×

মুক্তচিন্তা

নদীগুলোকে বিপদমুক্ত করতে হবে, বাঁচাতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ১২:২১ এএম

ভ‚মি দখল, জবরদখল বাংলাদেশের একশ্রেণির দুর্বৃত্তের অভ্যাসে পরিণত হয়েছেÑ সে অভ্যাস পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। মনে পড়ছে বছর কয়েক আগে সরেজমিন বালুখেকোদের অপতৎরতা দেখে সেতুমন্ত্রীর ক্ষোভের কথা। কিন্তু তাতে বন্ধ হয়নি বালুখেকোদের রাক্ষুসে থাবা। যাক কাত হয়ে সেতুর পিলার, তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না। জনস্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ নষ্ট হলে তাদের কী? তাতে তাদের ব্যক্তি স্বার্থের শ্রীবৃদ্ধি-সমৃদ্ধি ঘটে। বালুখেকো পাতি বিত্তবান মহাবিত্তবানে বা শিল্পপতিতে পরিণত। পরবর্তী সময়ে দিনের পর দিন দেখেছি সংবাদপত্রে খবর অবৈধ বালু উত্তোলন বা পাহাড় কাটার অনাচার নিয়ে। কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। ভিন্ন একজাতীয় দুর্নীতির বরং বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে, এর রূপান্তর ঘটেছে বৃহত্তর আগ্রাসন। সে আগ্রাসন খালবিল-নদী দখলের। বাধাবন্ধহীন সে আগ্রাসন। কখনো তা মাঝ নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ, কখনো নদীর পার ঘেঁষে অবৈধ স্থাপনা। মাঝেমধ্যে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রুল জারি, কখনো তা মান্য করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, এরপর যথারীতি সেই সব স্থাপনার নবনির্মাণ। হয়তো আর উচ্ছেদ নয়, নদী জলপ্রবাহ ব্যাহত হয় হোক, ব্যক্তিস্বার্থের শ্রীবৃদ্ধি তো ঘটছে। \ দুই \ বাংলাদেশের খ্যাতি নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। নদী এবং তার শাখা-প্রশাখা তার প্রাণ। এই ভৌগোলিক স্বার্থ রক্ষার দায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সে দায়বদ্ধতা যথাযথভাবে সর্বাংশে পালিত হচ্ছে এমন সত্য বলা কঠিন। এসব ঘটনার সচিত্র সংবাদ দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি; এমনকি যমুনায় মাঝ নদীতে মাছের ঘের ব্যবসা, অঢেল অর্থের সঞ্চয়। সচিত্র সংবাদ দেখে-পড়ে অবাক হয়েছি। বাংলাদেশের খাল-বিল এবং ছোটখাটো নদী অর্থাৎ শাখা নদীগুলো উল্লিখিত অত্যাচারে বিলুপ্ত হতে বসেছে। সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে মাঝেমধ্যে দৈনিক সংবাদপত্রে। তাতে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষের বড় একটা টনক নড়েনি। তারা এর পরিণতির কথা ভেবে দেখেননি। জাতীয় সম্পদের বিনাশ তাদের দায়-দায়িত্বে দাগ কাটেনি, দেশপ্রেমে ছাপ ফেলেনি। উদাহরণ অনেক। সম্প্রতি একটি ভয়াবহ খবর পড়ে অবাক হয়েছি, এর ভবিষ্যৎ পরিণাম ভেবে শঙ্কিত হয়েছি। শিরোনামটি হলো, ‘বাইশাডারা নদী যেভাবে পুকুরে রূপ নিল।’ এটি তিস্তার শাখা নদী। মিত্র দেশ ভারতের কথা না রাখার পরিণামে উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী তিস্তার দুর্দশার বিষয়টি বহুল আলোচিত, যেমন বাংলাদেশের সমাজে সংস্কৃতি অঙ্গনে, তেমনই রাজনৈতিক মহলে। বহু অঙ্গীকার সত্তে¡ও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। ঘাটতি যে রাজনৈতিক মহলের তা যেমন স্বদেশের তেমনি প্রতিবেশী মিত্র দেশের। বালু তোলা, নদী দখল, পাহাড় কাটা অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রভাবশালী মহলের বলেই কোনো প্রতিকার নেই। দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম, ‘বালু-পাথরখেকোরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।’ এরা এতটা প্রভাবশালী যে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার ধার ধারে না। হাইকোর্টের নির্দেশও নয়। পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুনামগঞ্জের বালু-পাথরখেকো মহালে লুটপাটের মহোৎসব চলছে। সবচেয়ে বড় মহাল যাদুকাটা নদীর সাত কিলোমিটারজুড়ে যেন বালু-পাথরখেকোদের অভায়রণ্য। স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা নদী পারের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’ মনে হয়, এদের অবৈধ-অনৈতিক কর্মে বাধা দেয়ার মতো কেউ নেই, কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ অনাচার আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। প্রতিকার নেই। \ তিন \ উত্তরাঞ্চলের নদী তিস্তার দুঃখ, তিস্তার কান্না দেখার মতো কোনো অভিভাবক নেই। মিত্রদেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা (নানা দলের) কেবল প্রতিশ্রæতিই দিয়ে গেলেন তিস্তাকে নিয়েÑ মনমোহন সিং থেকে নরেন্দ্র মোদি, কিন্তু তিস্তা সমস্যার সমাধান হয়নি। তিস্তা নদী মরু-খরায় ভুগছে। এর প্রভাব পড়ছে তিস্তার শাখা-প্রশাখায়। ক্ষুব্ধ সাংবাদিকের খবর শিরোনাম খুবই স্বাভাবিক। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘বাইশাডারা নদী যেভাবে পুকুরে রূপ নিল।’ অথচ তিস্তার এই শাখা নদীটিতে একসময় নৌকা চলছে, নৌকাবাইচ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে ঘটা করে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে বাঁধ দেয়ার কারণে নদীটির এই সর্বনাশা পরিণাম। স্থানীয় প্রবীণদের এমনই অভিমত। অপরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে জলপ্রবাহ বন্ধ করার সুযোগ নেয় যথারীতি স্বার্থপর মানুষ, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। শুরু হয় নানাভাবে নদীর হত্যাযজ্ঞ। যে যেখানে প্রধান্য পায় মাছ চাষ শুরু করে। এরপর সরকারি-বেসরকারি আঁতাতে ইজারাদানের মাধ্যমে নদী আর নদী থাকে না। সেটি বিভিন্ন স্থানীয় প্রধান ব্যক্তিদের কৃত্রিম ব্যবস্থাপনায় ব্যবসা ও অর্থ উপার্জনের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। কখনো ছোট নদী বাঁধে বিভক্ত ছোট ছোট জলাশয় তথা পুকুরে পরিণত হয়, যা স্বার্থপর ব্যক্তিদের মাছ চাষের চাহিদা জোগায়। আবার কখনো সেগুলো ভরাট করে ভবন তৈরির উপযোগী স্থানে পরিণত করা হয়। তাতে কখনো বিপণিবিতান, কখনো ক্ষুদ্র আবাসন স্থাপত্য নির্মাণেরও পরিকল্পনা নেয়া হয়, যা অধিকতর অর্থের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। অভিভাবকহীন নদীর পক্ষে কথা বলা, তাকে সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতার টানে একটি শাখা নদী কীভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়, তিস্তার শাখা নদী বাইশাডারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে সর্বনাশের ঘণ্টা বাজিয়ে। এর কি কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই? আমাদের ক্ষুধিত স্বার্থপরতা তেমন কোনো রক্ষা ব্যবস্থার অবকাশ রাখেনি। রাখলে এত নিয়মনীতি রক্ষার ব্যবস্থা থাকার পরও একটি নদীর মৃত্যু ঘটে কীভাবে? শুধু বাইশাডারা নয়, গত কয়েক দশকে অনেক ছোট ছোট শাখা নদীর অপমৃত্যু ঘটত না এবং স্থানীয় মানুষের জন্য জলকষ্ট তৈরি করত না। তাই অবাক হই না যখন ঐতিহ্যবাহী স্বনামখ্যাত শীতলক্ষ্যা মানুষের বিকৃত অত্যাচারের শিকার হয়ে ক্রমশ জীর্ণ, শীর্ণকায় হয়ে উঠছে অনাচারী স্থাপনার সমারোহে। বেশ কয়েক বছর আগে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য রুল জারি করে কিছু উচ্ছেদকর্ম সম্পন্নও হয়। এরপর যথারীতি পূর্বাবস্থা। কিছু সংখ্যক দুর্বৃত্ত উচ্চ আদালতের রায়কেও মান্যগণ্য করে না। মনে হয় তারা নিজেরাই রাজার রাজা। শীতলক্ষ্যার অবস্থা অনেকটাই সে রকম। তাই শীতলক্ষ্যার দুর্ভোগ নিয়ে সংবাদপত্রের এমন এক শিরোনাম : ‘নদীর জায়গায় বিপণিবিতান।’ ভাবা যায় না এমন ভয়াবহ অবস্থার কথা যে ‘নদীর তীরের জায়গা দখল করে ৩৬টি দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অগ্রিম টাকা নিয়ে দোকান ভাড়া দেয়া হচ্ছে।’ মনে হয় নদী আর জাতীয় সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নয়, এগুলো কায়েমি স্বার্থবাদীদের লোভের ও স্বার্থের অধীন। বলতে হয়, গনিমতের মাল। আমাদের দাবি প্রকৃত সম্পদ জাতি ও জনগণেরÑ এর যুক্তিসঙ্গত অধিকার রক্ষা করতে হবে। এ দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রের। সেখানে কোনো স্বার্থের খেলা চলবে না। যদি চলে তাহলে রাষ্ট্রীয় ভ‚খণ্ড এর সম্পদ ও সৌন্দর্য সব কিছুর জন্য সমূহ-বিপদ। এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নিয়মতান্ত্রিক লড়াই অপরিহার্য। তরুণ প্রজন্মকে এ দুরূহ কাজে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শীতলক্ষ্যাকে বিপণিবিতানের দূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। তেমনি অন্যান্য নদী ও শাখা নদীগুলোকে। এমনকি বাঁচাতে হবে জলাধাররূপী খালবিলগুলোকে। এ বিষয়ে কিছু কাজ চলছে, কিন্তু তাতে সমাধান নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিযান চালাতে হবে। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App