×

মুক্তচিন্তা

শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন জটিল কাজ তবে বেশ আনন্দের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৩৯ পিএম

শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন জটিল কাজ তবে বেশ আনন্দের

শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন একটি আর্ট, একটি বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান। এতে একজন শিক্ষকের আগ্রহ থাকতে হবে। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, প্রতিটি কাজে ও বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীর আচরণসহ অন্যান্য পারিপাশি্বর্ক দিকে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের কাজ। এটি জটিল, কঠিন কিন্তু অনেক আনন্দের। যেমন আনন্দের বাগানের চারাগাছগুলোর যতœ নেয়া এবং সেগুলোর মধ্যে প্রতিটি প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে ও মাসে কী ধরনের পরিবর্তিত হচ্ছে, কখন কীভাবে ফুল ধরছে, ফল ধরছে তা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা যেমন আনন্দের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সেভাবে দেখাও আনন্দের। এই আনন্দ একজন শিক্ষককে বের করে নিতে হবে। বিষয়টি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে নেই, তবে কিছু কিছু এরিয়াতে আছে সেটি তেমন কার্যকরী নয় এবং খুব আনন্দের সংবাদও নেই সেখানে। তবে পরিবর্তিত কারিকুলামে সেটিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে সংযোজন করা হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। আর দশম শ্রেণিতেও ৫০ শতাংশ রাখা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকরা কতটা নিরপেক্ষভাবে এই মূল্যায়ন করবেন। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে এবং কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। এটি বাস্তবায়ন করা হলে চমৎকার একটি বিষয় হবে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে কারণ আমাদের শিশুদেরও পরীক্ষার্থী বানানো হয়েছে, তাদের ফেলে দেয়া হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে। এতে তাদের শারীরিক, মানসিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিন্তু অভিভাবক ও সমাজ যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাই এ বিষয়টি চালু হলে বেঁচে যাবে আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছেÑ কারা এটি বাস্তবায়ন করবেন? কীভাবে করবেন? চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশে ৩০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। এটি একটি কার্যকরী উদ্যোগ প্রতিটি শ্রেণিতেই ফরমেটিভ অ্যাসেসমন্টে বা অবিরত মূল্যায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে। একজন শিক্ষক যিনি শ্রেণিকক্ষে তার শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, তার হাতেই থাকতে হবে প্রকৃত মূল্যায়ন। এটির বিকল্প খুব কমই আছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে, যেভাবে এবং যে পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয় বা তারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন সেগুলো বিবেচনায় নিলে এ ধরনের মূল্যায়ন করা কত শতাংশ শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হবে? সুইডিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রেডিং মূলত তিন প্রকার। ফেল, পাস এবং পাস উইথ ডিস্টিংশন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ, বি, সি, ডি এবং এফÑ এই ছয় ভাগে গ্রেডিং করা হয়। তবে বি এবং ডি গ্রেডকে বলা হয় ফিলিং গ্রেড। পরীক্ষা হয় ২০ পয়েন্টের ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুরা অপশনাল বিষয়সহ মোট ১৭টি বিষয়ে সর্বোচ্চ ৩৪০ নম্বর অর্জন করতে পারে। শিশুদের তৃতীয়, ষষ্ঠ এবং নবম শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া হয়। সব শিশুকে সমানভাবে মূল্যায়ন করাই এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। তবে ষষ্ঠ শ্রেণির আগ পর্যন্ত শিশুদের গ্রেডিং করা হয় না। তৃতীয় শ্রেণিতে শুধু গণিত ও সুইডিশ ভাষার ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়। অন্যদিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে গণিত সুইডিশ ভাষা এবং ইংরেজির ওপর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। পাশাপাশি নবম শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা মধ্য থেকে যে কোনো একটি এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় থেকে একটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। ভিন্নধর্মী অথচ বাস্তব এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার জন্য শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত করতে হবে। বহু দেশে বিষয়টি চালু আছে, তবে আমরা চালু করতে বিলম্ব করে ফেলেছি। অনেক শিক্ষক এটিকে পছন্দ করছেন কিন্তু একবারে এত নম্বর শিক্ষকদের হাতে না রেখে এটিকে ধীরে ধীরে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। প্রধান শিক্ষকরা বলছেন শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা যাতে জিম্মি না হয় সে জন্য কোচিং বন্ধ করার জন্য নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। প্রাইভেট পড়লে শ্রেণিকক্ষে তার সঙ্গে ভালোভাবে শিক্ষকরা কথা বলেন, আচরণ করেন, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পান। না পড়লে ঘটে উল্টোটা। পরীক্ষা নেয়া হলে খাতায় রেকর্ড থাকে আর শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন সব সময় কাগজে-কলমে থাকবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন কায়দার। কোথাও শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে উপচে পড়ছে, শ্রেণিক্ষক ঠাঁই দিতে পারছে না আবার কোথাও শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। যারা শিক্ষার্থী পাচ্ছে না তারা শিক্ষার্থী ধরে রাখার জন্য এবং শিক্ষার্থী কম থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে। কিন্তু যেখানে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে শিক্ষক কীভাবে তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে জানবে। ব্যক্তিগতভাবে না চিনলে তো তাদের মূল্যায়ন করতে পারবেন না। সেখানে সৃষ্টি হবে এক বিরাট বৈষম্য। কোনো বিদ্যালয়ের লাস্ট বয় যে নম্বর পাবে, প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের কোনো অলরাউন্ডার শিক্ষার্থীও তো সেই নম্বরের অনেক পেছনে থাকবে। সেখানে এক বৈষম্যের সৃষ্টি হবে, হবে না প্রকৃত মূল্যায়ন। এর আরকেটি সমস্যা হচ্ছে যেসব শিক্ষার্থী অন্তর্মুখী বা ইনট্রোভার্ট টাইপের তাদের সমস্যা হবে অনেক। কারণ তারা সৃষ্টিশীল, তবে তাদের সৃষ্টি প্রচার করার মতো বা কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তারা কোনো ধরনের প্রচার বা কার্যক্রম করবে না, ফলে তারা মার খেয়ে যাবে বেশি। এখানে শিক্ষকদের বড় ভ‚মিকা পালন করতে হবে অর্থাৎ একজন শিক্ষকের পরিচালিত শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা কোন চরিত্রের সেটির দিকে বিশেষ দৃষ্টি হবে। যারা ইনট্রোভার্ট তাদের সৃজনশীলতাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে কারণ তারা প্রকাশ করবে না। তারা যাতে প্রকাশ করে শিক্ষককে সেই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিছু শিক্ষকের ব্যক্তিগত আক্রোশ কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষার্থী মূল্যায়নে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। এ ঘটনা তো আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অহরহ দেখতে পাই। তারা যদিও জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করেন অথচ ব্যক্তিগত সীমাটুকু অতিক্রম করতে পারেন না অনেকেই। প্রকৃত অর্থেই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগ অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হন কারণ তিনি হয়তো একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই পূরণ করতে পারেননি, ফলে তার প্রতি শিক্ষকরা খুশি নন, যার প্রতিফলন দেখা যায় একাডেমিক ফলাফলে। এ ধরনের ঘটনা বিশ^বিদ্যালয়ে অহরহ ঘটতে থাকে। এই যখন বিশ^বিদ্যালয়ের অবস্থা তখন উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের কী হবে? কতটা পারবেন তারা প্রকৃত মূল্যায়ন করতে? শিক্ষকদের কোচিং নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? এর মাধ্যমে কিছু সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাখে। যেসব শিক্ষার্থী এসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন, তাদের খোঁজখবর নেন। তারা সহজেই বেশি বেশি নম্বর পেয়ে যায়। ফলে এই মূল্যায়ন শিক্ষকের ব্যক্তি চিন্তার ওপর নির্ভর করবে। এগুলো হচ্ছেÑ এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার পটেনশিয়াল বাধা। তবে এসব কারণে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নকে তো আমরা বাদ দিতে পারি না বা দেয়া ঠিকও হবে না। কী করা যায় এ জন্য? পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পায় তা হচ্ছেÑ কে কতটা তথ্য মুখস্থ করতে পারছে তার এক ধরনের প্রতিযোগিতা। কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের আত্মস্থ করতে হয় তার মানে এই নয় যে, পুরো একটি বিষয় কোন উৎস থেকে নিয়ে মুখস্থ করে সেটি পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেয়া। কিন্তু এখানে দেখতে হবে শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলি ও মূল্যবোধ অর্জিত হয়েছে কিনা। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু কাগজ-কলম নির্ভর মূল্যায়ন নয়। এখানে রাখতে হবে পর্যবেক্ষণ, পোর্টফলিও, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন, টেকনোলজির ব্যবহার। এগুলোর যথাযথ রেকর্ড রাখতে হবে। সে জন্য প্রথমেই বলেছি বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন, তবে আনন্দেরও যদি শিক্ষক সেই আনন্দটুকু ভোগ করতে চান।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App