×

পুরনো খবর

সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ, ভেতরে ও বাইরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৫০ পিএম

ভাষা বাদ দিয়ে ধর্মের সাহায্যে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা যে কতটা দুর্বল এবং সেই সঙ্গে ক্ষতিকর হতে বাধ্য তার প্রমাণ এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা রয়েছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে, খণ্ডিত অংশের একটি ইতোমধ্যে দুই টুকরো হয়েছে, আরো ভাঙবে এবং বড় অংশ ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাইবে না, থাকতে পারবেও না। কারণ ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাওয়া হয়েছিল ধর্মের দড়ি দিয়ে বেঁধে; ঐক্যবদ্ধ রাখা উচিত ছিল ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে সমস্বার্থের বিনাসুতোর মালায় গেঁথে, একটি সর্বভারতীয় প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।

সংস্কৃতি শত্রু এবং মানুষের শত্রু অভিন্ন; তারা ভেতরে থাকে, যেমন থাকে বাইরে এবং কাজ করে যোগসাজশে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান শত্রু দুটি; ভেতরে শ্রেণি, বাইরে সাম্রাজ্যবাদ। শ্রেণিকে যে শত্রু বলছি তার কারণ একটি নয়, দুটি। একটি নিহিত এই সত্যে যে, সমাজের শ্রেণি-বিভাজন বাঙালিকে পাশাপাশি রেখেও এক হতে দেয়নি, যার ফলে বাঙালির সংস্কৃতি একটি ঐক্যবদ্ধ রূপ গ্রহণ করতে পারেনি, খাদ রয়ে গেছে এখানে সেখানে, ভদ্রলোকেরা আলাদা হয়ে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষ থেকে, সংস্কৃতির প্রবহমানতা ও প্রাণবন্ততা খর্ব হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটিও ওই বিভাজনের সঙ্গেই যুক্ত, সেটি হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য। এখানে একটি মস্ত বড় বক্রাঘাত রয়েছে, কেননা মধ্যবিত্তই বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান মুখপাত্র, এমনকি পরিচালকও। এই শ্রেণি একাধারে বাঙালি সংস্কৃতির শত্রু এবং মিত্র, যে মিত্র সে-ই আবার শত্রু। ওদিকে সাম্রাজ্যবাদ কোনো অবস্থাতেই সংস্কৃতির মিত্র হতে পারে না। বাঙালি সংস্কৃতির সে মিত্র ছিল না, হবেও না। আধুনিককালের সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তার নিচে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও আদর্শ। পুঁজিবাদের অবদান আছে, সামন্তবাদের গ্রাম্যতা সে ভেঙে দেয়, মানুষকে সে নিয়ে যায় বড় একটি বিশ্বে, কিন্তু সে আবার শ্রেণি-বিভাজনকে পুষ্ট করে যে বিভাজনকে আমরা সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে চিহ্নিত করেছি। তা ছাড়া পুঁজিবাদ মুনাফা বোঝে, মনুষ্যত্ব বোঝে না। সবকিছুকে সে পরিণত করতে চায় পণ্যে; সবকিছুরই দাম জানে, কিন্তু কোনো কিছুরই মূল্য জানতে চায় না। টাকা চেনে, আর কিছু চেনে না, মানুষের কাজকে যে সম্মান দেবে সেই রুচি তার নেই। এই অর্থনৈতিক বিন্যাস সমাজকে বিভক্ত করে, সবলকে সাহায্য করে দুর্বলের ওপর অত্যাচার করতে। শত্রু থাকলে মিত্রও থাকবে, এ সত্য যেমন যৌক্তিক তেমনি বাস্তবিক। বাঙালি সংস্কৃতির মিত্র কে? মিত্র হচ্ছে বাঙালির ঐক্য, তার সংগ্রামশীলতা, যার মধ্যে রয়েছে তার শ্রম ও সৃষ্টি এবং তার অসাম্প্রদায়িক ইহজাগতিকতা। সাম্রাজ্যবাদের শত্রুতার বিরুদ্ধে বাঙালির মিত্র হচ্ছে দেশের ভেতরে এবং বাইরে সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে তথা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পক্ষে সংগ্রামের প্রবহমান ধারা ও ঐতিহ্য। সেই সঙ্গে আমাদের মিত্র হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক ও সাধারণ উত্তরাধিকার। দুই. সংস্কৃতির জন্য মানবিক ঐক্যটা বড়ই প্রয়োজন। সভ্যতা যতটা বাইরের ব্যাপার সংস্কৃতি ততটাই ভেতরের; সভ্যতা কেউ একা গড়ে না, সংস্কৃতিও তাই, সংস্কৃতি ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় গড়ে ওঠে এবং মানুষকে সে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চায়, না পারলে বিপন্ন বোধ করে, নদী যেমন বিপদে পড়ে প্রবাহপথে হঠাৎ বাঁধের দেখা পেলে। বাঙালির জন্য দেশভাগ যেমন একটি ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর ঘটনা ছিল, শ্রেণি-বিভাজন তার চেয়ে কম ক্ষতিকর ব্যাপার নয়, যদিও এই ক্ষতিটা বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। পূর্ববঙ্গের বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। সেই যুদ্ধের আগের ঘটনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। একাত্তরের ঐক্যটাকে আমরা যে ধরে রাখতে পারিনি সে ওই শ্রেণি-বিভাগের কারণেই। ঘটনা হিসেবে একাত্তর অনেক বড় বায়ান্নর তুলনায়, কিন্তু বায়ান্নই জন্ম দিয়েছে একাত্তরের এবং যে বাঙালি সাতচল্লিশে বিভক্ত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার কারণে, সেই বাঙালিদের বড় অংশটি আবার বায়ান্নতে এসে ঐক্যবদ্ধ হলো ওই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করে। ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আসলেই অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। কেননা ওই ঐক্যে ছিল সৃজনশীলতা এবং ছিল সাংস্কৃতিক বিকাশের ওই যে দানবীয় শত্রু, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ, সেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। একুশে ফেব্রুয়ারি যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তার কারণ বাংলা ভাষার প্রতি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় হঠাৎ-জেগে ওঠা কোনো প্রীতি নয়, কারণ হচ্ছে ওই দিনের আন্দোলনে যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ছিল তার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নেয়া। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব এখন দম্ভ ভরে বলে যে সে একটাই, সে পুঁজিবাদী। সে পৌঁছে গেছে তার স্বর্গে। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, পৃথিবীজুড়ে জাতিসত্তাগুলোর সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য ছিন্ন করে মাতৃভাষার চর্চার আগ্রহ সেই সত্যাটিকেই জানিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় ঐক্যের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য, অকৃত্রিম ও সংস্কৃতিবান অবলম্বন হচ্ছে ভাষা। মানুষ অনেক কিছু বদলায়, এমনকি ধর্মও ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু ভাষা ত্যাগ করাটা তার পক্ষে কঠিন হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো উচ্চ মনীষাসম্পন্ন মানুষও সে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। ভাষা বাদ দিয়ে ধর্মের সাহায্যে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা যে কতটা দুর্বল এবং সেই সঙ্গে ক্ষতিকর হতে বাধ্য তার প্রমাণ এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা রয়েছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে, খণ্ডিত অংশের একটি ইতোমধ্যে দুই টুকরো হয়েছে, আরো ভাঙবে এবং বড় অংশ ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাইবে না, থাকতে পারবেও না। কারণ ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাওয়া হয়েছিল ধর্মের দড়ি দিয়ে বেঁধে; ঐক্যবদ্ধ রাখা উচিত ছিল ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে সমস্বার্থের বিনাসুতোর মালায় গেঁথে, একটি সর্বভারতীয় প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। ইউরোপে আজ ওইরকমের ঘটনা ঘটছে, সেখানে জাতি একটা নয়, অনেক ক’টি এবং সেই জাতিগত আত্মপরিচয়ের প্রধান ভিত্তিটা হচ্ছে ভাষা, জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র থেকেও তারা একটি অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক অভিন্ন ব্যবস্থার ভেতর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ভাষার ঐক্য গণতান্ত্রিক তো বটেই, তার আকাক্সক্ষাটাকে সমাজতান্ত্রিকও বলা যাবে। কেননা ভাষা শ্রেণি মানতে চায় না, সম্প্রদায় তো মানেই না। ভাষা আধিপত্যবিরোধী। যে ভাষা অন্য ভাষার আধিপত্য মেনে নেয় সে বিকশিত হতে পারে না, উপভাষায় পরিণত হয়। বাংলা ভাষার ওপর সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটা নতুন নয়, ওই কাজ সংস্কৃতি ও ফার্সি ভাষা করেছে, করেছে ইংরেজি ভাষা, করতে চেয়েছিল উর্দু ভাষা। এদের মধ্যে সবচেয়ে স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি ভাষার সংস্রবে এসে বাংলা ভাষার উপকার হয়েছে, কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু সে উপকার ভাষার কারণে ততটা নয় যতটা ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে লব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কারণে। পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যতটা বিস্তৃত ও শক্তিশালী ছিল ততটা অন্য কেউ ছিল না। সমুদ্রে অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে সে কিছুটা কোণঠাসা করেছে, নানা দেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে দিয়ে গিয়ে স্বদেশে শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে এবং পৃথিবীর নানা জায়গায় বাজার নিয়েছে দখল করে। ব্রিটেন মহাদেশ নয়, দ্বীপ বটে, সমুদ্র তার জন্য খুব জরুরি ছিল, সমুদ্রে যাতায়াত তাকে দুঃসাহসী করেছে; আবার দ্বীপ যেহেতু তাই একই সঙ্গে ব্রিটেনবাসী আবার রক্ষণশীলও বটে। এই রক্ষণশীলতার কারণে ওরা বড়জোর উদারনীতিক হয়েছে, কিন্তু কখনোই মৌলপরিবর্তনকামী হয়নি, ক্রমওয়েলের সময়ে একবার শুধু রাষ্ট্রবিপ্লব করতে চেয়েছিল, কিন্তু করতে গিয়ে এমনই ভয় পেয়েছে যে, তারপর থেকে ক্রমাগত চেষ্টা করেছে ছাড় দিয়ে হলেও বিপ্লবকে প্রতিহত করতে। একদিকে আত্মরক্ষা, অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়া, নিজস্ব সংস্কৃতির এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলায় এসে ইংরেজ যা করল তা হলো সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে স্থায়ীকরণ। এর জন্য চালাক-চতুর পদক্ষেপ নিতে তারা কসুর করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, আইন-আদালত, থানা পুলিশ রেলওয়ে টেলিগ্রাফ কিছু বাদ রাখেনি। কিন্তু সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করা। ক্লাইভ যা করেছিল তা স্থায়ী হতো না, ইংরেজরা যদি না মেকওলে-সংজ্ঞায়িত ওই শ্রেণিটিকে প্রশাসন তো বটে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারত। এই শ্রেণি মেরুদণ্ডহীন ও পরগাছা হবে, জনগণের সঙ্গে এর বিচ্ছিন্নতা ঘটবে, এবং এর সাহায্যে ইংরেজরা দেশ শাসন করবে- এটাই ছিল আশা। তেমনটা যে ঘটেনি তাও নয়। ইংরেজ ধর্ম প্রচারকরা ধর্ম দিয়েও আনুগত্য সৃষ্টি করবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু সেটা ততটা কার্যকর হয়নি যতটা হয়েছে ইংরেজি ভাষার বন্ধন। সেই বন্ধন আমরা এখনো ছিন্ন করতে পারিনি, না-পারার পেছনে কারণ অবশ্য এটি যে, ইংরেজি ইতোমধ্যে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাষ্ট্রভাষাতে পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় কাজ মধ্যবিত্ত করেছে। বাঙালির সংস্কৃতি বলে যা পরিচিত তা মূলত এই শ্রেণিরই সংস্কৃতি। কিন্তু এই শ্রেণি সমগ্র জনগণকে তার সঙ্গে নেয়নি। স্বাধীনতার স্পৃহা তার ভেতরে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে, কিন্তু সে ভয় পেয়েছে সাম্যকে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার দ্ব›দ্বও ছিল অনিবার্য, সেটা ঘটেছে; কিন্তু সেখানেও শ্রেণিগত মনোভাবটা ছিল আপসের। শত্রু ছিল ইংরেজ, কিন্তু তাকে কিছুটা স্বার্থের কিছুটা ভয়ের কারণে স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করা হয়নি। মধ্যবিত্ত প্রথমে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত, পরে রঙ্গমঞ্চে মুসলমান মধ্যবিত্তের যখন আগমন ঘটল তখন চাকরি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দুয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রূপ নিল সাম্প্রদায়িকতার। শাসক ইংরেজ এই সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহিত করেছে। ফলে দেশ গেছে ভাগ হয়ে। বাঙালির পক্ষে দেশভাগ একটি অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে তোলার ব্যাপারে ব্যর্থতারই স্মারকচিহ্ন। বাঙালি মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ওই আদর্শের সব গ্লানি নিজের মধ্যে ধারণ না করে পারেনি। মধ্যবিত্ত বাঙালি যে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক কাজ করেছে সেটা শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে নয়, শ্রেণিকে অভিক্রম করে গিয়ে তবেই। ওই রকমের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। ফ্রান্সিস বেকন তার সময়ে অভিজাত শ্রেণির সদস্য ছিলেন, সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্তদের পক্ষে বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে ঘুষ নেয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না, বেকন উভয় দোষে দুষ্ট ছিলেন; কিন্তু তিনিই আবার জ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টির কাজে অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি এই মতও জোর দিয়ে প্রচার করেছেন যে, ব্যক্তি জীবনের চরিতার্থতা স্বার্থপরতায় নিহিত নেই, নিহিত রয়েছে সমষ্টিগত অগ্রগতিতে ভ‚মিকা রাখায়। আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই মানুষ, কিন্তু তারা সেই শ্রেণির সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে মানেননি বলেই বড় স্রষ্ট হতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার পরিবারে জন্মেছেন ঠিকই, তবে রুচি ও আকাক্সক্ষায় মধ্যবিত্তই ছিলেন। কিন্তু ওই সীমার মধ্যে আটক থাকেননি। মধ্যবিত্ত-কবলিত কলকাতায় তিনি হাঁপিয়ে উঠতেন, চলে যেতেন গ্রামে, যেতেন বিদেশেও। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তার ধারণা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তর্জাতিকতা ছিল, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কবি বন্ধু ডবিøউবি ইয়েটস তার কবিতায় মধ্যবিত্তকে দেখতে পাননি, দেখতে পেয়েছেন অভিজাতের সঙ্গে কৃষক-গরিবের ঐক্য। এই দেখাটা পুরোপুরি সত্য নয় ঠিকই, তবে এটা অত্যন্ত সত্য যে রবীন্দ্রনাথ সব বাঙালিকে এক করতে চেয়েছিলেন। শরৎচন্দ্রের সংবেদনশীল হৃদয় ক্রন্দন করেছে পীড়িত বাঙালির দুঃখে। এবং তিনি অত্যন্ত স্পষ্টরূপেই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধী। নজরুল অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মধ্যবিত্ত থাকতে; সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি কারাগারে গেছেন, তার বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ পশ্চিমকে জানতেন, সেখান থেকে ভালো যা তাকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু পুঁজিবাদকে কখনোই মেনে নেননি; ট্রামের নিচের তার জীবনাবসান ওই প্রত্যাখ্যানের দ্যোতনার কারণে অত বেশি মর্মস্পর্শী। মধুসূদনের শ্রেণি তাকে বলেছিল সাহেব হতে ব্যক্তিমনীষা সেই প্ররোচনা গ্রহণ করেনি বলেই তিনি অত্যন্ত বড়মাপের লেখক হয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসকামী ও পুঁজিবাদের ভক্ত, জনবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাঙালি সংস্কৃতির সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক বটে, অনেকাংশে স্রষ্টাও, কিন্তু বাঙালির জন্য সে ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতির গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল তার মিত্রশক্তি নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App