখে অনেকের মনে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকটের চিত্র ভেসে উঠতে পারে। কিন্তু আমরা আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, বাস্তবে সারাদেশের আওয়ামী লীগ কোম্পানীগঞ্জের মতো নয়। শৃঙ্খলা ভঙ্গের দিক থেকে কোম্পানীগঞ্জের আওয়ামী লীগই প্রকট। এতদিন দলের ভেতর কোন্দল ও অন্তর্দ্ব›দ্ব প্রকাশ পেলে কেন্দ্র থেকে ‘হাইব্রিড’ শব্দের উচ্চারণ শুনতাম। কোম্পানীগঞ্জে হাইব্রিড নয়, ‘পিওর’ আওয়ামী নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অন্তর্দ্ব›দ্ব এতটা প্রকট হয়ে দেখা দেবে তা কেউ চিন্তা করেনি। গত কয়েক মাস ধরে প্রকৃতপক্ষে সেখানে কী ঘটেছে, এখনো কেন ঘটেই চলেছে তার অনুসন্ধান জরুরি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে যদি কঠোর সিদ্ধান্ত না গ্রহণ করা হয় তবে আশঙ্কার শেষ থাকবে না। হোক সে সিদ্ধান্ত দৃঢ় অথবা রূঢ় তা মেনে নিতে হবে দলের সবাইকে। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো আরো কিছু এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে ভেতরে ভেতরে দলের মধ্যে কিংবা নেতৃত্বের মধ্যে সংকটের চিত্র পাওয়া যাবে। আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে, দলটির ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ পরিসরও ব্যাপক। তাই ছোটখাটো সমস্যা সব সময় দলে সৃষ্টি হবেই। কিন্তু সে সমস্যাকে বড় হতে না দেয়াই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কর্তব্য। কিন্তু কোম্পানীগঞ্জের ক্ষেত্রে আমরা ব্যতিক্রমই বেশি দেখলাম! এমন হতে পারে, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নিজস্ব এলাকা এবং বিবদমান দুটি পক্ষের একটি সাধারণ সম্পাদকের ভাই হওয়ায় সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ‘দেখে শুনে বুঝে’ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করে ফেলেছেন। এটি সাধারণের কল্পনা। বাস্তব চিত্র ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু যাই হোক, কোম্পানীগঞ্জের ঘটনায় দলটির সামগ্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে, হচ্ছেও দিন দিন। কোম্পানীগঞ্জের বিষয়ে দ্রæত কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, প্রয়োজন দ্রæত দলীয় শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। না হলে এর প্রভাব দেশের অন্যত্রও স্পষ্ট হতে পারে। যা দলটির জন্য কোনোক্রমেই কল্যাণকর পরিণতি বয়ে আনবে না। কী এমন ক্ষমতা বা নেতৃত্বের দ্ব›দ্ব, সেখানে ভেতরে ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে ফুসছিল যে তা একাধিক হত্যাকাÐ পর্যন্ত গড়াল! কোম্পানীগঞ্জ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ দ্রæত সতর্ক অবস্থান নেবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের উত্তেজনা দেখার প্রায় একই সমান্তরালে আমরা বিএনপির মধ্যেও উত্তেজনার তৎপরতা দেখতে পেলাম। সারাদেশ যে কোম্পানীগঞ্জ নয়, বিএনপিকে তা ভাবতে হবে। হঠাৎ করে আগাম নির্বাচন চেয়ে মাঠ গরমের বক্তৃতায় কর্মীদের কিছুটা চাঙ্গা করে তোলা যায় বটে, কিন্তু সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় কতটা সহজ তা দেশের সাধারণ মানুষই বলে দেবেন। কারণ বিএনপি গণতন্ত্র রক্ষার যে দাবি নিয়ে মাঠে নামার পাঁয়তারা করছে তার সঙ্গে জনসমর্থন কতটুকু আছে তার যাচাই-বাছাই দলটির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীরা করেছেন বলে আমরা জানি না। উপরন্তু বিগত ১২ বছরে বিএনপি জনগণের স্বার্থে কোনো আন্দোলন সংগ্রাম তৈরি করতে পেরেছে বলেও জনগণ অবগত নয়। সবারই উপলব্ধি স্পষ্ট যে, বিএনপির অনেক নেতা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছেন, এটা আরো দীর্ঘায়িত হলে রাজনীতিক হিসেবে তাদের অস্তিত্ব সংকটের অতলে নিমজ্জিত হবে। সেই আশঙ্কায় তারা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়েও তারা যথাযথভাবে নির্বাচনী প্রচারণা ও জনসম্পৃক্ততা এড়িয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্বাচন কমিশনকে অযোগ্য বলে মানুষের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় লিপ্ত বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও স্বেচ্ছা-পরাজয় বরণ করা যে প্রকৃতপক্ষে বিএনপির একটি কৌশল তাও অনেকে চ্যালেঞ্জ নিয়েই প্রমাণ করতে তৎপর। বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাÐে বিএনপির অংশগ্রহণ বিগত ১২ বছরে সাধারণের কাছেও স্পষ্ট হয়েছে। নিজেরা আন্দোলন সংঘটিত করতে না পারলেও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবী আন্দোলনে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে সেখান থেকে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা তারা একাধিকবারই করেছে। করোনাকালে বিএনপির প্রপাগান্ডাও ছিল অনেকটা বাস্তবতা বর্জিত, ষড়যন্ত্রমূলকও। বিগত এক যুগে বিএনপি কোনো রকমের গণদাবি নিয়ে রাজপথে আসেনি তাও সবাই জানেন। তাদের ইচ্ছা সাধারণের স্বার্থের পরিবর্তে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতার মসনদে যাওয়া! কিন্তু মানুষ বুঝতে পারে কোনটা সুস্থ চিন্তাপ্রসূত রাজনীতি আর কোনটা দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র! জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিএনপি এমন কোনো ইস্যু তৈরির মাধ্যমে রাজপথ অধিকার করতে পারেনি, যাতে তাদের জোরালো নৈতিক ভিত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তাদের অধিকাংশ চাওয়া একান্তই ব্যক্তিগত এবং দলীয় কর্মী-সমর্থকদের স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জনসম্পৃক্ত ইস্যুবিহীন বলেই তাদের আন্দোলনের অধিকাংশই জনসমর্থনহীনও। সাধারণ মানুষ তাদের স্ব-স্ব সচেতনতা বোধ দিয়েও দলটির নেতাদের আশা-আকাক্সক্ষার কথা সহজেই টের পেয়ে যান। ফলে মাঠের আন্দোলন মাঠেই মারা যায়! আন্দোলনের ফসল তারা ঘরে তুলতে পারে না। ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত না করতে পারলে কোনো আন্দোলনই ফলপ্রসূ হয় না। রাতারাতি ক্ষমতার মসনদও লাভ হয় না। সাধারণ মানুষ টের পেয়ে গেছে, বিএনপির একমাত্র লক্ষ ক্ষমতার মসনদ। দেশের উন্নয়ন, মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। কিন্তু এভাবে যে জনপ্রিয় হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না তা বিএনপি ইতোমধ্যে টের পেয়েছে। আর আওয়ামী লীগও টের পেয়েছে সাধারণ মানুষ খুশি থাকলেই নিশ্চিন্তে ক্ষমতায় থাকা যায়। উন্নয়নের চাকা চলমান থাকলেই ক্ষমতায় থাকা যায়। সাধারণ মানুষের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলেই নির্ঝঞ্ঝাটভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়! বাংলাদেশের মানুষ বিগত এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সাফল্য দেখেছে। সাফল্য দেখেছে নিজেদের অর্থনৈতিক উৎকর্ষেরও। মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ দেশের মানুষের সামষ্টিক সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণে। স্বল্পোন্নত দেশের ‘লেবেল’ ঝেরে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষমতা অর্জন সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের মানুষেরই পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু এজন্য যে স্থিতিশীল সরকার কাঠামো প্রয়োজন তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছে। বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংস্থার করোনাকালীন বাংলাদেশ সম্পর্কিত নেতিবাচক বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক পুনরায় স্বীকার করেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাপক ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম। অথচ এই বিশ্বব্যাংকই মিথ্যা ‘দুর্নীতি’র দায়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটিও ছিল বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগ এবং বিশেষত বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য কঠোর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অগ্নিপরীক্ষা। সে পরীক্ষায়ও শেখ হাসিনা পাস করেছেন। আর শেখ হাসিনা পাস করেছেন মানে এ দেশের মানুষ আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়াকে একটি মহল ভালো চোখে দেখতে চান না। একদা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা কিছু নেতা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হওয়া সত্তে¡ও নানা অজুহাতে সরকার পতন, নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রভৃতি নানা উছিলাকে সামনে এনে নীতিবাক্য আওড়িয়ে চলেছেন। ভাবখানা এমন যে, তারা ক্ষমতায় থাকাকালে দেশবাসী স্বর্গরাজ্যে বসবাস করতেন, আহা! আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আমাদের দাবি, রাষ্ট্রীয় অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেবেন। দলের ভেতরে থেকেও যারা নিজের স্বার্থসিদ্ধিকে বড় করে দেখেন, দলের স্বার্থে তেমন নেতাকর্মীকে দ্রæততম সময়ে নিষ্ক্রিয় করে দেবেন। আর যারা দলের মধ্যে দল (সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ‘ঘরের মধ্যে ঘর’!) সৃষ্টি করেন তাদের চিহ্নিত করুন। এসব আওয়ামী লীগই পারে। নিকট অতীতে অনেক বড় বড় নেতাকর্মীর ব্যাপারে রূঢ় হলেও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণে আওয়ামী লীগের সময় লাগেনি। আশা করব, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিশেষ ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নিয়ে কোম্পানীগঞ্জসহ সারাদেশের দলের ভেতরকার কোন্দল ও অন্তর্দ্ব›দ্বগুলো মিটিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলবেন। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App