×

সাময়িকী

অনশ্বর একটি মহাকাব্যিক ভাষণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২১, ১২:৫৭ এএম

  অনুপম সেন শিক্ষাবিদ ও লেখক বিশ্ব-ইতিহাসে যে কয়টি অসাধারণ বক্তৃতা আছে, ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ প্রায় দশ লাখ লোকের সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে-ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা তার অন্যতম, সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম। আর কোনো স্মরণীয় ভাষণের বক্তা এ রকম একটি বিশাল জনসমুদ্রে তাৎক্ষণিক শব্দচয়নের মাধ্যমে এমন একটি মহাকাব্যিক ভাষণ দেননি। আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে, আলেক্সান্ডারের পিতা ফিলিপের হাতে যখন একে একে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটছিল, তখন ডেমোস্থেনিস নগররাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের স্বাধীনতা হারানোর আশু অশনিসংকেত নির্দেশ করে যে-ভাষণগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো বিশ্ব-ইতিহাসে স্মরণীয়। সেসব ভাষণের বিভিন্ন অংশ সংরক্ষিত আছে, কালের সীমানা পেরিয়ে সেগুলো আজো আমাদের উদ্দীপ্ত করে। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় চারশ বছর আগে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে ত্রিশ বছর ধরে যে-যুদ্ধ চলেছিল, যা পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিতÑ সে-যুদ্ধের এক পর্যায়ে এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক, গণতন্ত্রের অবিস্মরণীয় পূজারী পেরিক্লিস যে-মৃত্যুঞ্জয়ী, কালজয়ী ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা আজো গণতন্ত্রের প্রতি গভীর ভালোবাসার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চিরন্তন অগ্নিশিখা হিসাবে ইতিহাসকে আলোকিত করছে। বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিদ থুকিডাইডস এ-ভাষণটি রক্ষা ও লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার অমর গ্রন্থ ‘পেলোপনোসিয়ান ওয়ারস’ বা ‘পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ’-এর ইতিহাসে। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা বহু-উদ্ধৃত, বহু-নন্দিত যদিও তা উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। নেতাজী সুভাষ বোস ভারতের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয়দের নিয়ে ভারতের বাইরে, অর্থাৎ বিদেশের মাটিতে ‘ভারতীয় জাতীয় বাহিনী’ বা ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ অৎসু গঠন করে সে-বাহিনীর সদস্য ও আপামর ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বেতারের মাধ্যমে ‘আমাকে তোমরা রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ বলে ভারতীয় জনগণকে আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে যে-ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এক চিরঅমøান, চিরউজ্জ্বল ভাষণ। এসব ভাষণ জনচিত্তে যে-দোলা জাগিয়েছিল, তার রেশ আজো আমরা অনুভব করি। কিন্তু কেন জানি মনে হয়, ৭ মার্চ অপরাহ্নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছে, তখন লাখ লাখ লোকের বিশাল জনসমুদ্রকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু যে-ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার তুলনা যেন ইতিহাসের কোথাও নেই। পেরিক্লিস, আব্রাহাম লিংকন এবং অন্যান্য মহৎ জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কগণ যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন, তা কোনো জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নয়, সেসব ভাষণে কোনো একটা জাতিকে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে, মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহŸান জানানো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে বাঙালি যেন হঠাৎ করে তার হাজার বছরের জড়তা, দৈন্য ও গøানি অতিক্রম করে এক মহাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজন্ম সাধন-ধন, আজন্ম-অধরা স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত দীক্ষা পেল। রবীন্দ্রনাথ একদিন দুঃখ করে লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি বিক্ষিপ্তভাবে জাগার চেষ্টা করলেও তা পূর্ণতা পায়নি। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি বিত্ত-বৈভবের বিভাজন নির্বিশেষে এক মহাঐক্যে জাগ্রত করলেন এক মহাভাষণের মাধ্যমে। এই মহাভাষণের পটভ‚মি তিনিই তৈরি করেছিলেন তার দীর্ঘ তেইশ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮Ñ দীর্ঘ এই দুই দশকে তিনি যে অসংখ্যবার বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য জেলে গেছেন, তা বাঙালি-মননে অগ্নিশিখার মতো কাজ করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তাই তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের একটি পরিণত ফুল ও ফল। এই ভাষণটি তিনি শুরুই করেছেন পাকিস্তানি শাসকচক্রের হাতে তেইশ বছরের মহাবঞ্চনার ইতিহাস উপস্থাপনের মাধ্যমে। শ্রোতার মর্মমূলকে বিদ্ধ করে তার মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে আঘাত হানেÑ এ রকম ছোট ছোট বাক্য প্রয়োগ করে তিনি তাদের জানিয়েছিলেন তেইশ বছরের অত্যাচারের ইতিহাস, অধিকার-হরণের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস; এক কথায়, বাঙালি জাতির সার্বিক পরাধীনতার ইতিহাস। কতবার যে বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, তা তিনি তাদের বলতে ভোলেননি; বলেছেন, অপরূপ গদ্যছন্দে। তেইশ বছরের বঞ্চনা সত্তে¡ও বাঙালি যে সবসময় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে অনুসরণ করেছে, তার প্রতি তিনি প্রথমেই দৃষ্টি আকৃষ্ট করে বলেছেন, বাঙালিকে তার দেয় যদি দেয়া হয়, তাহলে বাঙালি এখনো বহু আত্মত্যাগ সত্তে¡ও দেয়া-নেয়ায়, দান-প্রতিদানে রাজি আছে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের শঠতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ষড়যন্ত্র চলছে।’ ষড়যন্ত্র যদি চলে তাহলে বাঙালির কী করণীয় সে সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দিলেন, ডাক দিলেন, দেশজুড়ে হরতাল পালনের ও সরকারের সঙ্গে অসহযোগের। তিনি বললেন, তাঁর কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, মানুষের অধিকারই মুখ্য, বাঙালির মুক্তিই সর্বাগ্র গণ্য। অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রকে রুখতে অধিকার আদায়ে বাঙালির করণীয় কীÑ তাও তিনি বললেন, যা প্রকৃতপক্ষে ছিল স্বাধীনতারই ঘোষণা। বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে।’ সব মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য লৌকিক বাক্য প্রয়োগ করলেন, যার অনন্য উপমা : ... ‘এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবা।’ সাধারণ মানুষকে জাগাতে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের ব্যবহৃত বাক্যের কি অসাধারণ প্রয়োগ! বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এ জন্য অসাধারণ যে, এই ভাষণে তিনি বাঙালিকে তার হাজার বছরের বঞ্চনা, অবমাননা, পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে ডাক দিয়েছিলেন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হেগেল বলেছেন, ‘বিশ্ব-ইতিহাস মানুষের স্বাধীনতার চৈতন্যের অগ্রগতির ইতিহাস’ (“ঞযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ রং হড়হব ড়ঃযবৎ ঃযধহ ঃযব ঢ়ৎড়মৎবংং ড়ভ ঃযব পড়হংপরড়ঁংহবংং ড়ভ ভৎববফড়স’’- ঐবমবষ, ঞযব ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঐরংঃড়ৎু)। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক সত্তার যৌক্তিক পরিণতি হলো তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেয়া স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। অচেতন যে সত্তা, যেমন একটি পাথর পাথরই থাকে, রোদে পুড়ে জলে ভিজে হাওয়ায় শুকিয়ে পরিবেশের প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। একটি বীজ যখন মহিরুহে পরিণত হয়, তার আগে তাকে বিভিন্ন প্রতিক‚ল প্রতিবেশ ও পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। না-বীজ-কুঁড়ি, না-কুঁড়ি-না-ফুল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একটি গাছ বিকশিত হয়। তাঁর মতে, এটি একটি দ্বা›িদ্বক প্রক্রিয়া। পাথরের ব্যাপারটি অচেতন, কিন্তু উদ্ভিদে বা গাছে রয়েছে চেতনার মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফ‚র্ত স্বয়ং প্রকাশ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোনো যুক্তির তাড়না নেই। সংগ্রামটি অচেতন, সচেতন নয়। মানুষের ক্ষেত্রে তা সচেতন। কিন্তু মানুষের মানুষ হয়ে উঠতে হলে, নিজের অসীম সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে হলে, প্রয়োজন স্বাধীনতা। যে মানুষ অধীন, সে তো তার সম্ভাবনাকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পূর্ণতা দিতে পারে না। এসব অধিকার-বঞ্চিত মানুষ তো তার মানবিক সত্তার সব সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে ব্যর্থ। এ জন্য, বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর ভাষণের শেষ বাক্য উচ্চারণ করলেন, ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখন তা হলো একটি অসাধারণ মহাকাব্যিক উচ্চারণ। কারণ তখন তাতে একটি মহাজাতির হাজার বছরের অপূর্ণ সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেয়ার ঘোষণা এলো। হাজার বছরের সুসুপ্তি ভেঙে বাঙালিকে মরণপণ জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে যে ডাক দিলেন তিনিÑ ‘যে শুনেছে কানে/তাহার আহŸানগীত/ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে/দিয়েছে সে বিশ্ব-বিসর্জন/মৃত্যুর গর্জন/শুনেছে সে সংগীতের মত’Ñ সে আহŸানে, মৃত্যুর গর্জনকে সংগীতের মূর্ছনার মতো শুনে, নির্ভীকচিত্তে বাঙালি ১৯৭১-এ যেভাবে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার তুলনা-কি কোথাও আছে? মহাকাল ছাপিয়ে এই মহাকাব্যিক ভাষণ কি তাই  চির-অমøন নয়!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App