×

জাতীয়

সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২১, ০৮:৪০ এএম

সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ

ফাইল ছবি।

বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ পৃথিবীর উদার গণতান্ত্রিক সংবিধানগুলোর একটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সরকার অনেকবার সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধুর চার মূলনীতি থেকে দেশ এখনো অনেক দূরে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অর্জন অনেক, তবে ব্যর্থতাও কম নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।

মূল সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’ কিন্তু জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পাকিস্তানি আদলে ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদের ক্ষতচিহ্ন বসিয়ে দেয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল তিনটি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। তবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা ছিল না। শাসনব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক; অসামরিক ও সামরিক। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি মূলনীতি দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই চারটি মৌলিক নীতির ধারায় বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল, এগুলো হলো রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভ এবং সেই সঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মারক। আশা করা গিয়েছিল, এই চার মূলনীতি কখনোই পরিত্যক্ত হবে না। এই নির্দেশনাতেই আমরা সামনে এগোব। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মূলনীতির আরেকটি ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা ছিল না। সেখানে শাসন ছিল পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক; অসামরিক কখনো কখনো, সরাসরি সামরিকই ছিল বড় একটা সময়জুড়ে। জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছে যুদ্ধজয়ের পর। তিনি বলেন, দুর্নীতিতে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি, বায়ুদূষণে ঢাকা সারা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল, কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত নিষ্ঠুরতর হচ্ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে; কিন্তু তিন ধারার শিক্ষা তিন দিকে ছুটছে। আধুনিকতা বেপরোয়া হতে চাইছে, আবার হেফাজতিরাও দ্রুত বেগে ধেয়ে আসছে। মূলনীতিগুলোর দুর্দশা সামাজিক দুর্দশারই প্রতিচ্ছবি।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সংবিধানের চার মূলনীতিতে কতটুকু অটল বাংলাদেশ এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান থেকে সমাজ-রাষ্ট্র অনেক দূরে। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র চেয়েছিলেন; কিন্তু গত ৫০ বছরে এই বৈষম্য আরো বেড়েছে। ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ধর্মভিত্তিক কোনো রাষ্ট্র হতে পারে না। বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, আরেকটি সমাজতন্ত্র এই দুই নীতিকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতিটি পালিয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাড়ছে।

গবেষকদের মতে, পঞ্চাশ বছরেও সংবিধানের ওই চার মূলনীতি এখনো অধরা। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উল্টোপথে যাত্রা করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। স্বৈরশাসকের বন্দুকের নলের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত সংবিধান থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। অথচ শুরুতে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধান ছিল না। বরং সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসনমালে সংবিধানের চরিত্র পাল্টে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের আমলে রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তনে দেখা দেয় নানা বৈপরীত্য। ইতিহাসবিকৃতির মহোৎসব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দুর্নীতির ক্রমবিকাশে মুখ থুবড়ে পড়ে বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনে সংবিধানের মূলনীতি। ক্ষতবিক্ষত সংবিধান ও সামরিক শাসিত রাষ্ট্র চারনীতির পরিবর্তে ফিরে যায় পাকিস্তানি ভাবধারায়।

জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, গবেষক, লেখক শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরের পর ইতিহাস পাল্টে ফেলার চক্রান্তে বন্দি হয় রাষ্ট্র-সমাজ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের হারানো গৌরব অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। জিয়া-এরশাদের আমলের ইতিহাসবিকৃতির মহোৎসবের অনেকটাই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে। ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার দেয়। তিনি বলেন, ৫০ বছরে আমাদের অর্জন অনেক তবে ব্যর্থতাও কম নয়। জাতির পিতাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা সংবিধানকে রক্ষা করতে পারিনি। ৫০ বছরেও আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে পারিনি। জিয়া-এরশাদ বারবার সংবিধানকে পাকিস্তানের সংবিধান বানাতে চেয়েছিল। পাকিস্তানের সংবিধান করার জন্য ৩০ লাখ শহীদ প্রাণ দেননি। কিন্তু জিয়া এবং এরশাদ বারবার সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে। গত ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার শুরু এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনাই আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বড় চ্যালেঞ্জ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা সংবিধানের মূল চেতনা ফেরত আনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।

সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে দেশ এখনো অনেক দূরে এমনটাই বক্তব্য বিশ্লেষকদের। সেইসঙ্গে কমেনি ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, মিলেনি কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন ভোরের কাগজকে বলেন, গণতন্ত্রের অবস্থা নাজুক। সংবিধানে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝানো হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি হয়নি, তবে উন্নয়ন হয়েছে। বেড়েছে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। সুষম বণ্টন, উন্নয়ন সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়নি। পঁচাত্তর সালের পর জাতীয়তাবাদ-ধর্মনিরপেক্ষতা-অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়েও বিতর্ক দেখতে হয় আমাদের। আমাদের অর্জন অনেক, তবে সন্তোষজনক নয়। যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই আমরা। মানসম্মত শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা নাজুক। নিরাপদ সড়ক অর্জন হয়নি। সাংস্কৃতিক কর্মকা- কমে গেছে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর অবস্থা হতাশাজনক। পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা নেই, চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নেই। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি, এটি বড় অর্জন; তবে পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন জরুরি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App