×

জাতীয়

শক্ত ভিত পায়নি গণতন্ত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২১, ০৯:১১ এএম

শক্ত ভিত পায়নি গণতন্ত্র

‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়।... ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে এভাবেই বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক মুক্তির কথা তুলে ধরেছিলেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাই নয়; ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে কেনা সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম মূলনীতি ‘গণতন্ত্র’ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির সংগ্রাম বহু দিনের। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও পাঁচ দশকে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হয়নি। এজন্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষার জন্য আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে- এমন মন্তব্য গবেষকদের।

বিশ্লেষকদের মতে, বাঙালি বরাবরই গণতন্ত্রপ্রিয়। অর্থনৈতিক ও চিন্তার মুক্তির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে দেশের জনগণ। তবে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা কখনোই আনন্দঘন ছিল না। বারবার তা বাধা পেয়েছে। ১৯৭১ সালে কোটি মানুষের স্বপ্নের বিজয় অর্জিত হয়েছিল জাতির লাখো বীরসন্তানের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের মধ্য দিয়ে। শুরু হয়েছিল গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসমৃদ্ধ স্বাধীন-সার্বভৌম আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বপ্নযাত্রার। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই যাত্রা থামিয়ে দেয় কুচক্রীমহল। মানবতার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে গণতন্ত্রও।

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আমি বলি ‘ডেমোসক্লেরোসিস।’ ক্লেরোসিস রোগে ধমনীতে রক্ত শুকিয়ে যায়। দেখতে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল হয় না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রও তাই। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়Ñ কাজির গরুর মতন, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। এই ইতিহাসবিদ বলেন, গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল সঠিক পথে। বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল; তবে পঁচাত্তরের পর সঠিক পথ হারিয়েছে গণতন্ত্র।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিলেও টেকসই গণতন্ত্রের স্বপ্ন এখনো অধরা। ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু কাঠামোয় প্রাণের স্পন্দন এখনো শুরু হয়নি। গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করতে হলে জনগণের সচেতনতা যেমন অপরিহার্য, তেমনি রাজনৈতিক নেতাদের শক্তিশালী অঙ্গীকারও প্রয়োজন। জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, গণতন্ত্রের চিন্তা, চিন্তাই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে না গিয়ে এখনো পাকিস্তানি ধারায় রয়ে গেছি আমরা। এখনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা করছি, এখনো আমেরিকার দালালি করছি। ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি ও বিরোধী পক্ষে সুসংগঠিত গণভিত্তিক দল না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না। চার দশক ধরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো ক্যারিশমেটিক জননেতা তৈরি হয়নি। অথচ দেশের অগ্রযাত্রায় গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নেও টেকসই গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একে অন্যের পরিপূরক। উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে। উন্নয়নের চাকায় গতি সঞ্চার হবে। জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। তারা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চা কিভাবে করবে?

এক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে অংশীজনদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষা এবং একে এগিয়ে নিতে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বিরোধী দলেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, গণতন্ত্র শুধু সরকারি দলের জন্য নয়। সরকার ও বিরোধী সবাইকে নিয়েই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় বিরোধী দলের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি গঠনতান্ত্রিকভাবেই অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধের কোনো প্রতিফলন তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ক্ষেত্রে নেই। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বিএনপির নিজ দলে গণতন্ত্র ফেরানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান ভোরের কাগজকে বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে গণতন্ত্র নেই। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন থেকে জাতিকে উদ্ধার করা রাজনীতির প্রধান কাজ বলে মনে করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র এখন মজবুত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র কি ৫০ বছর আগে জানত না এবং পাকিস্তান আমলে বুঝতে পারত না। গণতন্ত্রের ধারণা প্রথম বুঝতে পারে ১৯৭০ সালে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে যার সাহস পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। বর্তমানে গণতন্ত্র আছে বলেই উন্নয়ন হচ্ছে। ভোটের জন্য ৫ বছর পর পর জনগণের কাছে যেতে হয়। তিনি বলেন, অনেক দূর এগিয়েছে তবে আরো অনেক দূর এগোতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বিরোধী দল। বিরোধী দল সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে তখন সরকার বাধ্য হয়ে গণতন্ত্রের উন্নয়ন করবে। গণতন্ত্র অর্থবহ করতে হলে তার সুফল পৌঁছে দিতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। নিশ্চিত করতে হবে টেকসই উন্নয়ন। একটি দেশ যখন লক্ষ্যস্থির করে, তখন তার সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও আসে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সক্ষমতা। বৈশি^ক অর্থনীতিতে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। গণতন্ত্র সমুন্নত রেখে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে জাতির স্বপ্ন পূরণে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App