×

রাজধানী

হাত-পা হারানো আরিফ ও রাব্বির চোখে অন্ধকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২১, ০৬:৪৯ পিএম

হাত-পা হারানো আরিফ ও রাব্বির চোখে অন্ধকার

আরিফ ও রাব্বি/ছবি: ভোরের কাগজ

আরিফ হোসেন। পেশায় ওয়েল্ডার মিস্ত্রি। এক সময় শিপ ইয়ার্ডে কাজ করলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে যোগদান করেন দেশের ইতিহাসে অন্যতম মেগা প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে। চায়নার সিআরইসি কোম্পানির আওতায় প্রতিদিন ৭০০ টাকা হাজিরায় মাসে ২১ হাজার টাকায় কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু কাজের সময় একটি দুর্ঘটনা তার জীবনের সবকিছু উলট পালট করে দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা কেটে ফেলেছেন তার বাম হাতসহ দুই পায়ের ৯টি আঙ্গুল। এখন তিনি পঙ্গু। ওই ঘটনার পর আরিফ নিজের চেয়েও বেশি ভেঙ্গে পড়েছেন পরিবারের চিন্তায়। অসুস্থ বাবা-মা, স্ত্রী ও এক শিশু সন্তানের সংসারের একমাত্র চালিকা শক্তি আরিফ। বাকি জীবন কিভাবে চলবে সংসার, কে কিনে দিবে বাবা-মায়ের ওষুধ, একমাত্র সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে কিভাবে সেই চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।

একই অবস্থা আরিফের সঙ্গে আহত হওয়া গোলাম রাব্বীর। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় তিনিও স্বপ্ন দেখতেন সংসারের হাল ধরার। কিন্তু ওই দুর্ঘটনায় এক হাত ও এক পা হারিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন রাব্বি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু রেলওয়ে প্রকল্পের নারায়ণগঞ্জ পাগলা রেল স্টেশনের ৫২ নম্বর পিলার এলাকায় সাইটের কাজ করার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তারা। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল এবং পরে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ইনস্টিটিউটের ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে আরিফ এবং ১০০১ নম্বর ওয়ার্ডে রাব্বি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে তাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। কেরাণীগঞ্জের কোন্ডার কাজীরগাঁও এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ৫ সদস্যের পরিবারে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলাম। দুর্ঘটনায় সব শেষ। এখন সাময়িকভাবে প্রকল্প থেকে বেতন পেলেও হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর কী হবে জানিনা। বাবা জয়নাল আবেদিন ও মা মালেকা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাদের নিয়মিত অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হয়। আড়াই বছরের মেয়ে ফাতেমার পেছনেও অনেক খরচ। ভবিষ্যতে যে কিছু করে সংসার চালাবো, সে উপায়ও থাকলো না। পঙ্গু হয়ে গেলাম। কাজ করে খাবো কিভাবে? তখন পাশে বসে চোখের জল ফেলছিলেন, তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার।

কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো জানতে চাইলে আরিফ বলেন, ৫২ নম্বর পিলারে কাজ করার সময় একজন একটি ক্রেনে ভর দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করি আমি ও রাব্বি। এ সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হই। ক্রেনটি বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে বিদ্যুতায়িত হয়ে ছিলো। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুনেছি আমাদের একটি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আসলেও দিবে কিনা বা কবে দিবে জানিনা। তবে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। যদি কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তাহলে সেই টাকা দিয়ে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করবো।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান চৌরমদন গ্রামের বাসিন্দা গোলাম রাব্বি বলেন, পড়ালেখায় এসএসসির গন্ডি পেরোতে না পাড়ায় স্বপ্ন ছিলো বিদেশে গিয়ে পরিবারের হাল ধরার। কষ্ট ঘোচাবো কৃষক বাবার। এজন্য রাজধানীর কোরিয়ান টেকনিক্যাল থেকে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখি। ৩ মাসের কোর্সের পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে হানা দেয় করোনা। ফলে পরীক্ষা আর হয়নি। চলে যাই গ্রামে। গত ৩১ ডিসেম্বর কাজ নেই চায়নার সিআরইসি কোম্পানির আওতায়। প্রতিদিন ৬০০ টাকা হাজিরায় কাজ করে পরিবারে খরচ জোগাতে সহযোগিতা করতাম। ভেবেছিলাম টেকনিক্যাল থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার এ কাজ ছেড়ে দিবো। কিন্তু তার আগেই হাত-পা হারালাম। তিনি বলেন, এ কোম্পানির শ্রমিকদের জন্য ইন্সুরেন্স নাই। কিছু ক্ষতিপূরণ হয়তো দিবে। তবে, সেফটি ব্যবস্থা ভালো না থাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রাব্বির।

এসময় তার পাশে বসা মা আলেয়া বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, হাত-পা নাই তাতে কি হইছে বাজান। আল্লাহ হায়াত দিছে তাই বেশি। মা ডাকতো শুনতে পারবো। পরক্ষণে রাব্বি মাকে স্বান্ত্বনা দিতে দিতে বলেন, আমার ওতো খারাপ লাগে মা। আমি কি কাঁদি? আর কাঁদবা না আমার সামনে।

রাব্বির বাবা ইদ্রিস শেখ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেয় শুনেছি। ওই পরিমাণে না হোক, সামাণ্য ক্ষতিপূরণ পেলেও ছেলেটার জন্য উপকার হবে। এখন শুধু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অপেক্ষা।

প্রসঙ্গত, গত দেড় বছরে পদ্মা সেতুর রেলওয়ে প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ৮ জন বাংলাদেশী শ্রমিকের করুন মৃত্যু হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App