×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৫৫ পিএম

পারমিতার জগৎ

কিছুটা আস্থাসহ নাজনীন বললো, “সবচেয়ে দুঃখজনক, সুমন ভাই তোমার সম্পর্কেও আপত্তিকর কিছু কথা বলেছে, যা আমার ভালো লাগেনি।” আগ্রহ নিয়ে বললাম, “তাই না-কি? আমার সম্পর্কেও কথা বলেছে? কী সম্পর্ক আমার তার সাথে? কী অধিকার তার আমার সম্পর্কে কথা বলার? সামান্য শিষ্টাচারবোধ থাকলে সম্পর্কহীন একজন মেয়ের সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলতে পারতেন না!” নাজনীন এবার সহজ হলো, “তুমি না-কি মেডিকেল কলেজে প্রকাশ্যে ছেলেদের চুমু দিয়ে বেড়াও?” আমার হাসি পেলো। আমার হাসিতে অবাক নাজনীন, “তুমি হাসছো?” আবার হাসলাম, “না হেসে কী করবো বল, মানুষ যখন কাÐজ্ঞানহীন হয়, যখন উন্মাদের মত কথা বলে, হাসতেই হয় তখন। সেবাই যখন আমাদের ব্রত, সেখানে কারো নাক গলানোটা কখনোই কাম্য নয়। তোমার সুমন ভাই যখন কুরুচির পরিচয় দেন, তখন তাকে ছাড় দেয়া যায় না; আমিও তাকে ছাড়বো না!” আমরা নৌকা আবার ভাটির ¯্রােতে ঘোরাতে বললাম। মাথায় জেদ চেপে গেলো আমার। সুমন কতো বড় নেতা, কতটা ক্ষমতাধর জানতে হবে। রাজনীতি সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না কোনো কালেই; স্কুলে তো নয়ই, কলেজে বা মেডিকেলে ভর্তি হবার পরও কোন ধরনের ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হইনি কখনো। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই জামালপুরের রাজনীতির খোঁজ নিতে চেষ্টা করলাম; আর বিস্ময়কর ভাবে সামনে এলো সুমনদের পার্টির যিনি সভাপতি তিনি আমার মনিমামা, মা’র আপন মামাতো ভাই। একসময় আমাদের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিলো তাঁর, স¤প্রতি খুব একটা দেখি না; বিশেষ করে তাঁর এই আদর্শিক পরিবর্তনটা আব্বা পছন্দই করতেন না, হয়তো তাই আব্বার সামনে সহজে পড়তে চাইতেন না; কিন্তু আমাদের তো খুবই স্নেহ করতেন। মামা বাম ঘরানার রাজনীতি করতেন। আমার যেটুকু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, তাতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে নিজের মতো করে বলতে পারি, বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমশ স্খলিতদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে। দক্ষিণপন্থীদের কথা বাদই দিলাম, বামেরাও চরম স্খলনে নিমজ্জমান। স্খলিত বামদের মধ্যে আবার তিনটি ঘরানা এখানে, একটি দুঃশ্চরিত্রবাম, একটি চরিত্রহীনবাম আর অন্যটি বুক ঘষেচলা বাম; আমার মামা ছিলেন চরিত্রহীন গোত্রের বাম; চরিত্রহীনেরা নতুন চরিত্রের সাথে একাত্ম হতে পারে কিছুটা, কিন্তু দুঃশ্চরিত্র যারা তারা যেখানেই যায় সেখানেই দুর্যোগ নামায়। চরিত্রহীন গোত্রের কেউ কেউ হালুয়ারুটির মোহে, কেউ আবার অস্তিত্ব-সংকটের ভয়ে সামরিকজান্তার ছাতার নিচে সমবেত হয়েছিলো ‘৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর। মনিমামা কোন চিন্তায় জেনারেল জিয়ার ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন জানি না। এই মামা ছিলেন আমার কাছে বাতিঘর, স্বপ্নমানুষ, বঞ্চিত মানুষের পক্ষে মামা এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতেন, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতাম, নিজেকে মনে মনে আমি সমর্পণও করেছিলাম বাম রাজনীতির পক্ষে। সেইসব আদর্শ মানুষেরা যখন স্বাধীনতা-বিরোধী মৌলবাদী চক্রের সাথে এক ছাতার নিচে সমবেত হয়, তখন আর ভরসা রাখা যায় না। নিজের অক্ষমতার অন্ধকারে কলঙ্কিত করতে চাই না রাজনীতিকে; রাজনীতিকদের স্খলিত বলে নিজেকে কী সান্তনা দেবো? আমি সাধারণ, সবার কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারি প্রয়োজনে। আর মনিমামা তো আমার স্বজন, একসময়ের স্বপ্নমানুষ। মামার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাই না নিজেকে, আমি বরং সুমনকে প্রতিহত করতে মামার সাহায্য চাই। সুমনের ঔদ্ধত্যের জবাব দিতে চাই। কাউকে কিছু না বলে পরদিন সকালে মামার বাসার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।

মনি-মামা বাসায়ই ছিলেন। আমি কলিংবেল চাপলে মামা নিজেই এসে দরোজা খুলে দিলেন। দরোজা খুলে সামনে আমাকে দেখে মামা কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়-চোখে তাকিয়ে থাকলেন। আমায় দেখে মামা যেনো বাকরুদ্ধ, হঠাৎ যেনো সম্বিৎ পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “কৈরে সবাই! কৈগো তুমি! দেখো কে এসেছে! কী সৌভাগ্য আমার সকালে বাসিমুখে মাকে দেখলাম আজ। জলদি টেবিল সাজাও! আমার মা’র সাথে নাশতা খাবো আজ!” মনি-মামার আগ্রহে আমিও কিছুটা দিশাহারা যেনো। জড়িয়ে ধরলাম মামাকে! মামা আমাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মামার চিৎকারে মামী এগিয়ে এলেন। মামার দুই ছেলে ইমরান আর ইভান এগিয়ে এলো। “উৎসব নিয়ে কে এলো গো আমাদের বাসায়? ও মা! এতো আমাদের পারমিতা! এসো মা এসো।” মামী আমায় টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে চললেন। ইমরান আর ইভান এগিয়ে এসে দু’জন আমার দু-হাত ধরলো। টেবিলে সবাই একসাথে বসলাম নাশতা খেতে। সবার আগ্রহে আমিও আহ্লাদিত। নাশতার টেবিলে বিচিত্র আহারের সমাবেশ। কোনটা রেখে কোনটা খাবো তাই ভাবছি, “আমি তো মামা তোমার কাছে আসবো বলে সকালে নাশতা না করেই বেরিয়েছি; কিন্তু এখন তো টেবিল দেখে মনে হচ্ছে, খেয়ে এলেই ভালো করতাম।” মামা বিস্ময়চোখে তাকালেন, “কেনো মা, টেবিলের কিছুই কি তোর পছন্দ নয়? তাইলে বল্ কী খাবি?” তাড়াতাড়ি উত্তর দিলাম, “না-না মামা, তা নয়; টেবিলে এতো খাবার, কোনটা রেখে কোনটা খাবো তা নিয়েই তো দুঃশ্চিন্তা। খেয়ে এলে তো এখন দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।” মামা হাসলেন আমার কথায়, অন্যরাও যোগ দিলো তার সাথে। নাশতা খেতে খেতেই মামা টেলিফোন করলেন কাউকে, “হ্যালো, লোকজন এসেছে?.....শানো, আমার আসতে একটু বিলম্ব হবে; আমার মা আসছে বাসায়। তোমরা কাজ চালাতে থাকো। আমি মা’র সাথে কথা বলে একটু পর আসছি।” নাশতা শেষ করে আমরা চা নিয়ে সোফায় বসলাম। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে মামা বললেন, “কী-রে মা তুই কি কোনো কাজে এসেছিস আমার কাছে, না-কি ছেলেকে দেখতে ইচ্ছে হলো হঠাৎ?” আমি কিছুটা রহস্য করে বললাম, “আমি দেখতে এলাম, আমার মামা তার দীর্ঘদিনের আদর্শ হারিয়ে কতটা ক্ষমতার অধিকারী হলো।” মামা আমার কথায় কিঞ্চিৎ ধাক্কা খেলেন, “আদর্শ হারিয়ে মানে কী?” অভ্যাসবশত মামার সাথে তর্ক শুরু করলাম, “আদর্শ হারিয়ে নয়? ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি তোমার নীতির কথা, তোমার কথা শুনেই শিখেছি, প্রতিটি সচেতন-শিক্ষিত মানুষের উচিত এ দেশের বঞ্চিত-অসহায় নিরণœ মানুষের পাশে দাঁড়ানো! তোমার কাছেই শিখেছি রবিঠাকুরের সেই বাণী ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেনো তারে তৃণসম দহে’!” মামা জোর করে মৃদু হাসলেন, “সে আদর্শ থেকে আমি আজও একচুল নড়িনি। জীবন হাতে নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি; কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা কী দেখলাম?” এবার মামার কথাতেই ধরলাম মামাকে, “আমিও তো তোমাকে সেই কথাই বলতে চাই; জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলে, আজ গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিতে চলেছো! শাহ আজিজকে গদিতে বসিয়েছো! একজন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রিকে দলের নেতা বানিয়েছো, যে আজ লাঠি ঘোরাতে চায় সবার মাথার উপর! আচ্ছা মামা, সুমন কি তোমার চেয়েও বড় নেতা? সে যা বলবে জামালপুরে কি তাই হবে? তুমিও কি তার আদেশ মানতে বাধ্য?” মামা যেনো পালাবার একটা পথ খুঁজে পেলেন, “কেনো কী হয়েছে? কী করেছে সুমন? তোর সাথে কিছু করেছে স্টুপিডটা?” আমি এ সুযোগটাই খুঁজছিলাম, “আমি তো মামুলি ব্যাপার তার কাছে; হয়তো তুমিও তাই!” মামা সামান্য উত্তেজিত, “কী হয়েছে খুলে বলতো মা?” মামার প্রশ্নের মধ্যে মামী আর ইমরান-ইভান এসে যোগ দিলো আমাদের সাথে। আমি বললাম, “ভাইয়ার জন্য একজন মেয়ে দেখেছিলাম আমলাপাড়ায়। আব্বা তোমার সাথে কথা বলেননি?” এবার মামী উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ তো, দুলাভাই এসেছিলেন বাসায়, আমি তোর মামাকে বলেছিলাম; উনি এখন বড় নেতা, ভাগ্নের মেয়ে দেখতে যাবার সময় হয়নি তার!” মনি-মামার চোখে অস্থিরতা, “সে-তো বুঝলাম, আমি যেতে পারিনি! মেয়ে কি পছন্দ হয়েছে?” বললাম, “মেয়ে তো পছন্দ হয়েছে। কথাবার্তাও সব ঠিক; বিয়ের তারিখও ঠিক হলো, এখন মেয়ের বাবা বলছেন, বিয়ে হবে না। কেনো? না, জামালপুরের মহামোড়ল সুমন সাহেবের আপত্তি। সুমন সাহেব না-কি মেয়ের কোন সম্পর্কীয় ভাই।”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App