×

মুক্তচিন্তা

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, আমাদেরও বদলাতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২১, ১২:২৩ এএম

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, আমাদেরও বদলাতে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসি না। ফাইল ছবি

বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, আমাদেরও বদলাতে হবে
[caption id="attachment_268451" align="alignnone" width="870"] ফাইল ছবি[/caption]

গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের সিডিপি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুপারিশ করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয় তা অন্য দেশগুলো ছাড়া একমাত্র বাংলাদেশই পূরণ করতে পেরেছে। শর্ত তিনটি হচ্ছে মাথা পিছু গড় আয়, উৎপাদনশীলতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা। বাংলাদেশ তিনটি শর্তই নির্ধারিত নম্বর অতিক্রম করেছে। অন্য দেশগুলো দুটির বেশি শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সে দিক থেকে বাংলাদেশের এই অর্জন বেশ মর্যাদাকর এবং শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিতÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অর্জন বাংলাদেশকে নিয়ে দ্রুত সম্মুুখে এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুপারিশ করার খবরটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীকে অবহিত করেন। তিনি এ কৃতিত্ব জনগণকেই প্রদান করেন এবং আগামী দিনের তরুণদের উৎসর্গ করেন।

১৯৭২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তখন সবেমাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আমাদের কিছুই ছিল না। সে কারণে হেনরি কিসিঞ্জার বড় লোকের চোখ দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তি ও জনগণ আমাদের নেতা শেখ মুজিব এবং যুদ্ধজয়ী বীর জনতাকে সম্মানের চোখে দেখেছে। অনেক দেশই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে সব প্রতিক‚লতা অতিক্রম করে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। সে কারণে তার শাসনকালেই ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। এটি আমাদের জন্য যথেষ্ট মর্যাদার বিষয় ছিল। তখন বাংলাদেশের জিডিপি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। দেশ কৃষি অর্থনীতিতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের এই পরিবর্তন বিস্ময়কর হলেও দেশে অনেক অন্ধ সমালোচকের কাছে কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ ডুগডুগি দীর্ঘদিন নতুন প্রজন্ম এবং জনগণের কানের কাছে বিরামহীনভাবে বাজানো হতো, সুযোগ পেলে এখনো বাজানোর চেষ্টা করা হয়। এতে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হন হয়তো। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অবৈধ এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে দুই দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তারা দেশকে কেন স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে বের করে আনতে পারেননি। সেই প্রশ্ন এখন বোধ হয় তাদের প্রতি করা দরকার। বস্তুত দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনার ন্যূনতম কোনো পরিকল্পনা বা যোগ্যতা তাদের ছিল কিনা সেটিই বড় প্রশ্ন। যদি তেমন পরিকল্পনা থাকত তাহলে স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণ অনেক আগেই বাংলাদেশের পক্ষে ঘটা সম্ভব ছিল। এতে প্রমাণিত হয় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং সরকার দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা, সংস্কার এবং কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে যা অরাজনৈতিক বা ডানপন্থার অপশক্তি কখনো করে না। দেশ পরিচালনায় প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দখলদার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়টি বোঝা ও উপলব্ধিতে নিতে হয়।

১১৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার সুযোগ পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার লাভ করে। হতদরিদ্র মানুষদের আশ্রয় এবং ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের সূচনা করেন তা ছিল অভাবনীয়। সেই সময় বাংলাদেশ বিদেশ নির্ভরশীলতা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতির মোকাবিলায় সরকার সফল হয়। দেশে দ্রব্যমূল্য সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধনের চাইতে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু দমন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় উগ্র ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে অংশীদারিত্ব প্রদান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের অর্থনৈতিক চাকা অগ্রসর হওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনী মুখ থুবড়ে পড়ে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে একটি বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এতে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। শেখ হাসিনা তার এই কর্মসূচিতে ভিশন-মিশন উপস্থাপন করেন, যা তখন অনেকের কাছেই স্বপ্নচারিতা বলে মনে হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া, শিক্ষানীতি প্রণয়ন সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ সামাজিক নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টি, শিল্পের প্রসার ঘটানো ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি ফিরে আসে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করে এবং তখনই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মর্যাদা লাভের বাস্তবতা স্বীকৃত হয়। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘের সিডিপি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করায় একদিকে আমাদের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহকে টিকিয়ে রাখার নতুন দায়ও বর্তাতে যাচ্ছে। অবশ্য কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশ ২০২৪-এর পরিবর্তে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের চ‚ড়ান্ত মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেসব সুযোগ-সুবিধা ইউরোপসহ উন্নত কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে লাভ করত, সেগুলো ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার প্রতিশ্রæতিতে বাংলাদেশের পক্ষে বর্তমান সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখার বিশেষ সুবিধা বহাল থাকবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি নৈতিকভাবে আমাদের শক্তি জোগাবে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের সূচকগুলো ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশকে আগের গতিতে চললে বা বদলালে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এখন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে তা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে প্রথাগত শিল্পের ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। এতদিন আমরা গার্মেন্টস শিল্পের ওপর যতটা নির্ভরশীল ছিলাম তা দিয়ে খুব বেশি দিন চলা সম্ভব হবে না। আমাদের শিল্পের বিভিন্ন খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও হাইটেকের নতুন নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। তাহলে একদিকে কর্মসংস্থান ও অন্যদিক রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আফ্রিকা মহাদেশে বাজার খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সুতরাং কর ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতেই হবে। কৃষি-অর্থনীতিতে যেসব সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সেসবকে প্রযুক্তির ব্যবহারে আরো বৈচিত্র্যকরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবর্তনের জন্য সবচাইতে গুরুত্ব দিতে হবে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ওপর। আমাদের ৩৪ শতাংশ তথাকথিত শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকে। এর কারণ হচ্ছে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় এরা ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। অথচ আমাদের গ্রামীণ সমাজে স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র চার শতাংশ। দেশে এখনো কায়িক শ্রমের চাহিদা থাকায় অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত মানুষদের কর্মসংস্থান অপেক্ষাকৃত বেশি হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নশীল অর্থনীতির উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে এই মানুষদের অবশ্যই বিভিন্ন পেশায় প্রযুক্তি দক্ষতায় গড়ে তুলতে হবে। সে কারণে শারীরিক শ্রমদানে রত বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষিত এবং কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ করে তোলা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। সেটি করা গেলে দেশ থেকে দারিদ্র্যের হার অনেকটাই নির্মূল হয়ে আসবে। তবে যে শিক্ষা ব্যবস্থাটি এখন আমাদের দেশে রয়েছে তাতে সাধারণ শিক্ষা, ভোকেশনাল, কারিগরি এবং উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষাকে এই সময়ের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সেজন্য বদলাতে হবে আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার বৈচিত্র্যকরণই শুধু নয়, সেগুলোকে মানসম্পন্ন প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে যেসব বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো তেমন মানসম্পন্ন নয়। কারিকুলাম ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সেখানে বৃদ্ধি করতে হবে। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি, মানবসম্পদ এবং সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কীয় জ্ঞানতাত্তি¡ক ধারণা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি গবেষণার গুরুত্ব বাড়াতে হবে। বিপুল সংখ্যক গবেষক সৃষ্টি করতে হবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশাসন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং দেশ রক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রেই জ্ঞান, প্রযুক্তি ও দক্ষতার সমাবেশ ঘটাতে হবে। এভাবে বদলানো গেলে তবেই বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উত্তরণ স্বাভাবিক নিয়মে ঘটবে। কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব কিছু নয়।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App