×

মুক্তচিন্তা

সম্পত্তিতে সমান অধিকার কবে পাবে নারী?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১, ১২:০৫ এএম

নারীর ভ‚-সম্পত্তি পিতা-স্বামীর দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপরই নির্ভরশীল। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে কন্যাসন্তানের পিতা-মাতার সম্পত্তির অংশীদারিত্বের বিধান রয়েছে। তবে সেটা পুত্রসন্তানের প্রাপ্ত অংশের অর্ধেক। স্বামী এবং মৃত পুত্রের সম্পত্তির ষোলো আনার মাত্র দুই আনা অংশের আইনি দাবিদার। তবে পিতা বা স্বামী যদি জীবদ্দশায় নিজেদের সম্পত্তি পুত্রদের অনুক‚লে দিয়ে যায়; সে ক্ষেত্রে কন্যা এবং স্ত্রী কানাকড়িও পায় না। নারীর উত্তরাধিকারী সম্পত্তি পাওয়া-না পাওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে পিতা বা স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। পুত্রসন্তান না থাকলে পিতার অবর্তমানে কন্যাসন্তানরা পিতার সম্পত্তির শতভাগ অংশের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। পিতার ভাই-ভাইপোরা সম্পত্তির অধিক অংশের অংশীদার হয়ে যায়। অদ্ভুত বিধানে পিতার সম্পত্তি থেকে কন্যাসন্তানরা বঞ্চিত হয়ে যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সম্পত্তির অধিকার বঞ্চিত করার নানা আইন-বিধান; নারীর প্রতি চরম বৈষম্যপূর্ণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা সব ক্ষেত্রেই ভ‚-সম্পত্তি অধিকার বঞ্চিত। তারা পিতা, স্বামী বা সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। হিন্দু আইনে নারীকে সম্পূর্ণরূপে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নারী বিদ্বেষী অমানবিক আইনটি এখন পর্যন্ত কেন রদ হয়নি? সে জিজ্ঞাসা নিশ্চয় রয়েছে। আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল নেতৃবৃন্দ পুরুষ এবং সে কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্দয়-অমানবিকতার দৃষ্টান্তস্বরূপ কালো সেই আইনটি টিকে রয়েছে। যারা এই আইন পরিবর্তনে অগ্রণী ভ‚মিকা পালনে সচেষ্ট তারাই আইনটির পক্ষে তাদের জোরালো অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ঘৃণিত নারীবিরোধী আইনটি সে কারণেই বহাল-তবিয়তে রয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট নারীর ৭০ শতাংশের কোনো সম্পত্তি নেই। অর্থাৎ সহায়-সম্বলহীন সিংহভাগ নারী। যারা অন্যের দয়া-অনুগ্রহে সমাজে পরগাছার মতো টিকে রয়েছে। ২৯ শতাংশ নারী উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ করেছে। এবং অবশিষ্ট ১ শতাংশের সম্পত্তি থাকলেও নানা কারণে তাদের সম্পত্তি এখন তাদের অধিকারে নেই। পিতার সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার অজস্র ঘটনা-দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রয়েছে। আইনিক দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের আশ্রয় মামলা-মোকদ্দমায় অধিক অর্থ বিনিয়োগের কারণে বঞ্চিতরা আইনের আশ্রয়ের ধারে-কাছে ভিড়তে পারে না। আমাদের আইন-আদালতগুলোতে সুবিচার পাওয়া নির্ভর করে অর্থ জোগানের ওপর। অর্থের জোরেই সুবিচার নির্ভর। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রচলিত ধারণা, যা মোটেও বাস্তববিবর্জিত নয়। আইনি আশ্রয় এবং আদালতে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে প্রচলিত প্রবাদটি হচ্ছেÑ একটি মুরগির জন্য একটি গরু হারানোর শামিল। আইন ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে যারা মামলা-মোকদ্দমা করেছে তারা প্রায় প্রত্যেকে অর্থনাশে ফতুর হয়েছে। উকিলদের কথায়-আশ্বাসে মনে হবে দ্রæত সম্পত্তির অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে। সহজেই পুনরুদ্ধার হবে বেদখলকৃত সম্পত্তি। অথচ বাস্তবে যুগের পরিসমাপ্তিতেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। অর্থের কারসাজিতে রহস্যজনক ঝুলে থাকে মামলাগুলো রাজা ত্রিশঙ্কুর ন্যায়। মামলার তারিখে আদালতে যাওয়া-আসা এবং উকিলদের ফি দিয়ে দিয়ে ফতুর হওয়ার দশা। জমিজমা সংক্রান্ত মামলা সহজে নিষ্পত্তি না হওয়ার সংস্কৃতিতে বঞ্চিতরা সে পথে অগ্রসরে আগ্রহী হয় না এবং আস্থাও রাখে না। আইন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে যারা নাকাল হয়েছে একমাত্র সেই সব ভুক্তভোগীই জানে আমাদের দেশে আইন-আদালত কি পরিমাণে বিড়ম্বনাপূর্ণ এবং মামলা পরিচালনা সম্পূর্ণরূপে অর্থ বিনিয়োগের ওপরই নির্ভরশীল। উপনিবেশিক আইন স্বাধীন দেশে অপরিবর্তিত থাকায় মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আইনের দরজায় মাথা ঠুকেও সাধারণ মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশকে সম্ভব এবং অসম্ভবের দেশ বলা হয়। এখানে সবই সম্ভব, সবই অসম্ভব। অর্থবিত্তের এবং রাজনৈতিক প্রভাবে অসম্ভব বলে কিছু নেই। বরং সবই সহজে সম্ভব। তবে সাধারণের জন্য সবই চরমভাবে অসম্ভব। আমাদের সমাজে পুত্রদেরকেই বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী রূপে গণ্য করা হয়। বিয়ের পর কন্যাসন্তানরা পিতার সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাইদের কর্তৃত্বে থাকা সেই সংসারে কন্যারা অতিথিরূপেই আসা-যাওয়া করে। বৃদ্ধ পিতা পুত্রদের আশ্রয়ে থাকার কারণে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে নিজের সম্পত্তি পুত্রদের লিখে দেয়। কন্যাদের বঞ্চিত করে পুত্রদের সম্পত্তি দেয়ার ঘটনা দেশে সর্বাধিক। পিতার সম্পত্তি এজমালি থাকলেও সেই সম্পত্তির অধিকার কন্যা সন্তানদের পাওয়া দুরূহ। ভাইয়েরা দয়া-পরবশে দিলে পাবে। না দিলে মামলা করে সম্পত্তি আদায় বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় সুদূরপরাহত। যেসব নারীর স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাইদের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধশালীÑ একমাত্র তারাই সহজে পৈতৃক সম্পত্তির অংশ অনায়াসে পেয়ে থাকে। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতেই পিতৃ সম্পত্তি পাওয়া-না পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। সেটা খুবই নগণ্য। নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির মূলে অর্থনৈতিক বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। শ্রেণি সমতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সংস্কারের মাধ্যমে তো নয়ই। বিদ্যমান ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রেখে যে সংস্কারই করা হোক না কেন, সেটা টিকবে না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন। আমাদের সমাজ-জীবনে নারীর প্রতি যেসব বৈষম্য আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি; তার মূলে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তবে নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রারম্ভিক সূত্রপাত নারীর জন্ম মুহূর্ত থেকে ঘটে থাকে। কন্যাসন্তান জন্মের পর তার কানে কাউকে না শুনিয়ে চুপি চুপি (নিশ্চয় লজ্জা-অপমানে) আজান দেয়া হয়। অথচ পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। উঁচু স্থান থেকে তীব্র চিৎকারে আজান দিয়ে পুত্র লাভের খুশির সংবাদটি সর্বত্র জানান দেয়া হয়। সন্তান জন্মের পর সামর্থ্যবানরা আকিকা দিয়ে থাকে। পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে দুটি এবং কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে একটি খাসি জবাই করে আকিকার বিধানকে বৈষম্যহীন-সমতার দৃষ্টান্ত ভাবার মোটেও উপায় নেই। বরং সম্পূর্ণরূপে বৈষম্যপূর্ণ। বংশের উত্তরাধিকারী পুত্রদেরই গণ্য করা হয়। কন্যাদের নয়। মায়েরা নারী হয়েও প্রচলিত ব্যবস্থার শিকার। সে কারণে কন্যাসন্তানদের পুত্রসন্তানের সমকক্ষ বিবেচনা এবং সমমর্যাদা প্রদান করতে পারে না। নগণ্য সংখ্যক পিতা-মাতারা পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে সন্তানদের সমতার ভিত্তিতে দেখে থাকেন। সমাজের সংখ্যালঘু সুবিধাভোগীদের বিষয় অবশ্য ভিন্ন। এই সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে বেড়ায়। এসব শ্রেণির নারীরা সব প্রকার বৈষম্যের ঊর্ধ্বে। তাদের জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এরা নারী স্বাধীনতার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করে অথচ প্রত্যেকের গৃহের গৃহকর্মীদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন-নিপীড়নে দ্বিধা-সংকোচ করে না। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার বিকাশ। আদিম যুগ, দাস যুগ, সামন্ত যুগ, পুঁজিবাদী যুগ, সমাজতান্ত্রিক যুগ একে একে এসেছে। আদিম সাম্যবাদী যুগে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার ছিল, যা দাস যুগে পরিসমাপ্তি ঘটে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী কেবল সন্তান ধারণ ও জন্ম দিত না। খাদ্য সংগ্রহ-শিকারসহ সব কর্মকাÐেও যুক্ত ছিল। পরিবার-সমাজ নিয়ন্ত্রণেও নারীর প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপ্রবেশেÑ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পত্তির লোভে-মোহে দাস এবং সামন্ত যুগে নারীও পুরুষের সম্পদে পরিণত হয়েছিল, অপরাপর বঞ্চিত-দুর্বল মানুষদের ন্যায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা মাত্রই পণ্যনির্ভর। নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। নারীকে বিজ্ঞাপনের মডেল করা হয়, ফ্যাশন শোতে অংশ নিতে হয়। শিল্পীসত্তা বিসর্জন দিয়ে সৃজনশীলতা ত্যাগ করে তারকা হতে হয়। নির্মাতা এবং অর্থের লগ্নিকারকদের ইচ্ছানুযায়ী নামমাত্র বস্ত্র শরীরে রাখতে হয়। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনে নগ্ন হতে হয়। নারীর সুন্দর দেহ মাত্রই পণ্য। মুনাফাবাজার তা সেল্যুলয়েডে বন্দি করে বাজারজাত করে মুনাফা লাভ করে থাকে। পুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর ছবি আমাদের সমাজে জাজ্বল্যমান। পুঁজিবাদ মুনাফানির্ভর কোনো কিছুকে ছাড় দেয় না। পণ্যে পরিণত করে। সংস্কৃতিসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব-বিনোদনে অনুদান-পৃষ্ঠপোষকতার বাতাবরণে পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হয়। সংস্কৃতিকে পর্যন্ত পুঁজিবাদ করতলগত করেছেÑ পণ্য প্রচারের হাতিয়াররূপে। দাস বা সামন্ত যুগ নারীকে বন্দি করেছিল। পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষে বন্দি করেনি। কিন্তু পণ্যের দাসীতে পরিণত করেছে। পুঁজিবাদ নারীকে পণ্যেরও পণ্যে পরিণত করে থাকে। পণ্যের প্রচার-প্রসারেও নারীকে অপরিহার্য পণ্যরূপে গণ্য করে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতেই পুঁজিবাদের সামগ্রিক অপতৎপরতা স্পষ্ট। আইন-ধর্মীয় বিধান পরিবর্তনে নারী অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। প্রচলিত আইনে বহু ইতিবাচক বিধান রয়েছে। আইনের সব বিধান কি সমাজে পরিপূর্ণরূপে পালিত হয়? হয় না এবং হওয়ার উপায়ও নেই। আইন করে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত হবে না। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যা সংস্কারে মোটেও সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজ পরিবর্তনেই সম্ভবপর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের সমঅধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার মূলে সমাজ বিপ্লব। একমাত্র সমাজ বিপ্লবেই সব শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়নের অবসান হবে। মুক্তি নিশ্চিত করবে সব মানুষের। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App