×

মুক্তচিন্তা

মার্চেই সমাহিত পেয়ারা পাকিস্তান

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২১, ১২:১৯ এএম

১৯৭১-এর মার্চের প্রথম দিন করাচি থেকে প্রকাশিত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরিজে দৈনিক ডন লিখল : ‘আওয়ামী লীগপ্রধান বলেছেন ছয় দফা কর্মসূচি কেবল বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়। আমরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন চাই, আমরা চাই পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানের মানুষও তা ভোগ করুক।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ছয় দফা এখন আর তার নিজের সম্পদ নয়Ñ এর মালিক জনগণ, যে কোনোভাবেই হোক ছয় দফা সংশোধন করার অধিকার তার নেই। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব’ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে কিনা এ কথার জবাবে শেখ মুজিব বললেন, এই ভুয়া বিষয় যারা উত্থাপন করছেন তারা আসলে ‘সংখ্যালঘিষ্ঠের একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। স্পষ্টতই ভুট্টোর এই মন্তব্যে প্রথমে শেখ মুজিব বললেন, এসব কথা কেবল আপত্তিকর নয়, এগুলো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করছে। তিনি বললেন, ভুট্টো সাহেবের ৮৩ জনের মতো যদি তার দলের ১৬০ জন সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকার করে, এর পরিণতি কী হবে তিনি জানেন না। তিনি বলেন, নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকে নির্বাচনের অর্জন ভণ্ডুল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যদি বাধা সৃষ্টি করা হয় তা হলে এর পরিণতির জন্য তিনি দায়ী থাকবেন না। আওয়ামী লীগপ্রধান আরো বলেন, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অব্যাহত ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত এবং যারা বাধা সৃষ্টি করছে পরিণতির জন্য তারাই দায়ী হবেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা মরব কিন্তু আত্মসমর্পণ করব না।’ ডন তাকে উদ্ধৃত করে আরো লিখল, জয় বাংলা রাজনৈতিক স্লোগান নয়Ñ এটা স্বায়ত্তশাসনের স্লোগান, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্লোগান। এটা বেঁচে থাকার এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার স্লোগান। মুজিবের সংবাদই ডনের সেদিনের শীর্ষ সংবাদ। ঠিক সেদিন দুপুরেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতিকে জানিয়ে দিলেন পাকিস্তান নামের দেশটি তার ইতিহাসের গভীরতম রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছেÑ সুতরাং তা দেশবাসীকে জানানোর দায় অনুভব করছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ আরো কিছু দল ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাছাড়া ভারতের সৃষ্ট উত্তেজনা পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। এ অবস্থায় ৩ মার্চের অধিবেশন ‘স্থগিত করে পরবর্তী কোনো তারিখে’ অধিবেশন আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢাকা এমনিতে তেতে ছিল, এই ঘোষণা শোনার পর গনগনে আগুন জ¦লতে শুরু করল। মার্চের প্রথম দিন কার্যত অফিস করেননি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর ভাইস এডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অর্থমন্ত্রী এস এম আহসানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠানো হয়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল মুজাফফর উদ্দিনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। নৌবাহিনীর এই সাবেক প্রধান গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ প্রধানের আস্থা অর্জন করেন এবং তিনিও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য জনসংখ্যানুপাতিক সম্পদ বরাদ্দের দাবি জানাতে থাকেন এবং এমনকি আলাদাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিদেশি সহায়তা গ্রহণের উদ্যোগও নেন। তার ওপর সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খান ক্ষিপ্ত হন এবং তাদের বিরোধ প্রকাশ্য আলোচনায় চলে আসে। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে উদ্দেশ্যমূলক সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেন এবং রাজনৈতিক সংকটের সামরিক সমাধান যে ব্যর্থ হবে তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। পূর্বাঞ্চলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি একটি ফর্মুলাও পেশ করেন, যা আহসান ফর্মুলা নামে পরিচিত। তার পূর্ব পাকিস্তান প্রীতি এবং এই প্রদেশের জন্য ন্যায্য দাবি আদায়ের উদ্যোগ তাকে পাকিস্তানের শোষণমূলক মেইনস্ট্রিম রাজনৈতিক দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তিনি দায়িত্বে থাকাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দেবেন না বলেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং ৭ মার্চ থেকে পদত্যাগ কার্যকর করার আবেদন জানান। তার পদত্যাগ পত্রের বিষয়টি উপেক্ষা করে ইসলামাবাদ থেকে ১ মার্চ অপরাহ্ণ থেকে তার গভর্নরশিপ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ৭ মার্চ খবরের কাগজে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয় : প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সন্তুষ্ট হয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, সিতারা-ই-পাকিস্তানকে ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তারিখে ঘোষিত সামরিক আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ও সাময়িক সাংবিধানিক আদেশের পাঠ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেছেন। একই সময় অন্য একটি প্রজ্ঞাপনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসানকে প্রদত্ত গভর্নরের দায়িত্ব ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে শেষ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১ মার্চই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দায়িত্বরত আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকদের যুগপৎ গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়। সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের সর্বনাশ করবেÑ এ ধরনের মন্তব্য করে ৪ মার্চ বাঙালিবান্ধব গভর্নর এস এম আহসান তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে কার্যত চিরদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল শাহেবজাদা ইয়াকুব খান সেই আদেশবলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হলেন এবং পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলেন বলে দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রেসিডেন্টকে লিখলেন, প্রেসিডেন্ট এসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেন এক সপ্তাহের মধ্যে অচলাবস্থা দূর করেন নতুবা তিনি পদত্যাগ করবেন। ক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করলেন। ৭ মার্চ অপরাহ্ণে টিক্কা খান যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামলেন তখন রমনা রেসকোর্সে রচিত হচ্ছে বাংলার ভিন্ন ইতিহাস। কয়েকদিনের মধ্যেই বিদেশি পত্রিকাতেও খবর বেরিয়েছে ‘মুজিব হ্যাজ টেকেন ওভার ইস্ট বেঙ্গল’Ñ মুজিব পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন। বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ নেয়ার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করলেও এই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে টিক্কা খান শপথ নিয়ে ৯ এপ্রিল থেকে গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টিক্কা বেলুচিস্তানের কসাই খেতাব নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন, এর সাথে বাংলাদেশের কসাই খেতাব যোগ করে ৩১ আগস্ট ১৯৭১ দায়িত্বভার ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। সেনাপ্রধান হন, মন্ত্রী হন, উপদেষ্টা হন, মৃত্যুতে সংবাদপত্রের শিরোনাম হন। টিক্কা খান চলে যাওয়ার পর ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীই শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যুদ্ধবন্দি থেকে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে চাকরিচ্যুত হন। টিকে যান তাদেরই ধূর্ত দোসর রাও ফরমান আলী খান। ২৫ মার্চের সেনা আক্রমণের পর দুদিনের মধ্যেই বিদেশি পত্রিকার শিরোনাম সংবাদ : ‘পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে’। ২৫ মার্চ ১৯৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি দিবস। ইয়াহিয়া বন্দুকের ডগা দেখিয়ে তার পূর্বসূরি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্টস হাউস থেকে বের করে দেননি কিংবা বিদেশগামী উড়োজাহাজে তুলে দেননি (যা ইস্কান্দার মির্জার বেলায় আইয়ুব খান নিজে করেছেন)। পরিস্থিতিই আইয়ুবের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছিল। এমনকি ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আইয়ুব যখন ইয়াহিয়াকে ডাকেন তিনি বোতল নিয়ে বেসামাল অবস্থায় ছিলেন। তিনি চাননি তার পূর্বসূরির সঙ্গে তার আর দেখা হোক। ইয়াহিয়া তখনই রাজভবনে ঢুকলেন যখন আইয়ুব চিরদিনের জন্য সে ভবন ছেড়ে বেরিয়ে যান। ‘প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া’র জন্য আইয়ুব খান একটি দিকনির্দেশক চিঠি রেখে যান : ‘গভীর বেদনার সাথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, দেশে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ও শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। যদি বর্তমানের আশঙ্কাজনক গতিতে অবস্থার অবনতি ঘটিতে থাকে তাহা হইলে সভ্যভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে। ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া দেশরক্ষা বাহিনীর কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করা ছাড়া আমার কোনো বিকল্প নাই। বর্তমান সময়ে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশরক্ষা বাহিনীই একমাত্র কার্যকর ও আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। খোদা চাহে তো অবস্থার পরিবর্তন সাধনপূর্বক পরিপূর্ণ বিশৃঙ্খল ও ধ্বংসের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহাদের রহিয়াছে। একমাত্র তাহারাই দেশে সুস্থতা ফিরাইয়া আনিতে পারে এবং বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশকে অগ্রগতির পথে ফিরাইয়া নিতে পারে।’ (আবু জাফর প্রণীত রাজভবন থেকে বঙ্গভবন ২০০৬) ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে প্রকারান্তরে পালাবার আগে সামরিক সমাধানের নির্দেশই দিয়ে যান। ‘বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক’ শাসনের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যবস্থাপনা তার উত্তরসূরি আইয়ুব খান তো দিয়েই গেছেন। এস এম আহসান কিংবা সাহেবজাদা ইয়াকুব ধরনের মুষ্টিমেয় ক’জন বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘সিভিল মিলিটারি পলিটিকো অলিগার্কি’ সামরিক সমাধানই সমর্থন করেছে এবং হত্যা ও ধ্বংসতে উল্লাস প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের পরিণতির কথা তো আগেই ঘোষিত হয়ে গেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে টাইম পত্রিকার ড্যান কোগিন লিখেছেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বলেছেন যে পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে ফয়সালার আর কোনো আশা নেই।’ দূরের সংবাদপত্র ক্যানরেরা ‘দ্য এজ’ লিখল, পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যাবে কিন্তু সবার আগে দরকার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা আসগর খানও বললেন, পূর্ব পাকিস্তান যদি আলাদা হয়ে যায় পাকিস্তানের বাকিটা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে এই ঢাকা শহরেই প্রতিবাদী জনতার রক্তস্রোতের নিচে সমাহিত হয়ে যায় জিন্নাহর স্বপ্নের পেয়ারা পাকিস্তান।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App