×

পুরনো খবর

অটোপাস যেন অক্টোপাস না হয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২১, ১২:২৫ এএম

একজন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ? জবাব দিল, সে একজন অটোপাস স্টুডেন্ট। অটোপাসে সে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। জবাবে চেহারায় তার কোনো উজ্জ্বলতা, উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়নি। বরং মøান ও ধূসর অবয়ব। হতাশার সুরটা ছিল বেশ। বিবর্ণ হতে দেখেও কৌতূহলবশত পুনরায় জানতে চাইলাম, কেমন লাগছে এই অটোপাস? তার উত্তর, আজ যারা আমাকে অটোতে চড়িয়ে দিল একদিন হয়তো কোনো সুযোগ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় তারাই আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করবেন। অটো থেকে নামিয়ে দেবেন। এমন উত্তর পাওয়ার পর শিক্ষার্থীকে তৃতীয় প্রশ্ন করার ইচ্ছা হলো না। উপরোক্ত ঘটনার বিপরীত চিত্রও আছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ভিন্নরকম ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে জিপিএ ফাইভধারীদের ছবি। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ছবি পোস্ট করে গর্ব অনুভব করেছেন। সবার কাছে সন্তানের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেছেন। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সন্তানের সাফল্যে অভিভাবক খুশিই হবেন। আর সেই খুশির বহিঃপ্রকাশ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটাবেন। একটা সময়ে সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফল করলে অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন আকারে সেই সংবাদ ছাপাতেন এবং তা টাকার বিনিময়ে। দিন বদলেছে। এখন সেই সংবাদ প্রকাশ করার জন্য টাকা লাগে না। বরং পত্রিকার চেয়েও অতি দ্রুত ও তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব এবং তা অনেকের কাছে। আর সেই সম্ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে ফেসবুক, ওয়েব পেজ তথা সোশ্যাল মিডিয়া। প্রিন্টিং মিডিয়ার কদর কমিয়ে দিয়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়া। যা হোক, পরীক্ষার ফলাফলে ফেসবুক জুড়ে অভিভাবকদের আত্মতৃপ্তি, স্বস্তি কিংবা আনন্দ এটা বলে কিনা যে, সন্তানরা পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাস হলেই তাদের এখন চলে? এক বছর প্রায় কোচিংয়ের পেছনে সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে হয়নি। একে তো পাস, তার ওপর বছর নষ্ট না হওয়া। অর্থাৎ তারা হয়তো এমনটাই চেয়েছেন সন্তানরা তরতর করে উপরের ক্লাসে উঠে যাক। আর পরীক্ষা ছাড়াই জিপিএ ফাইভ পাওয়া তো বেশি ভালো। এই শ্রেণির অভিভাবকরা হয়তো কেবল একটা ৫ মার্কা (জিপিএ ফাইভ) রেজাল্ট চেয়েছেন, সন্তান কতটা যোগ্যতায় সেই রেজাল্ট অর্জন করল তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কিছু কিছু অভিভাবকদের অবশ্য মাথাব্যথা আছে এবং রয়ে যাচ্ছে, বিশেষত যাদের সন্তান পূর্ববতী পরীক্ষায় কোনো কারণে ভালো রেজাল্ট করেননি তাদের। পূর্ববতী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না হওয়ায় অটোপাসে কী ফলাফল দাঁড়াবে সেই আশঙ্কা, কষ্ট, হতাশা এই শ্রেণির অভিভাবকদের থাকাটাই স্বাভাবিক। কোভিড-১৯ এর কারণে প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্বাস্থ্যবিধি মানার অজুহাতে সবকিছু খুলে গেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি এবং তা স্বাস্থ্যঝুঁকির অজুহাতেই। বুঝতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বেশ সচেতন এবং শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংক্রমণ বাড়তে পারে সেটাই সংশ্লিষ্টরা ভাবছেন। করোনাকালী সময়ে পথঘাট, পরিবহন, হাটবাজার লোকেলোকারণ্য থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিকে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় আনার উপযুক্ত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। সরকারের পাশাপাশি শিক্ষাবিদদের এই ক্ষেত্রে একটা সুন্দর উপায় বের করতে না পারাটা সাধারণ মানুষের জন্য একটা কষ্টের ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধু কী অভিভাবক, আগামী বাংলাদেশের গুণগত শিক্ষার জায়গাটিতে একটা ফাটল হয়ে থাকল। যে ফাটল কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনলে আনতেও পারে। কেউ মানতে না চাইলেও কথাটা কিন্তু সত্য। শিক্ষা ব্যক্তিজীবনের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও চর্চা। এই প্রক্রিয়ার ব্রেক মানে ভালোরকম একটা ঝাঁকুনি খাওয়া বলা যায়। অনেকটা রেললাইনের নাটবল্টু আলগা হয়ে গেলে ট্রেনের দুর্ঘনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কার মতো। যা হোক, এই ঝাঁকির ধাক্কা পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা সামলে উঠতে পারবে কিনা সংশয় থেকে যায়। যদি এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হতো যে শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার এবং বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নিয়েছেন তাহলে অযাচিত ফাটল কিংবা ঝুঁকির সম্ভাবনা হয়তো থাকত না। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী উচ্চতর পড়াশোনা করতে ভিন্ন দেশে যায় এবং তা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। যেখানে মেধার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সেই প্রশ্নে অটোপাস কতটা শিক্ষার্থীর জীবনে ঝুঁকি কমাতে সক্ষম সেই বিষয়ে একটু ভাবলে ভালো হতো মনে হয়। সবার মনে আছে যে একটা সময়ে লাগাতার হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতা ও সংঘর্ষ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। তখন কিন্তু ও লেভেল আর এ লেভেল পরীক্ষা রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতো। ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আয়োজন। এটা কিন্তু অসম্ভব ছিল না। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, আগে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন হতো। আর এখন পরীক্ষা সময়মতো হওয়া এবং এগিয়ে নেয়ার আন্দোলন হয়। এটাকে শিক্ষাবিদ, সুশীল এবং সরকার কীভাবে দেখছেন। নিশ্চয়ই ভালো কিছুর বারতা। অন্তত শিক্ষার প্রতি প্রকৃত শিক্ষার্থীদের সিরিয়াসনেস বাড়ছে, জীবনকে সময়মতো গড়ে তোলার জন্য সময়মতো লেখাপড়া শেষ করার তাগাদা অনুভব করছে, সেটাই বুঝায়। এসব কিন্তু ইতিবাচক আচরণ শিক্ষার্থীদের সেটা সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে। আধুনিক ও প্রযুক্তির যুগে ছেলেমেয়েরা চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে এবং সময়ানুবর্তী। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতে তারা ভালোবাসে এবং তা নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে। একদিকে যখন একটা শ্রেণির তরুণ বিপথগামী, বেপরোয়া সেখানে এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এমন চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে তরুণদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা যায় কি না ভাবা দরকার। ভূমিকা রাখলে ভালো হতো। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তদের সংখ্যা কম। শুরুর দিকে করোনার কীট, পরীক্ষা, স্যানিটাইজার, মাস্ক নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ লাগাম ছাড়া ছিল। অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকার শক্ত হাতে দুর্নীতির টুঁটি চেপে ধরে করোনায় মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে পেরেছে। সেই সঙ্গে বিশে^র অনেক উন্নত দেশের আগে বাংলাদেশের মানুষ করোনার ভ্যাকসিন নিতে পেরেছে। এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও গুরুত্ব প্রদান। ঠিক একই রকমভাবে যদি সরকার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কাজটি সম্পন্ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন তাহলে নিশ্চিত বলা যায়, করোনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে যাওয়ার মতোই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে যেত। ঝুঁকি কমে যেত মেধার ভিত্তিতে উন্নত দেশে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও। এমন কোনো ব্যবস্থা কেন করা গেল না যে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারতেন। নাকি আমাদের বিশ^াস করে নিতে হবে যে আধুনিক, প্রযুক্তি ব্যবস্থা এবং উন্নত ভাবনার মানুষের ভিড়ে উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব পরীক্ষা সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না? নাকি ভাবনার ক্ষেত্রে নিজেদের সুযোগ্য করে তোলা যায়নি, সম্ভব হয়নি? আমরা সাধারণ মানুষ সে রকম কিছু ভাবতে চাই না। অন্তত শিক্ষার প্রশ্নে। শিক্ষার অব্যবস্থাপনায় ও অপরিপূর্ণ চেতনার ক্ষতি কোভিড-১৯ এর ক্ষতির চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। একটি জাতির স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন সুরক্ষিত হতে পারে সেই জাতির শিক্ষার আলোকে ও মানদণ্ডে। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তাদেরকে সুস্বাস্থ্য, মন ও মেধার দিক দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থার কথা ভাবলে উন্নয়ন অবশ্যই টেকসই হবে। আর হাঁ দোয়া করি, অটোপাস যেন শিক্ষার্থীদের জীবনে অক্টোপাস না হয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App