×

জাতীয়

করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যত ভুল ধারণা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১, ০২:০৭ পিএম

সারাবিশ্ব করোনা আক্রমণে যখন দিশেহারা তখন করোনা ভ্যাকসিন নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয়। স্বল্পতম সময়ে করোনার ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ফসল। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি হতে সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে কোভিশিল্ড টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের ভ্যাকসিনেশন ট্র্যাকার-এর তথ্যানুযায়ী টিকা প্রদানের (মোট ডোজ সংখ্যায়) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম।

ইতোমধ্যে সারাদেশে ৩১ লাখেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকা নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণের প্রবণতা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখনো করোনার ভ্যাকসিন এর কার্যকরিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ও ভ্যাকসিন বন্টন নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝেও রয়েছে নানা ধরনের আশঙ্কা ও বিভ্রান্তি। দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নানাবিধ গুজব ও ভুল তথ্য জনসাধারণের মাঝে টিকা গ্রহণে নিরুৎসাহ তৈরি করছে, এর ফলে একদিকে যেমন মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে তেমনি হার্ড ইমিউনিটি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন:

কার্যকারিতা ও গুণগতমান বিচারে, কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন, ফাইজার ও মডার্নার প্রায় সম পর্যায়ের হলেও মূল্যমান এবং মাইনাস ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ জনিত সুরক্ষা বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রক্ষাপটে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন অধিক উপযোগী। কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ এর কার্যকারিতা ৭৬ শতাংশ যা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত বজায় থাকে, আবার দ্বিতীয় ডোজটি ৮ থেকে ১২ সপ্তাহে প্রয়োগ করলে অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিনটি শতকরা ৮৩ ভাগ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা দিবে।

ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারনা:

১.স্বল্প সময়ে তৈরি, তাই কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন কার্যকর নয়:

যে কোন ভ্যাকসিন এর কার্যকরিতা সম্বন্ধে জানতে হলে প্রথমেই যে কথাটি মনে রাখতে হবে প্রতিটি ভ্যাকসিনকেই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের গবেষণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং প্রতিটি ধাপের সফল প্রয়োগের পরই অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারজাত করণের অনুমতি পায়। কাজেই করোনা ভ্যাকসিন যত স্বল্প সময়েই তৈরি হোক না কেন ভ্যাকসিনটি কার্যকর ও নিরাপদ বলেই বিশ্বসহ বাংলাদেশেও কোভিশিল্ড বন্টন করা হচ্ছে।

২. কোভিশিল্ড অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নয়:

কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটি মূলত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তিক বাজারজাতকৃত অক্সফোর্ড -এস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিনের টেকনোলজি অনুসরণে প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিন। সেরাম ইনস্টিটিউট একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্বনামধন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যা বর্তমান বিশ্বে মোট ভ্যাকসিন চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ টিকা গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে সরবরাহ করে চলেছে।

৩.টিকা গ্রহণের ফলে মানব দেহে জেনেটিক গঠনগত পরিবর্তন হয়:

সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন টিকা গ্রহণের স্থান ফুলে যাওয়া, ব্যথা হওয়া ইত্যাদি যে কোন ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রেই হতে পারে, এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যথা হতে পারে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ লক্ষ ব্যক্তি ফাইজার বা অক্সফোর্ড -এস্ট্রোজেনেকার একটি অথবা দুটি ডোজ পেয়েছেন। কিন্তু টিকা সংক্রান্ত কোন ভয়াবহ জটিলতা কিংবা মৃত্যু বা জেনিটিক গঠনগত পরিবর্তন এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি কোভিশিল্ড গ্রহণের ক্ষেত্রে মারাত্মক কোনো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হবারও কোনো প্রমাণ নেই। টিকা গ্রহণের ফলে মানব দেহে জেনেটিক গঠনগত পরিবর্তন হয় এটিও একটি ভিত্তিহীন গুজব।

৪.ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে:

ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণেই কেউ কোভিডে আক্রান্ত হবে না কারণ, এ পর্যন্ত যে টিকা গুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাদের কোনটিতেই জীবন্ত ভাইরাস নেই যা থেকে কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অক্সফোর্ড- এস্ট্রোজেনকার উপর চালানো গবেষণাতে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি শুধু লোকজনকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে সুরক্ষা করছে না, বরং এটি সংক্রমণও কমিয়ে দিচ্ছে। কারণ, একজন মানুষকে যখন টিকা দেওয়া হচ্ছে তখন সে পরোক্ষভাবে আরেকজন মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করছে। তবে এটা সত্য যে ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরে সুরক্ষা তৈরি হতে যেহেতু কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়, তাই টিকা দেওয়ার পরপরই কেউ কোভিড-১৯ ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত হতে পারে। তাই নিয়মিত মাস্ক পরিধান করতে হবে, হাত ধুতে হবে, সামাজিক দূরত্ব ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা বজায় রাখতে হবে।

ভ্যাকসিন বন্টন পরিকল্পনা:

বিশ্লেষকদের মতে সারাদেশব্যাপী করোনা টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। প্রথমত, করোনা টিকাদান কর্মসূচি যাতে অন্যান্য নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, করোনা টিকাদান কর্মসূচি সঠিক ট্র্যাকিং ও মনিটরিং এর জন্য সারাদেশব্যাপী একটি সমন্বিত ডাটাবেজ সুনিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া এবং সময়মতো দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার জন্য জনসচেতনতা ও ভ্যাকসিন বিষয়ে ভিতি দূরীকরণে সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রচারমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবক, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

বিশ্বের কোথাও টিকা নেওয়ার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। করোনা সংক্রমণ ছড়ানোকে বাধাগ্রস্ত করতে হলে শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা নিতে হবে, তবেই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। দ্রুত স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের কোভিশিল্ড টিকাদান কর্মসূচি সবাই মিলে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।

ডা. তাসরিন সুলতানা, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন, এন্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন (ক্রীড়া)।

ডা. সাবরিনা ফরিদা চৌধুরী প্রভাষক (জনস্বাস্থ্য), লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

ডা. তাহমিদ কাশেম, জনস্বাস্থ বিশেষজ্ঞ এবং পলিসি বিশ্লেষক, কানাডা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App