×

জাতীয়

ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ০৯:১৬ এএম

ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা

প্রতীকী ছবি।

‘আমাদের দেশের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমরা কষ্ট ভোগ করছি। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠব, ইনশাল্লাহ।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটির দেশে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন প্রত্যয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সম্পাদক উইলিয়াম এস এলিসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সোনার বাংলা নিয়ে তার বিশ্বাসের কথা এভাবেই তুলে ধরেন সদ্য স্বাধীন দেশের জাতির পিতা। পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথেই এগিয়ে চলছে পঞ্চাশে পা রাখা বাংলাদেশ। কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন ‘উন্নয়নশীল দেশ’। করোনা ভাইরাসে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল। ৫০ বছরে বদলে যাওয়া নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে বিশ্ব। টার্গেট রূপকল্প-২০৪১। এর মধ্যেই উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে জাতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যাত্রা ছিল কণ্টকাপূর্ণ ও বিপদসংকুল। ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, প্রায় সবকিছুই ক্ষত-বিক্ষত। বৈদেশিক মুদ্রার শূন্য ভাণ্ডার ও ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ। ঘরে ঘরে ক্ষুধার্ত মানুষ, বাইরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতিসহ আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। সেই অবস্থা থেকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করা, সংবিধান প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান, সবই সামলাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরিই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বড় সাফল্য। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও দেখানো পথে হেঁটে বর্তমানে উন্নয়নের রোল মডেল আজকের বাংলাদেশ।

জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের জন্মলগ্নে কিসিঞ্জারের অভিসম্পাত ছিল, বাংলাদেশ হবে দারিদ্র্যের তলাবিহীন ঝুড়ি। জাতিসংঘের দুজন অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফ্যালান্ড ও জন পার্কিনসন বাংলাদেশ ঘুরে যৌথভাবে গবেষণাগ্রন্থ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট।’ তাদের নেতিবাচক মন্তব্য ছিল, বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে বিশ্বের সব দেশের উন্নয়ন হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে ২০০ বছর সময় লাগবে। এই ইতিহাসবিদ বলেন, অভিসম্পাতের মুখে ছাই দিয়ে ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর বাংলাদেশের বড় অর্জন।

এর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ দেশের মানুষ। ১৯৭২ সালে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, হতদরিদ্র দেশে ফিরে আপনি কি করবেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার দেশের মানুষ বেঁচে থাকলে আমরা ঠিক আবার জেগে উঠব। ফিনিক্স পাখির মতন জেগে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। যদিও সূচকের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেমন সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং শ্রমিকের গড় আয় সমান নয়। তবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এটি সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।

পঞ্চাশ বছরে শিক্ষা, গড় আয়, আমদানি, রপ্তানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, প্রতিটি সূচকেই পাকিস্তানিদের তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ। অনেক সামাজিক সূচকে ভারত থেকেও এগিয়ে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের কারণ খুঁজছে তারা। স্বাধীনতার আগে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি টনেরও নিচে। বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪ কোটি ৫১ লাখ টন। গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ রয়েছে। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বশেষ পরিমাণ ২৪ হাজার মেগাওয়াট। মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের। উন্নয়নের রোড ম্যাপ ধরে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল ও এলএনজি টার্মিনাল। ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগচিত্র বদলে দিয়েছে ফ্লাইওভার, ব্রিজ। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড ফরাসউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা ভাইরাসের ঝড়-ঝাপটা পেরিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এটি আমাদের গৌরবের অর্জন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি একটি যুগান্তকারী অর্জন। এই অর্জনের ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় আওয়ামী লীগ সরকারের একটি যুগান্তকারী সফলতা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় থাকা বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫৫ হাজার মানুষের বন্দিত্বের অবসান হয়। লৈঙ্গিক সমতা বিধান এবং নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করার মাধ্যমে দেশটির সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে আরো উৎসাহিত করার পথ সুগম করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে বিরল। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউএনউইমেন প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন এবং এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর পিস ট্রি পুরস্কার এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ ২০১৮ পুরস্কারে ভূষিত হন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ৫০ উন্নীতকরণ, উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি, ইউনিয়নে সংরক্ষিত নারী আসন ব্যবস্থাকরণ ছিল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। জলবায়ু প্রভাবজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ব স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক পুরস্কার চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশ দ্য গ্লোবাল গ্রিন অ্যাওয়ার্ড ২০১৪ অর্জন করে। আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটিকে ‘ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ডে হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে জাতিসংঘ। শুধু ২০২০ সালেই বন ও পরিবেশ উপকমিটি সারাদেশে প্রায় ১ কোটিরও বেশি গাছের চারা রোপণ করে।

জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মতে, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। সাক্ষরতার হার বেড়ে যাওয়া, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। জাপানের মতো দেশও এখন বাংলাদেশের পেছনে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ, এই স্বপ্নপূরণের পথে কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বিশ্বের অনেক পণ্ডিত বলেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও টিকে থাকতে পারবে না। বন্যা-খরাসহ দুর্যোগপীড়িত একটি দেশ। নিজেদের সম্পদ নেই। কিসিঞ্জার বলেছিল, তলাবিহীন ঝুড়ি। বিশ্বে ভিক্ষুকের দেশ হবে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে আর হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্য অসাড় প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষভাবে ভাইরাস মোকাবিলা করেছেন। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছবে বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গতি যোগ করতে দেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতোমধ্যে ১৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের জন্য আসছেন। সারাদেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক ও আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি করে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। তিনি বলেন, ৫০ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যপূরণে কাজ করছে সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App