×

মুক্তচিন্তা

উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২১, ১২:৫৭ এএম

এক সময় যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা আজ এ দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল মনে করছে। এটা আমাদের জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি ও গৌরবের বিষয়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বিষয়টি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘মানুষ যতক্ষণ না মুক্ত, স্বাধীন ও স্বনির্ভর রাষ্ট্রে বাস করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন সম্ভব নয়।... স্বাধীন হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। স্বাধীনতার পরই বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ আয়োজিত ‘দ্য ভিশন এন্ড দ্য জার্নি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। তার ভাষ্য মতে, বাংলাদেশের যে অর্জন তার জন্য এ দেশের মানুষের গর্ববোধ করা উচিত। স্বাধীনতার ৪০ বছরে দেশের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান অর্জন করেছে। মানবিক উন্নয়ন ও জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২৫ মিলিয়ন নারীকে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এনেছে এবং অভিবাসীদের প্রেরিত মোটা অঙ্কের রেমিট্যান্সের কারণে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে দেশটিতে। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষায় দেশের ভ‚মিকা প্রশংসাযোগ্যÑ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশের উচিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেয়া। কারণ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে দেশটির অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এছাড়া সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অর্জন অসাধারণ। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে বয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী। ৩৫০ আসনের জাতীয় সংসদেও ৬০ জনের বেশি নারী সদস্য রয়েছেন। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অধ্যাপক, মেডিকেল অফিসার, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার, বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী হিসেবে বহু সংখ্যক নারী দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। যখন বাংলাদেশে এ ধরনের উন্নয়ন ঘটেছে তখন সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা এবং অব্যাহত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে পাকিস্তানের অবস্থান অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রায় সব সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। নারী ও জেন্ডার বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে যে শিক্ষা নেয়ার আছে, তা হলো কেবল রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণে নয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উদ্যোগের কারণেও সে অর্জন হয়েছে। নীতিমালা প্রণয়নে নারীদের মূল ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অনন্য উদাহরণ। শ্রমবাজারের একটি বড় অংশ যেমন স্কুলশিক্ষক, পরিবার-পরিকল্পনাকর্মী, স্বাস্থ্য সেবিকা টিকাদানকারী কর্মীÑ এমনকি কারখানা শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশের নারীরা ভারতের চেয়ে বেশি কাজ করছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার নারী কৃষি শ্রমিকের কাজ করছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছেÑ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থা এ রকম ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। খাদ্য উৎপাদন হতো ১ কোটি ১০ লাখ টন। সে খাদ্য দিয়ে দেশের মানুষের তিন বেলা পেট পুর্তি হতো না। খাদ্যের জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। সে সময় দেশি আউশ ও আমনের চাষ হতো বেশি। বিলের নিচু এলাকায় সামান্য পরিমাণ জমিতে হতো বোরো ধানের চাষ। ফলন ছিল খুব কম। বিঘায় ৩ থেকে ৪ মণ। চৈত্র-বৈশাখ মাসে কত লোক মিষ্টি আলু খেয়ে দিন কাটাত তা বলে শেষ করা যাবে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এ বিপ্লবের সূচনা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিপূর্ণতা দান করেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অক্লান্ত পরিশ্রমী কৃষক, মৎস্য চাষি এবং পোল্ট্রি ও গো-খামারিরা এ বিপ্লবের নায়ক। এ নীরব বিপ্লবে কৃষি ও প্রাণিবিজ্ঞানীদের নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভ‚মিকাও কোনো অংশে কম নয়। বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিক কাজে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন। কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তাদের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা ও সমস্যা-সম্ভাবনা। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামবাংলায় বাস করত। জাতীয় আয়ের অর্ধেকের বেশি আসত কৃষি থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে প্রাথমিক হিসেবে খাদ্য ঘাটতি ছিল ৩০ লাখ টন। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেই যেসব অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষি খাত পুনর্গঠন ও উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুননির্মাণ। ১৯৭৩ সালের মধ্যে হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, ২ হাজার ৯০০ গভীর নলক‚প এবং ৩ হাজার অগভীর নলক‚প স্থাপন। ১৯৭২ সালের মধ্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য জরুরিভিত্তিতে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৬ হাজার টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ এবং ১ হাজার ৩৭ টন গমবীজ কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা। পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা হতে কৃষক ভাইদের মুক্তি দেয়া এবং তাদের বকেয়া ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা রহিত করা। এছাড়া ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। নিরলসভাবে কাজ করে দেশে কৃষি বিপ্লব সাধন করুন।’ তিনি আরো বলতেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কৃষি ক্ষেত্রে কতগুলো বাস্তব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পদক্ষেপগুলো হলোÑ গত ৯ বছরে কৃষিকে ভর্তুকি প্রদান ৬০ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। ফসলের প্রতিক‚লতা সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল ১৭৯টি নতুন জাত উদ্ভাবন। চার দফা নন ইউরিয়া সারের দাম হ্রাস করে টিএসপি প্রতি কেজি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা এবং ডিএপি ১৬ টাকা মূল্য নির্ধারণ, ৯ লাখ ৮১ হাজার ১৯৮ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, ২ কোটি ৫ লাখ ৪৪ হাজার ২০৮ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান। ৯১ লাখ ৯০ হাজার কৃষকের ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, খামার যান্ত্রিকীকরণে ১৬৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা ভর্তুকি প্রদান এবং ৪৯৯টি এআইসিসি, কৃষি কল সেন্টার, কৃষি কমিউনিটি রেডিও চালু। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। ধান ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার টন সবজি উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। শুধু সবজি ও দানাদার শস্যেই নয়, বাংলাদেশ মাছ ও মাংস উৎপাদনেও স্বয়সম্পূর্ণতা অর্জন করে। আইলা, সিডর, মহাসেন ও আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্তে¡ও বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রকার সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সফলতার সঙ্গে শেষ করতে যাচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়। এছাড়া বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে মহাকাশে। এর ফলে বাংলাদেশ হবে তথ্য, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানে আধুনিক এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল। বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত এসব কর্মকাÐ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং দেশটিকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ সফলভাবে এমডিজি অর্জন করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করবে। বিগত দশকে বাংলাদেশে জিডিপি ছিল গড়ে ৬ ভাগের বেশি। ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের হার ২৪ দশমিক ৮ ভাগ এবং হতদরিদ্র মানুষের হার ১১ দশমিক ৯ ভাগে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার এবং মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪.৭ ভাগ। কমেছে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে যায়। শতভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করে। দেশের প্রতিটি গ্রামগঞ্জে পাকা রাস্তা নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কুটির শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ডকে ভঙ্গ করেছে। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এসব অর্জন কোনো দিনই সম্ভব হতো না, যদি ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং ২ লাখ মা-বোনের উজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো। নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App