×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ১২:২১ এএম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে সমগ্র মার্চ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তথা বাঙালিরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এই উপলব্ধি বোধ থেকেই বাঙালি জাতি ক্রমান্বয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে বসে যুব নেতা শেখ মুজিবসহ ১৪ জন বাঙালি নেতা এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সম্ভাব্য সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নির্যাতন-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এই আশঙ্কা ক্রমেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৪৮-এর মার্চে পাকিস্তানের বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন ঢাকা রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে প্রদত্ত ভাষণে যখন বলেন, ‘টৎফঁ ্ টৎফঁ ংযধষষ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ’, তখনই বৈষম্যমূলক ও অনৈতিক ঘোষণার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ শুরু হতে থাকে। যার প্রথম প্রতিবাদের প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে চরম ভারাডুবির মধ্য দিয়ে। যুক্তফ্রন্ট গঠনের পেছনে তদানীন্তন  যুবনেতা শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভ‚মিকার কারণে তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব লাভে সক্ষম হয়ে নেতৃত্বে¡র আসনে অধিষ্ঠিত হতে শুরু করেন। বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফার ভিত্তিতে ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ সত্তে¡ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী ঘোষণার পরও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পাঞ্জাবিদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালিদের নিধনের যাবতীয় প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে। প্রহসনমূলক আলোচনার নামে জাহাজে করে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত থাকে। ’৭০-এর ২ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ পূর্ববাংলার মানচিত্র ও লাল সূর্য খচিত সবুজ পতাকা উত্তোলন করে। মার্চের প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর আহŸানে শুরু হয় হরতাল। তবে জনস্বার্থে ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র, আবর্জনা বহনের ট্রাক, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, দমকল, পানি সরবরাহ হরতালের আওতামুক্ত থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ৫ মার্চ মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ মার্চ বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জাতিকে শায়েস্তা করার হুমকি দেন। সমগ্র জাতি এ হুমকির তোয়াক্কা না করে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। যেহেতু রাত পোহালেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ তাই অধীর আগ্রহে কৌত‚হল এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গোনে সমগ্র জাতি। বাঙালির বহু কাক্সিক্ষত ও প্রতীক্ষিত ৭ মার্চ দলবদ্ধভাবে জঙ্গি মিছিল ও লাঠিসোটা নিয়ে লাখো মানুষের ঢল নামতে থাকে তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-চাকরিজীবী জনসভাস্থলে পৌঁছে। সবার মুখে ধ্বনিত প্রতি-ধ্বনিত হয়Ñ তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, জয় বাংলা প্রভৃতি সেøাগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। কোনো নেতার আহŸানে, কারো ভাষণ শুনতে এত বড় জনসমুদ্র কখনো কোথাও হয়েছে কি না জানা নেই। কোনো নেতার ভাষণ কোনোদিন জাতিকে এত উজ্জ্বীবিত ও অনুপ্রাণিত করেনি। এটি সন্দেহাতীতভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি, যা আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃত। যে ভাষণ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার সামান্য ছন্দ পতন ঘটেনি, যা তিনি উপস্থাপন করেন কবিতার মতো। যা ছিল সাবলীল অথচ অলিখিত। যেটি ছিল তৎকালীন সময়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, আলোচনার নামে প্রহসন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তথা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার গভীর চক্রান্তে লিপ্ত এবং বৈঠকের নামে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। তাই জাতিকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহŸান জানাতে তিনি সামান্য ভুল করেননি। জাতি তার নেতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ, পাড়ামহল্লা, ঘরে ঘরে যার যার সাধ্য অনুসারে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর হামলা প্রতিহতের প্রস্তুতি নেয়, এ লক্ষ্যে সমগ্র দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। সর্বত্র উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত সবুজ পতাকা। ক্ষমতায় আরোহণ ছাড়া বিশে^র কোথাও কোনো নেতার নির্দেশে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার এমন ঘটনা বিশে^র ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী সমাপ্তির পর ১০১ বছরে পদার্পণ করবে। এটি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই মহামানবের জন্ম না হলে এই জাতির নিজস্ব আবাসভ‚মি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। যিনি দীর্ঘদিনের নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জাতির সার্বিক মুক্তি আনয়নের লক্ষ্যে জাতিকে ক্রমান্বয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার তথা জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ বা স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার সম্মোহনী ক্ষমতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে। যে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার অবজ্ঞার সঙ্গে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের পথে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার কঠোর পরিশ্রম ও সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণে।  মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার হোক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধীদের সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশাত্মবোধ তথা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নেয়ার। জাতির জনকের অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শোষণ-নির্যাতন-নিষ্পেষণমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করা তা হলেই সম্ভব মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণ পরিশোধ করে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী কর্তৃক আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানীর প্রতিশোধ নেয়া, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শোষণহীন-অসাম্প্রদায়িক তথা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এটিই হোক সমগ্র জাতির দৃঢ় অঙ্গীকার। হাসান-উজ-জামান : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ)। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App