×

জাতীয়

ফের প্রকাশ্যে ইসির দ্বণ্দ্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২১, ০৮:৩০ এএম

ফের প্রকাশ্যে ইসির দ্বণ্দ্ব

ইসি ও সিইসি/ফাইল ছবি

অস্বস্তিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একদিকে সাম্প্রতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা মহলের সমালোচনা; অন্যদিকে অন্তর্কলহ। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজার খানেক অতিথির সামনে কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচনে কারচুপিসহ ইসির নানা অনিয়ম নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। এর জবাবে মাহবুব তালুকদারকেও একহাত নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। সবমিলিয়ে প্রশ্নের মুখে সাংবিধানিক সংস্থাটির ভাবমূর্তি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমনিতে বর্তমান ইসির গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে, তার ওপর এভাবে প্রকাশ্যে বিতর্কিত মন্তব্য ও সিইসি-কমিশনার বাকযুদ্ধ নির্বাচন কমিশনের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করবে। ইসির অন্তর্কলহ নতুন কিছু নয়। এর আগেও কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ডজনখানেক নোট অব ডিসেন্ট দেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে নিজ কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে ইসির কার্যক্রমের সমালোচনা, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সমালোচনাসহ কমিশনকে তুলোধুনো করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ভোটার দিবস উপলক্ষে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সাংবাদিকসহ হাজার খানেক অতিথির সামনে বক্তৃতাকালে সিইসিসহ গোটা নির্বাচন কমিশনকে ধোলাই করেন এই কমিশনার। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক নেই; একটি দল থেকে নমিনেশন পেলে তিনিই জিতে যান, তাহলে কমিশন থাকার দরকার কি? মাহবুব তালুকদারের এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ সিইসি নুরুল হুদা পাল্টা আক্রমণ করে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে ‘হেয়, অপদস্থ ও নিচে নামানোর জন্য’ যা করা দরকার, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সবই করে চলেছেন। সিইসি বলেন, তিনি এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য পেশ করছেন। এতে কমিশনের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। সিইসি ও একজন কমিশনারের এই বাকযুদ্ধ গতকাল ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘টক অব দ্য টাউন’। এনিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে গোটা নির্বাচন কমিশনেই। অন্য কমিশনার ও ইসির কর্মকর্তাও বেশ বিব্রত বোধ করেন। যদিও কমিশনারদের মধ্যে বিরোধ বা ভিন্ন মত এই প্রথম নয়; এর আগেও বহুবার তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দুই বছর আগে ‘সিইসি ও ইসি সচিবের একক মাতব্বরি’, অন্য কমিশনারদের অবজ্ঞা করা, তাদের কোনো কিছু না জানিয়ে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া, নিয়োগে সম্পর্কে তাদের না জানানোসহ নানা অভিযোগ এনে সিইসিসহ সচিবের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন অন্য চার কমিশনার। যা নিয়ে সিইসি বেশ বিব্রতও হয়ে পড়েন। পরে যদিও তিনি কমিশনারদের কিছুটা ছাড় দিয়ে এ অভিযোগের নিষ্পত্তি ঘটান। এরপর অন্য বিরোধ খানিকটা তিথিয়ে এলেও ভিতরে ভিতরে একটা অসন্তোষ রয়েই যায়, যা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন কমিশনারদের ট্যুরের কোনো সিডিউল না করে সিইসি ও ইসি সচিবের ট্যুর করা, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সিইসি ও সচিব মিলে নেয়ারও বিরোধিতা করেন অন্য কমিশনাররা। তাছাড়া কমিশনে নিয়োগ নিয়ে সিইসি ও ইসি সচিবের ‘গোপন সিদ্ধান্তে’ অসন্তোষ প্রকাশ করেন কমিশনাররা। এমনকি কোনো একজন কমিশনারের এক আত্মীয়কে চাকরি না দেয়ার বিষয় নিয়ে ইসিতে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হয়। অন্য কমিশনাররা সমান সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিইসির বিরুদ্ধে। তার ওপর আছে প্রশিক্ষণের অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ। বর্তমান সিইসি নুরুল হুদাসহ কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ বাবদ ৭-৮ কোটি টাকা অনিয়ম করে আত্মসাৎ, নিয়োগসহ বেশ কিছু বিষয়ে অনিয়মের তদন্ত করছে দুদক। ইসির পদত্যাগের দাবিতে দেশের ৪০ বিশিষ্টজন রাষ্ট্রপতির কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে তাদের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। ইসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দ্ব›দ্বকে ভালো চোখে দেখছেন না সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচক বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, আগের নির্বাচন কমিশনে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। একটি সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে প্রকাশ্য সভায় এ ধরনের বাকবিতণ্ডা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা একটা অনাকাক্সিক্ষত ব্যাপার। কারো দ্বিমত থাকতে পারে; তবে তা প্রকাশ্য সভায় বলা ঠিক নয়। আমন্ত্রিত অতিথি ও সাংবাদিকদের সামনে এ ধরনের কাজ ঠিক হয়নি। এরকম বিষয় ইসির জন্য ভালো বিষয় নয়; ইসির ইতিহাসে তো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আগেও ইসির কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল, এ রকম থাকেই। তবে আমি আগেও বলেছি, বর্তমান ইসি সত্যিই তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। সাবেক এই কমিশনার বলেন, আমাদের সময়ের হুদা কমিশন অনেক ভালো কাজ করেছি। তবে মতদ্বৈততাও ছিল। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তা মিটিয়ে নিয়েছি, বাইরে প্রকাশ হয়নি। আমাদের ভিন্ন মত হলেও তার সমাধান হয়েছে। তবে এ কমিশন অনেকাংশে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। জনগণের বিশ^াসযোগ্যতা নেই। ইসির হাতে অনেক আইন রয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন মনে করেন, ইসিতে কমিশনারদের মধ্যে মতানৈক্য থাকতে পারে, তবে তা নিজেদের মধ্যে সমাধান করা প্রয়োজন। বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে সিইসি ও অন্য কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্য ইসিকে হেয় করে। তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। এদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাদের দেশে কোনো নির্বাচন কমিশনও নেই, নির্বাচনও হয় না। যা হয় তা নির্বাচনের নামে প্রহসন। ইসির যে কাজ করার কথা, তারা ঠিকমতো তা করছে না। শুধু কমিশন কেন সরকার বিনাভোটে জেতার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তারা কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে। এ নীতিতে এখন সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হচ্ছে। বিচার বিভাগও স্বাধীন নয়। ক্ষমতাসীন দল, রাষ্ট্র, সাংবিধানিক সংস্থাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এটা ফ্যাসিবাদের লক্ষণ বলে মন্তব্য করেন তিনি। আবার নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে ইসিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা তারা কোনোভাবেই প্রতিপালন করছে না। তারা যুবলীগ, ছাত্রলীগের মতো আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটের আগের দিন ব্যালটে সিল মারা হয়, এর চেয়ে ন্যক্কারজনক বিষয় আর কি থাকতে পারে। ইসি মাহবুব তালুকদার যদি বলে থাকেন- নির্বাচন একপেশে হচ্ছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক নেই তো সঠিক কথাই তো বলেছেন। ইসি তো সরকারের একটা বড় ভোটিং এজেন্ট। এরা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের জেতানোর জন্য কাজ করে চলেছে। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, বর্তমান ইসি যেসব নির্বাচন করেছে তা সুষ্ঠু হয়েছে। তবে কোনো নির্বাচন কমিশনার যদি কোনো পক্ষ অবলম্বন করে বিরূপ মন্তব্য করেন; তা ঠিক নয়। মানুষ এ কমিশনকে গ্রহণ করে ভোটে অংশ নিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App