×

সাময়িকী

এমনও হয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২১, ১২:৩৯ এএম

এমনও হয়
মো. তানিম-উল-ইসলাম দোকানের সামনে টুলের ওপর বসে নাকের লোম ছিঁড়ছিল আসলাম মিয়া। সেলুনে গিয়ে গণেশ নাপিতকে দিয়ে লোমগুলো টেনে টেনে ছেঁড়াতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু সেই উপায় নাই। পঁচিশে মার্চের ‘ডলাতে’ সব বেইমান মরে সাফা : কথাটা ভাবতেই আসলাম মিয়ার মনের ভেতরে অন্যরকম একটা সুখ হতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই সে অস্ফুটস্বরে উহু করে উঠেÑ আনমনে সে তার গোফ ধরে টান মেরেছে! দুই. ইসলামাবাদ পাকিস্তান ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ইয়াহিয়া খানের হাতে হুইস্কির বোতল। সাধারণত সে বোতল থেকে ঢকঢক করে এ বস্তু খায় না; গøাসে একটুখানি ঢেলে বেশ আয়েশ করে রসিয়ে রসিয়ে পান করতে ভালোবাসে। কিন্তু আজ ঘটনা পুরো ভিন্ন। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে নাÑ দুর্বলের চেয়েও নিকৃষ্ট এ বাঙালিগুলা কেমন করে তার বিশ্ব সেরা সেনাবাহিনীর সাথে চোখে চোখ রেখে যুদ্ধ করছে। ভাবতে ভাবতে আবারো সে বোতলটা মুখের কাছে আনে, ঠিক তখন পেশোয়ার থেকে আনা নর্তকী দিলবাহার বলে ওঠে : মাতাল কী সব এখনি হবেন। রাত তো সবে শুরু! ইয়াহিয়া খান ক্রুদ্ধ চোখে দিলবাহারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটা খুবই জঘন্য গালি দেয়। তিন. সুমী অনেকক্ষণ ধরেই ছাদে বসে আছে কিন্তু রায়হানের আসার কোনো নামগন্ধ নাই। ফুলতলা গ্রামে যে কয়টা পাকা বাড়ি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা সুমীর বাবা তোফাজ্জল হোসেন বানিয়েছেন। মেয়ের খুব দোলনায় দোল খাওয়ার শখ তিনি তাও বাড়ির ছাদে করে দিয়েছেন। সেই সাধের দোলনায় দোল খেতে খেতে সুমী অপেক্ষা করছে তার চাচাতো ভাই রায়হানের। সুমীকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। লালচে চেকের একটা লুঙ্গি আর উদোম গায়ে রায়হান ছাদে আসে। সুমীর খুব মেজাজ খারাপ হয়। রায়হান ভাইটা কেমন যেন, এখনো তাকে সেই ছোট্ট খুকিটি মনে করে! একটা মেয়ের সামনে যে এভাবে খালি গায়ে আসা যায় না এটা রায়হান ভাই কবে বুঝবে সুমীর ঠিক মাথায় আসে না। রায়হান গম্ভীর মুখে ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে। সুমী তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। রায়হান ভাই কেমন আছো? প্রশ্নটা করেই সুমী বুঝে ফেলে খুবই বোকার মতোন একটা প্রশ্ন হয়ে গেছে। যার সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হয় তাকে এভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করাটা বেমানান। রায়হান কিছু না বলে ভ্রæ কুঁচকে উঠোনে ওড়ানো পতাকাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তোফাজ্জল হোসেন বাড়ির উঠোনে অত্যন্ত যতœ সহকারে পাকিস্তানের এ তারকা খচিত পতাকাটা উড়িয়েছেন! চার. সকালের এ সময়টা আসলামের ভালোই লাগে। তার উপরে এবার শীত একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। কেমন হিমহিম ভাব চারদিকে। তবে তার এখন মনজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে : পাশের তিনতলা দালানটা সে কীভাবে কব্জা করবে। শাঁখারি পট্টির এ জায়গায় অনেকগুলো হিন্দু বাড়ি এখন ভ‚তুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগই ইন্ডিয়া চলে গেছে। তা যায় যাক তাতে আসলামের কোনো মাথা ব্যথা নাই। কিন্তু তার শুধু একটাই চিন্তা, আর তা হলোÑ আসগরেরও নজর পড়েছে এ খালি বাড়িটির ওপর। আরে ভাই তুই বাড়ি নিবি নে, কতো বাড়িই তো এখন খালি পড়ে আছে, নে না তুই ওখান থেকে, ক্যান তুই আমার বাড়া ভাতে ছাই না এক্কেবারে পায়খানা করে দিচ্ছিস? ভাবতে ভাবতেই তার মুখ থুথুতে ভর্তি হয়ে যায়। সে থু করে এক দলা থুথু ফেলে। মেজর গুলজারের সাথে আসগরের বেশ ভালোই ওঠা-বসা। আর তাই তো আসগর এখন ধরারে সরা জ্ঞান করে। কিন্তু সে জানে না আসলাম মিয়া কী চিজ। সে কথাটা ভেবে মিটিমিটি হাসে। ‘কী মিয়া হাসো ক্যান?’ পাশের গলির কামাইল্লা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে। ‘হাসি ক্যান তোমার না জানলেও চলবো। তোমারে যেই কাম দিছি তুমি করছো?’ ‘শান্তি কমিটির লিস্টে তোমার নাম তুলনের ব্যবস্থা নিছি। তুমি চিন্তা কইরো না।’ ‘তোমার ওপর কাম দিছি বইলাই আমারে একটু বেশিই চিন্তার মইদ্যে থাকতে হয়।’ বলে আসলাম আবারো নাকের ছিদ্রে আঙুল ঢুকায়, তবে এবার বেশ সাবধানে। ‘শোনো মিয়া...’ বলেই আসলাম মিয়ার কানের কাছে মুখ রাখে কামাল। মনে হচ্ছে কোনো গোপন কথা বলবে। ‘আরে এত্ত কাছে আসো ক্যান? তোমারে না কইছি আমার লগে কথা কওনের আগে তুমি ভালো কইরা দাঁত মাইজা আইবা।’ আসলামের ধমক খেয়ে কামালের মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ নিয়ে আর যাই হোক সহজ স্বাভাবিক কথা বলা যায় না। তবে শহরে গেরিলা ঢুকে পাকিস্তানি সেনাদের কচুকাটা করছেÑ এটা বোধহয় খুব একটা সহজ স্বাভাবিক কথাও না! পাঁচ. কী ভাবলো আর কী হচ্ছে! ইয়াহিয়া খান কিছুতেই তার হিসাব-নিকাশ মেলাতে পারছে না। তবে আশার কথা হলো আমেরিকা আর চীন তার হাতের মুঠোয় আছে। তবে সে আমেরিকারে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে। রাশিয়া যদি ইন্ডিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তাহলে সে অবশ্যই আমেরিকার থেকে বড় ধরনের সহযোগিতা পাবেÑ এইটুকুন বিশ্বাস তার আছে। দিলবাহার ইয়াহিয়ার শরীরের সাথে লেগে আছে। কখনো কখনো অতি প্রিয় নারী শরীরও ইয়াহিয়ার কাছে অসহ্য লাগে। কিন্তু সে মুখ হাসি হাসি করে দিলবাহারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। তবে সে হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে নীরব হাহাকার। মুক্তিরা একটার পর একটা ঘাঁটির দখল নিচ্ছে। নাহ্ ইয়াহিয়ার আর সহ্য হয় না। সে হেঁচকা টানে দিলবাহারকে সরিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় দিলবাহার খুব ঘাবড়ে যায়। ইয়াহিয়ার শক্ত হাতের ধাক্কায় দিলবাহারের ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। রক্ত দেখে ইয়াহিয়া মনে মনে শপথ নেয়Ñ শেখ মুজিবকে সে ফাঁসিতে চড়াবেই চড়াবে! ছয়. আজ সকাল থেকেই তোফাজ্জল হোসেন মহাব্যস্ত। তার বাড়িতে এতো বড় একজন আর্মি অফিসার আসবেন তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তাকে খুব ঠাÐা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করতে হবে মেজর সাহেব কী পছন্দ করেন আর কী পছন্দ করেন না। কিন্তু সে খুবই বিচলিত হয়ে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা বাঁশের আগায় বাধা পাকিস্তানের পতাকাটা কে যেন নামিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছে। তার বাড়ির ভেতরে ঢুকে এমন কাজ করার দুঃসাহস কার হতে পারে? তাহলে সে যা শুনেছে তা কি সত্যি! ফুলতলা গ্রামে মুক্তি হানা দিয়েছে! ‘রায়হান একটু শুনে যা তো।’ তোফাজ্জল হোসেনের হাঁক শুনে রায়হান ভেতর ঘর থাকে কাচারি ঘরে এসে দাঁড়ায়। ‘ঢাকা থেকে আইসা ভালোই করছো। বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন মুক্তি বানানোর কারখানা। শালারা পাকিস্তানি মুসলমান ভাইদের বুঝতে পারলো না। আরে ব্যাটা এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। তোরা কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া পাকিস্তানি আর্মিগো সাহায্য করবি, তা না কইরা তোরা আন্দোলন মারাছ।’ বলেই সে অত্যন্ত কুৎসিত কিছু গালি দেয়। মুসলমান হয়ে মানুষ মারতে হবে তা আপনি চাচা কোথায় পেলেন? রায়হান কথাটা বলে এক দৃষ্টিতে চাচা তোফাজ্জল হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তোফাজ্জল হোসেন অবাক হয়, এতোটাই, সে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে গোপন কোনো বিষয় খুঁজে পাবার মতো ঠোঁট সরু করে বলে : ‘পতাকা তুই ছিঁড়ছোস?’ রায়হান নিশ্চুপ। ‘হারামজাদা... আমার ঘরে খাইয়া খাইয়া ফুলতাছোছ আর ওইদিকে পাকিস্তানের দুর্নাম করতাছোছ। ঠিকতো বিলাইয়ের মতো পালাইয়া এই চাচার বাসায় আইসা ঢুকছোছ। মুরোদ থাকলে তো মাঠে নামতি, আন্দোলন করতি, যুদ্ধ করতি। দ্যাখ রায়হান আমার সাফ কথা... যদি আমার এইখানে থাকতে চাস আমার কথা মতোন চলতে হইবো।’ বলেই সে থেমে একটু দম নেয়। তারপর নিজেকে সামলিয়ে বলে : ‘আর এখন বাজারে গিয়া বড় দেইখা একটা পাকিস্তানের পতাকা কিন্যা নিয়া আয়।’ সাত. ফুলতলা গ্রামটা সুন্দর। গ্রামের মাঝ বরাবর কলাতলি নদী কলকল শব্দে বয়ে চলে নিশিদিন। রায়হান মন খারাপ করে হাঁটছে। চারদিকে এতো সবুজ কিন্তু তার সেদিকে চোখ যায় না। রায়হান রক্ত ভয় পায়, আন্দোলন ভয় পায়, যুদ্ধ ভয় পায়। হলের সবাই যখন পণ করলো সবাই মিলে মুক্তি ক্যাম্পে যাবে, ট্রেনিং নিবে আর সে তখন পালিয়ে চলে আসে এ ফুলতলা গ্রামে। মাঝেমধ্যে নিজেরেই প্রচÐ রকম ঘৃণা করে রায়হান। মনে হয় নিজেকে একেবারে শেষ করে দেয়। কিন্তু নিজেকে মেরে ফেলতে যতোটুকুন সাহস একটা মানুষের ভেতরে থাকা উচিত তা রায়হানের ভেতরে নাই! সে ভেজা চোখ নিয়ে বাজারে ঢোকে। বেশ কয়েকদিন ধরেই পাকিস্তানের পতাকা খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। সে সুযোগে দোকানিরাও পতাকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোফাজ্জল হোসেনের বেলায় ভিন্ন কথা। রায়হানের থেকে কোনো টাকাই নিলো না দোকানি মন্টু। জলে বসে কুমিরের সাথে বিবাদ কেই বা করতে চায়। আট. তোফাজ্জল হোসেনের বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে গেছে। মেজর সাহেব আজ রাত্রেই তার বাড়িতে আসছেন এবং এটা তোফাজ্জল খুবই বিশ্বস্ত সূত্রে এই মাত্রই জানতে পেরেছে। তবে যে তাকে এ সংবাদ দিলো সেই লুলা আকবর (গ্রামে সে লুলা নামে পরিচিত, কিন্তু তার দুই পা-ই ভালো) গলা নামিয়ে তোফাজ্জল হোসেনকে বলে : ‘স্যারের জন্য ডাগোর ডোগোর দুইটা মাইয়া রেডি রাইখেন।’ বলেই সে ফিকফিক করে হাসতে থাকে। তোফাজ্জল হোসেন রায়হানের ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে। তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলে : ‘রায়হান তোর কপাল ভালো। তোরে আমার এই ইউনিয়নের শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট বানায়া দিতে পারছি। তোর লগে এখন সারাক্ষণ চারজন বন্দুকওয়ালা বডিগার্ড থাকবো।’ রায়হান ঠিক কী বলবে তার বুঝে আসে না। তার হাতে তখন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। এতোবার পড়া গল্প কিন্তু যখনি আবারো পড়া শুরু করে তখনি মনে হয় নতুন করে পড়ছে। ‘তোর কাম হইলো গ্রামে টহল দেয়া। আর কেউ যদি মুক্তিতে জয়েন করে তাইলে ওই হারামিগুলার নাম আমারে জানাবি। বুঝলি?’ রায়হান ফ্যালফ্যাল চোখে চাচার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই যুদ্ধ না হলে রায়হান বুঝতে পারতো না সে কতোখানি অপদার্থ। নিজেকে চেনার জন্যেও একটা যুদ্ধ দরকার! রায়হানের হঠাৎই নুশরাতের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটারে সে ভালোবাসতো অনেক কিন্তু কখনোই মুখ ফুটে তাকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলা হয়ে ওঠেনি। কী আশ্চর্য সেই নুশরাত তার বরকে নিয়ে যেদিন ক্যাম্পাসে এসে রায়হানকে চুপিচুপি বলে : “হয়তো তোমার ভালোবাসা পাইনি বলে সংসারে এতোকিছু পাবার পরেও আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। রায়হান... কখনো কখনো কাঁদতে হয়। কখনো কখনো মুখ ফুটে ‘ভালোবাসি’ এ কথাটা বলতে হয়।” নুশরাতের চোখের দিকে রায়হান সেদিন তাকাতে পারেনি। তার খুব শব্দ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিল, সে তাও পারেনি। কী আশ্চর্য! নুশরাতের প্রতি তার আকাশপাতাল ভালোবাসা হঠাৎই রূপ নেয় প্রচÐ আক্রোশে। এই মেয়ে যখন তাকে এতোটাই বুঝতো তাহলে কেন নুশরাত বিশ্ববিদ্যালয় দিনগুলোতে হাত বাড়ায়নি! সেদিনের কাঁদতে না পারা রায়হান আজো কাঁদতে পারেনি। কিন্তু আজই তো তার সবচেয়ে বড় কাঁদার দিন। তোফাজ্জল হোসেন তাকে জব্বর মুন্সীর দুই মেয়েকে তুলে আনতে বলেছে! নয়. রাত আটটা। মেজর মুশতাক পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। তার সামনের চেয়ারটায় কাচুমাচু করে বসে আছে তোফাজ্জল হোসেন। মেজর সাহেব জানতে চায় এলাকার মুক্তি লিস্ট করা হয়েছে কিনা। তোফাজ্জল হোসেন আদবের সাথে জানায় মুক্তি লিস্ট করা শেষ। এবং আজকে তার খেদমতে এক মুক্তি ‘হারামজাদার’ দুই বোনকে দেয়া হচ্ছে। বলেই খিচখিচ করে হেসে ওঠে তোফাজ্জল হোসেন। একটু থেমে এবার সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো বাঁশের সাথেই দুই বোনকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। মেয়ে দুইটাকে দেখে সে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। দশ. ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে দুই বোনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের চিৎকারে ফুলতলা গ্রাম কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু তাদের মুক্ত করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। মিলিটারি জওয়ানরা সব আস্তে আস্তে খোলা জিপে গিয়ে বসে। মেয়ে দুটোর কান্না এখন আর শোনা যাচ্ছে না। হয়তো ক্লান্ত। হয়তো ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে! মেজর মুশতাক শখ করে মুখের ভেতরে একটা খিলি পান গুঁজে আয়েশ করে চিবুচ্ছে। তার বেশ ভালোই লাগছে। এ বস্তু সে লাহোরে কখনো খায়নি। আচ্ছা কিছু পান লাহোরে নিয়ে যেতে হবে। তার মেয়েটা নতুন জিনিস পেলে আনন্দে আটখানা হয়ে ওঠে। মেয়েটার কথা মনে পড়তেই তার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। খুব শখ করে মুন্নুজানের বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু স্বামী গত বছর রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা পড়ে। আহা! মেয়েটার জন্য মেজর সাহেবের চোখ দুটো আর্দ্র হয়। কিন্তু পরোক্ষণেই আজ রাতে ডাবল মেয়ে নিয়ে ডাবল মৌজ মাস্তির কথা মনে পড়তেই সে ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আচ্ছা মুন্নুজান কি ট্রাকে হাত-পা বেঁধে তোলা ওই দুইটা মেয়ের বয়সি না? কথাটা মনে পড়তেই মেজর মুশতাক জিবে কামড় দেয়। ছি ছি সে কী ভাবছে! মেজর মুশতাককে জিপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে তোফাজ্জল হোসেন গুটি গুটি পায়ে চলে এসেছে। হঠাৎই তার কী হলো কে জানে টুপ করে মেজরের পায়ে সালাম ঠুকে বসে। মুশতাকের ব্যাপারটা বড্ড ভালো লাগে। এগার. হঠাৎই উঠোনে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। সুমী তিনতলা ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। বাড়ির পেছনের অংশে তার নিথর দেহ পড়ে আছে। রায়হানকে প্রচÐ ভালোবেসে ফেলেছিল সুমী। কিন্তু যখন সে বুঝে যায় একটা মেরুদÐহীন প্রাণীকে করুণা করা সাজে ভালোবাসা যায় না তখন নিজেকে এ দুনিয়ায় আর রাখতে মন চাচ্ছিল না সুমীর। তবে লাফ দেবার আগ মুহূর্তে পৃথিবীটাকে আরো একটু সুন্দর করতে সে আরেকটা কাজ করে যায়! রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে রায়হানকে সে উপর্যুপরি কুপিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কুপিয়েছে। ভালোবাসা মানুষকে কখনো নির্দয় করে তোলে; কিন্তু তখনই মানুষ নির্মম হয় যখন আঘাত আসে ভালোবাসায়! শেষ কথা: মুক্তি বাহিনীর একটা চৌকস টিম সে রাতে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প অ্যাটাক করে। সরাসরি যুদ্ধে তারা পাকিস্তানি জান্তাদের নিমিষেই হারিয়ে দেয়। একেকটারে ধরে পশুর মতো গুলি করে মারে। অবশেষে উদ্ধার হয় মেয়ে দুটো, উদ্ধার হয় আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশ!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App