×

জাতীয়

উত্তরণ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:০১ এএম

উত্তরণ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেল বাংলাদেশ

‘স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? তোমাদের আছে পাট, চা ও চামড়া। এ দিয়ে তোমাদের ‘সংসার’ চলবে না। ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হবে।’- সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে এমন বক্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যায়িত করা পাকিস্তানি দোসর কিসিঞ্জারের দাম্ভিক বক্তব্য মিথ্যা-অসাড় প্রমাণ করে বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। সর্বত্র আমাদের প্রশংসা। কৃষি, তৈরি পোশাক রপ্তানি ও রেমিটেন্স এখন দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে তরুণ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অসাধারণ এক অর্জন। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য আনন্দ ও গৌরবের। কিন্তু এই অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। তার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা জরুরি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সব শর্তপূরণ করে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় তাদের তিনটি সূচকেই শর্তপূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। সিডিপির শর্ত অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫ দশমিক ৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে সেই দেশকে এলডিসিভুক্ত রাখা হয়, ৩২-এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী, উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতি চলার সময়ে ভোগ করতে পারে। করোনা ভাইরাসের মহামারির বাস্তবতায় উত্তরণ প্রক্রিয়াকে টেকসই ও মসৃণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে সিডিপির কাছে প্রস্তুতির জন্য পাঁচ বছর সময় চাওয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সস্তা ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ফলে সেই সুবিধাগুলো উত্তরণের প্রস্তুতি পর্বের জন্য সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকাল শেষে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে। ওই বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, জাতিসংঘের সিডিপির তিনটি শর্তেই সুচারুরূপে পাস করেছে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের ঝড়-ঝাপটা পেরিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ২০২৬ সালের পর বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের বর্তমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, কর্মসংস্থানমূলক শিল্পায়ন ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ করা প্রয়োজন। মূলত, ষাটের দশকে স্বল্পোন্নত দেশের ধারণাটি আসে। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত- এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে জাতিসংঘ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো তুলনামূলক বেশি পিছিয়ে আছে, তাদের নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে জাতিসংঘ। ১৯৭২ সালে অনুন্নত দেশ ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৮ সালে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল মর্যাদা দিয়েছেন। বাংলাদেশ এমন একটি সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে চলেছে, যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন করছে জাতি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বিশ্বের অনেক পণ্ডিত বলেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও টিকে থাকতে পারবে না। বন্যা-খরাসহ দুর্যোগপীড়িত একটি দেশ। নিজেদের সম্পদ নেই। কিসিঞ্জার বলেছিল, তলাবিহীন ঝুড়ি। বিশ্বে ভিক্ষুকের দেশ হবে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে; আর হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্য অসাড় প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরি করেছেন আর তার কন্যা চার মেয়াদের শাসনামলে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। এটি আকাশছোঁয়া অর্জন। রোল মডেল বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষভাবে ভাইরাস মোকাবিলা করেছেন। উন্নয়নের অভিযাত্রায় এই অর্জন কারো দয়া-দাক্ষিণ্যে নয়। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের এই বিজয় অর্জন অনন্য। এদিকে প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সব সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, উন্নয়নের মাইলফলক অর্জন। এই স্বীকৃতি গৌরব ও অহঙ্কারের। আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। তবে এর সঙ্গে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা যেগুলো বাংলাদেশ এতদিন ধরে ভোগ করেছিল সেগুলো হারাবে। দ্বিতীয়ত, ফার্মাসিটিক্যাল সেক্টরে যে সুবিধা পেয়েছে সে সুবিধাও হারাবে বাংলাদেশ। তৃতীয়ত- শিল্প, প্রণোদনা, বিনিয়োগ, শুল্ক, ভর্তুকির ক্ষেত্রে আমরা সুবিধামতো আইন করতে পেরেছি, তখন বেশ কিছু জায়গায় নতুন করে এডজাস্ট করতে হবে। তবে ৫ বছর সময় আমাদের হাতে আছে। এর মধ্যে প্রতিযোগিতা, পণ্যবৈচিত্র্য, সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাঁচ বছরকে প্রস্তুতির কাজে লাগাতে হবে তাহলে সুফল অর্জন সম্ভব। অন্যদিকে প্রস্তুতি পর্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ও সুফল ভোগ করা হবে- এমন মন্তব্য সরকারপক্ষের। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বিশ্বে নতুন মর্যাদায় আসীন বাংলাদেশ। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য শিল্প কারখানা তৈরি এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমবে। বাড়বে নিজস্ব কাঁচামাল তৈরি। অন্যদিকে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর ভিত্তি রচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর ভর করেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App