×

মুক্তচিন্তা

রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২১, ১২:৫৭ এএম

চলতিসহ বিগত ছয় অর্থবছরে অব্যাহতভাবে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ পিছিয়ে পড়লেও, বছর বছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৭-২০ হলেও যথেষ্ট উচ্চ প্রবৃদ্ধি (৪০ শতাংশের বেশি) প্রাক্কলন করেই ২০২০-২১-এর জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাস্তবায়নের বাস্তবতায় বছরের মাঝপথে গিয়ে হয়তো উন্নয়ন বাজেট ওরফে এডিপি বড় কাটছাঁটের শিকার হবে, অনুন্নয়ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত বিশেষ করে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণসহ স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হিস্যা হ্রাস পেতে পারে, ব্যাংক ঋণসহ নানান সংস্কারের শর্ত সংবলিত দাতা সংস্থার বাজেট সাপোর্ট ফান্ডের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের যৌক্তিকতা থেকেই যাবে। আসল কথা থেকে যাবে করের হার না বাড়িয়ে কর জালের সম্প্রসারণ ঘটিয়েই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাযতœবান হতে হবে। উপলব্ধিকে বাস্তবতায় এভাবে আনতে হবে সব পক্ষকেই যে, বাঞ্ছিত পরিমাণ রাজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগূঢ় থেকে বের করে আনতে কর রাজস্ব অন্যতম প্রভাবক ভ‚মিকা পালন করবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তরফে সরকারের সামষ্টিক আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতা সঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়। গতানুগতিক কর্মধারায় নয় নীতিনির্ধারক, বাস্তবায়ক ও নাগরিক নির্বিশেষে সবাইকেই সক্রিয় সচেষ্ট হতে হবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণে। আগামী নতুন জাতীয় বাজেটে সে মর্মে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনার পথনকশা প্রত্যাশিত থেকেই যাবে। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বৃত্তাবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরে পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। সেই পাঁচ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভ‚মিকায় ছিল। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাস্তবায়িত এডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা আর ২০২০-২১তে তা ২০৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত অর্থবছরগুলোতে এডিপির বাস্তবায়ন পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে অধিক পরিমাণে রাজস্ব অর্জিত হয়নি বিষয়টি বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। দেখা গেছে আগের পাঁচ অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯:৪১ থেকে ৫৫:৪৫-এর মধ্যে ওঠানামা করলেও পরবর্তী দুই-তিন অর্থবছরে এই অগ্রগতি অনুপাত পরিলক্ষিত হয়নি। রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২৫ থেকে ৩৩-এর মধ্যে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখনো আয়কর কর রাজস্ব প্রাপ্তির পরিবারে অন্যতম শরিক হওয়ার পথে। অর্থনীতির আকার অবয়ব চেহারা ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুলক (আশু) ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকিয়ে আয়করের অবস্থান অনেক ওপরে হওয়া বাঞ্ছনীয়, নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে অধিক পরিমাণে মূসক হিস্যা এখনো শতকরা ৩৫ আর আশু ৩৩। সামষ্টিক অর্থনীতিতে আয়করের অবদানকে অগ্রগামী গণ্য হতে হলে আরো জোরে চালাতে হবে পা, হতে হবে আরো গতিশীল, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ। দেখা যাচ্ছে আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা এখনো ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভ‚মিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। পর্যালোচনায় দেখা যায় ক্রমশ কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০:৩০ থেকে ৫৮:৪২-এ পৌঁছিয়েছে। দেশে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সে হারে বাড়েনি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে কোম্পানি ব্যতীত কর দাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, এসোসিয়েশন অব পার্সন, আর্টিফিসিয়াল জুরিডিক্যাল পার্সনস রয়েছেন তাদের করনেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদারকরণের অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চলছে। যারা আয়কর নথি খুলেছেন তাদের শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদার করার আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতাবান্ধব বা সহজীকরণ বা অনলাইনি করা যাবে তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করনেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। দেশের কর জিডিপি রেশিও উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য যে সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকেই মোড়লের ভ‚মিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে। এক-দুই বছর ধরে প্রকৃত অর্থে বোঝা যাচ্ছে না করদাতা সত্যিই বাড়ছে কি না। সার্বিকভাবে উৎসে কর ও কোম্পানির করের ওপরই আয়কর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটি বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে করের প্রকৃত পরিধি বাড়ছে কি না। করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কি না এবং সেই হারে করের পরিমাণ বাড়ছে কি না। আবার এর সঙ্গে ঢালাও রেয়াত ও অব্যাহতি প্রদানসহ কর ফাঁকি রোধ বা সীমিত করতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করপোরেট করও যারা দিচ্ছেন, তারা সবাই সঠিক পরিমাণে দিচ্ছেন কি না সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ প্রায়ই প্রতিবেদনে দেখা যায়, অমুক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির এত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি। অমুক ঠিকাদার, তমুক ক্যাসিনোওয়ালার ঘরে এন্তার টাকার পাহাড়। এটি তো ছেলে খেলার বিষয় নয়। এখানে কর আহরণকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ সেখানে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের, প্রয়াসের, দক্ষতার, সততার দায়িত্বশীলতার ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিত আসতে পারে। গত কয়েক বছরে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনবিআরের বেশ কিছু সংস্কার, জনবল ও কাঠামোয় ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে ভেবে দেখতে হবেÑ যে হারে সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে, সে হারে কর বা করদাতা বাড়ছে কি না, কিংবা যারা যুক্ত হচ্ছে তারা পরবর্তীতে থাকতে পারছে কি না? বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কর বিভাগের অপারগ পরিস্থিতির কারণে করদাতারা যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। করের বেজ বাড়ানোর জন্য এটি জরুরি। মোট কর রাজস্বে আমদানি শুল্কের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৪২ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩০ শতাংশের পর্যায়ে এবং ২০১৯-২০-এ ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কখনো ২৭ শতাংশ, কখনো মাত্র ৫ শতাংশ অর্থাৎ বড় এলোমেলো এবং অপরিকল্পিত প্রয়াস পরিস্থিতি নির্দেশ করে। ডবিøউটিওর অনুশাসন মেনে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আসছে তাতে ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক হ্রাস পেতে থাকবে এমন একটা ধারণা বা যুক্তি বিদ্যমান থাকলেও ক্রমান্বয়ে উচ্চ শুল্কায়নযোগ্য সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে শুল্ক আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধির কার্যকরণ সম্পর্কটিও পরীক্ষা পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। মূল্য ওঠানামার সঙ্গে ট্যারিফ স্ট্রাকচারের সমন্বয় সাধন, ভ্যালুয়েশনসহ শুল্কায়নে অধিকতর একাগ্রতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও প্রকৃষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর আয়ের হিস্যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৩৩ শতাংশ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৯ শতাংশে এবং ২০১৯-২০-এ ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়কর আয়ের সামঞ্জ্যহীন পরিস্থিতি নির্দেশ করে। মূসক আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মিশ্র হারও মূসক আয়ের টেকসই ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করে না। এ সময়ের (২০০৬-২০) গড় প্রবৃদ্ধি আমদানি (২২ শতাংশ), জিডিপি (৫-৭ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৭-৯ শতাংশ) হিসাব এবং স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলে স্থানীয় পর্যায়ে পরোক্ষ কর থেকে আয়ের প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ২৫ শতাংশের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়। মোট কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা ২০০৭-০৮-এর ২৫ শতাংশ থেকে ২০১৬-১৭তে ৩৪ এবং ২০১৯-২০-এ ৩৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী সময়গুলোর তুলনায় বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতি। এ ধারা আরো বেগবান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে আয়করের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশ, ১১ শতাংশ, ১৮ শতাংশ, ২৮ শতাংশ এবং ১৯ শতাংশ অর্থাৎ সুস্থিরভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে পারেনি। আয়কর দাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত, তা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। এন্তার কর রেয়াত পরিহার, দুর্নীতিজাত কালো টাকাকে বিনা জরিমানায়, স্বল্প কর হারে ও বিনা ব্যাখ্যায় সাদা করার অবারিত সুযোগ প্রত্যাহার করে, দক্ষ ও দায়িত্বশীল লোকবলের সমাহার ঘটিয়ে সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে পারলে মোট রাজস্ব আয়ের হিস্যা বাড়ানো সহজতর হবে। কর জিডিপি রেশিও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রয়াস। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App