×

মুক্তচিন্তা

ঐতিহাসিক সাতই মার্চকে বিপন্ন করা যাবে না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২১, ১২:৩২ এএম

আবারো মার্চ এলো আমাদের জীবনেÑ অগ্নিঝরা মার্চ। কিন্তু এবারের মার্চ অন্যান্য বছরের মার্চ থেকে আলাদা। এবারের মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মার্চ, এবারের মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেরও সুবর্ণজয়ন্তীর মার্চ! ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির অনন্য সম্পদ, বিশ্ববাসীর সম্পদেও পরিণত হয়েছে। ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা মনে করি, মার্চের ভেতরকার স্পৃহা, প্রেরণা, সৌর্য-সাহস ও নিরন্ন মানুষের মুক্তি-আকাক্সক্ষার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে। ছড়িয়ে পড়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমিয় সংগীত-ধারার মতোইÑ যে গানের উৎকলিত চরণে তিনি লিখেছেন, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।’ ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগুন সমগ্র বাঙালিকে এমনভাবে উদ্দীপিত করেছিল যে, সে আগুনের পদপ্রান্তে আত্মনিবেদনে দেশপ্রেমিক বাঙালির কোনো দ্বিধা ছিল না, দ্বিধা ছিল না আত্মোৎসর্গেও। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শুধু বাঙালিরই মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নিÑ বিশ্বের সব প্রান্তের নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত ও অসহায় নিরন্ন মানুষের অর্থনৈতিক ও মানবিক মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। তাই স্বাধীনতার জন্য এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, কেরানি, কুলি, কামার, তাঁতি, কুমার, জেলে সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ-আহŸানে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি জল্লাদদের বিরুদ্ধে, জাতির মুক্তিযুদ্ধে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ৭ মার্চের উত্তাল রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের বুকে কাঁপন জাগিয়েছিল। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ বঙ্গবন্ধুর এ আহŸানে সাড়া দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশবাসী, বিশ্ববাসী উন্মুখ হয়ে দেখেছে বাঙালির বিজয়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও রাজনৈতিক সাধনার বাংলাদেশÑ রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন-কল্পনার সোনার বাংলা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বিএনপি ৭ মার্চকে ‘বিশেষ তাৎপর্যের দিন’ হিসেবে পালন করবে বলে শোনা যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে বিএনপির অনেক কর্মকাÐ দেখার ও বুঝার ইচ্ছা আমাদের মনের ভেতর জমা থাকলÑ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে নানারূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দেখা যাক বিএনপি এবং একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় ভবিতব্য প্রকৃতপক্ষে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মাসের রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২১ সালের মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মার্চ। সুতরাং এবারকার এই মার্চের তাৎপর্য বাঙালির জীবনে অনন্য গুরুত্ববহ। কিন্তু মার্চের তাৎপর্য নিয়ে যখন আমাদের আলোচনা ও মূল্যায়নমূলক বিশ্লেষণ করার কথা তখন বেদনার সঙ্গে অনন্য এই মার্চকে চেতনার আড়ালে নিক্ষেপের অপপ্রয়াস আমরা দেখছি। আমরা দেখছি কারাবন্দি লেখক (!) মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছে! বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে কথিত প্রগতিশীলদের এ আন্দোলনের মধ্যেও বিএনপি অনুপ্রবেশের চেষ্টায় তৎপর! ফেব্রæয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল খোলার আন্দোলন শুরু হতে যাচ্ছিল তখন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি নিয়ে একটি মহলও তৎপর হয়ে উঠেছিল। এদের পরিচয় পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে সক্রিয় ভ‚মিকা গ্রহণ করতে যাচ্ছিল গোষ্ঠীটি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হলগুলো খোলা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর দ্রæত ঘোষণায় তাদের সে সক্রিয়তা মাঠে মারা যায়! ডিজিটাল আইনে কারাবন্দি মুশতাক আহমেদের মৃত্যু ঘটলে কথিত মহলটির কাছে তার লাশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের মওকা হয়ে ওঠে! লাশ নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরতদের পেছনে ‘হাওয়া’ দেয়ায় তারাও আন্দোলনটির সক্রিয় অংশীদার হয়ে পড়েন। মুশতাকের লাশ নিয়ে শুরু হলেও সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবিতে বিএনপি এখন মাঠ গরমের চেষ্টা করছে। বিএনপি ও নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করাদের নানামুখী আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের সম্মুখ থেকে মার্চের তাৎপর্যই বিলীন হতে চলেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর গৌরবের মার্চ মাসকে আড়াল করার লক্ষ্যে এসবই যে একটি বিশেষ মহলের অতি সূ² রাজনৈতিক এজেন্ডা তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তীকেও এ দেশের মানুষের চিত্তপট থেকে মুছে ফেলার দুষ্টচক্রের সক্রিয়তা দিন দিন প্রতীয়মান হচ্ছে। জনসমর্থনহীন এসব ইস্যুর আড়ালে পড়ে গেছে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে অধিষ্ঠানের আনন্দধারাও। জাতি আরো উল্লাসের সঙ্গে এ অর্জনকেও ‘উদযাপন’ করতে পারত। কিন্তু বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সব ধরনের উদযাপনের পরিবেশ নষ্টসহ সাধারণের দৃষ্টিকে গৌরবের মার্চ থেকে ভিন্ন দিকে বইয়ে দিয়েছে! আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, বিচারবহিভর্‚ত মৃত্যু বা হত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, সে যেই হোক। বাকস্বাধীনতার কথা বলে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন ও বঞ্চিত করার প্রকল্প নিয়ে যারা মাঠে নেমেছেন তারা নিজেদের অগ্রগামী ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক মনে করলেও সব কর্মকাÐ ও কর্মসূচিতে তাদের একপেশে বিবেচনাবোধই উপলব্ধি হয়। সুবিবেচনবোধ যেন তাদের কাছে সুদূর পরাহত একটি বিষয়। তবু তারা নিজেদের অগ্রগামী ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক-বাহকই মনে করেন। অথচ দুঃখজনক হলো, অগ্রগামী চিন্তার এই পথিকৃৎরা সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ করেননি, জেলখানার ভেতর জাতীয় চার নেতার জঘন্য হত্যাকাÐের প্রতিবাদ করেননি। তারা প্রতিবাদ করতে ভুলে যান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ করতেও! প্রতিবাদ করতে ভুলে যান সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের নামে অসংখ্য মেধাবী সেনা কর্মকর্তার নির্বিচারে হত্যারও! কারণ এসবের অধিকাংশই ছিল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার সক্রিয় অপচেষ্টা। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় না যে, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারই এদের শিকারের লক্ষ্যবস্তু? আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমরা দেখেছি এই প্রগতিবাদীরা ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধেও ‘হাওয়া ভবন’ প্রীতি বা ভীতির কারণে কোনো রকম প্রতিবাদের পরিবর্তে বরং বিকৃতপন্থায় নীরবে সেসব হত্যা-ধর্ষণ উপভোগই করেছেন অনেকটা যেন ‘সচেতনভাবেই অচেতন’ থেকে! প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে সাম্প্রতিক আন্দোলন দেখে বিএনপির কোনো কোনো নেতা উল্লাস বোধ করছেন। এমনকি রাজশাহীতে জনৈক বিএনপি নেতা আরেকটি ২১ আগস্ট সৃষ্টির ইঙ্গিতও প্রদান করেছেন। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠায় রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভেবে বিএনপি ভরসা পাচ্ছে, সরকার পতনের স্বপ্নও দেখছেন অনেক নেতা! তাই কর্মীদেরও প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন! অথচ বিগত এক যুগ ধরে বিএনপি আন্দোলন তো দূরের কথা, রাজপথে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেনি! নানাভাবে তারা রাজনৈতিক ও নৈতিক স্পর্ধাও হারিয়ে ফেলেছেন! শীর্ষস্থানীয়দের দুর্নীতিসহ বিচিত্র ধরনের মামলায় শাস্তিভোগ এবং পলাতক থাকায় দলটির বর্তমান ‘বেড়াছেড়া’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় তারা কেবল বিভিন্ন পেশাজীবীগোষ্ঠীর আন্দোলনে অনুপ্রবেশপূর্বক সেসব আন্দোলন থেকে ফায়দা হাসিলের গোপন চেষ্টায় তৎপর। কিন্তু এভাবে কতদিন টিকে থাকা যায়? একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব পরনির্ভরশীলতায় ক্রমে বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিএনপি সেই বিপন্নতার দিকেই ধাবমান। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে অপরাজনীতির কোনো সুযোগ নেইÑ এ কথা বিএনপিকে মনে রাখতে হবে। জাতীয় এবং ঐতিহাসিক কোনো অর্জনই আমরা বিপন্ন হতে দিতে পারি না। সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে আওয়ামী লীগকেও। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ধরংষধস.লঁ@মসধরষ.পড়স

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App