×

সাময়িকী

আশালতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৩৬ পিএম

আশালতা

কাঁটাবন মোড়ে নামল সে। শাহবাগ, শিশু পার্কের পাশে অনেক ফুলের দোকান; সেখান থেকে কিনেছে একগুচ্ছ গোলাপ। সামান্য ফুল দেয়া ঠিক হবে না; যে প্রেমিক শুধু গোলাপ দেয় তার মতো নিষ্কর্মা এ জগতে আর নেই- এমনটাই মনে করে অভিক। অনেক দিন আগে একটা নাটকে দেখেছিল এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে একটি গোলাপ দেয়। গোলাপটি হাতে না নিয়ে প্রেমিকা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলেÑ শুধু গোলাপ! তারপর প্রেমিক বলেÑ না, বাড়ি, তোমার জন্য বাড়ি। দৃশ্যে আলিশান এক বাড়ি চলে আসে এবং বাড়িটি দেখে খুশিতে নেচে ওঠে প্রেমিকার চোখের মণি। প্রেমিকযুগল বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখেÑ আমাদের বেডরুম, ড্রয়িংরুম, দক্ষিণের জানালা, সবুজ বাগান, সুইমিংপুল, বাচ্চাদের খেলার মাঠ... আরও কী কী যেনÑ প্রেমিক যা কিছু উচ্চারণ করে সব এক এক করে পর্দায় ভেসে ওঠে। চোখ জুড়ান মনোরম সেসব দৃশ্য। শাহবাগ থেকে রিকশায় আসতে আসতে, শাহবাগ আর কাঁটাবনের মাঝখানে বইয়ের মার্কেট আজিজ সুপার মার্কেট পার হওয়ার সময় একবার অভিকের মনে হলো একটা বই দিলে কেমন হয়? কী বই হতে পারেÑ অনেকক্ষণ ধরে মনে করতে চাইল। ঘুরেফিরে একটা বইয়ের নামই মনে এলো, রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। বইটি সে কিশোর বয়সে এক তরুণীকে উপহার দিয়েছিল। তরুণীটির মুখ মনে করার চেষ্টা করে সে। এখনও মনে পড়ে প্রথম প্রেমের কথা। এখন সে কোথায়, কেমন আছে জানে না অভিক; জানার কথাও নয়। অভিকের বিয়ের সেই কত বছর আগে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। চলে গেছে অনেক দূরে; খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু অনেক দূরে। এখন মেয়েটিকে দেখলে হয়তো কেঁপে উঠবে না অভিক। মরে যেতে ইচ্ছে করবে না কোনো একজনের জন্য। মেয়েটির পথের ধুলো হতে ইচ্ছে করবে না, ধুলো হয়ে তার পায়ে পায়ে নিহত হওয়ার সাধ জাগবে না বুকের গভীরে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে পশু-পাখির মার্কেটের দিকে এগিয়ে যায় অভিক চৌধুরী। একটা একটা দোকান দেখছে আর ভাবছে কী নেয়া যায়, আবার ভাবছে এখানেই-বা কেন এলো? একেকটা দোকান যেন মিনি চিড়িয়াখানা। একটা বিড়াল পছন্দ হলো, না যেন আর কিছু ভেবে না পেয়ে একটা বিড়াল পছন্দ করল। বিড়ালটা বাঘের বাচ্চার মতো। অবশ্য বাঘের বাচ্চা অভিক কখনো দেখেনি। জিওগ্রাফি চ্যানেলেও না। তাহলে কী করে মনে হলো বাঘের বাচ্চার মতো! বাঘের বাচ্চা তো বিড়ালের মতোইÑ নিজেকে সে বোঝালÑকেমন সুন্দর নীল চোখ, নির্লিপ্ত দৃষ্টি। আর এমন কোমল যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। বাঘের বাচ্চা হয়তো বেশ কোমল হয়, আস্তে আস্তে ভয়ানক হয়ে ওঠে, হিংস্র হয়ে ওঠে; মানুষের এই পৃথিবীতে বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। যে কেউ এটাকে দেখলেই বুঝবে বিদেশি বিড়াল। আশালতা নিশ্চয়ই খুব পছন্দ করবে। শিহরিত হয়ে উঠে অভিক। তবে বিড়ালের দাম শুনে বিস্মিত হয়Ñ এত দাম দিয়ে একটা বিড়াল কিনবে! আশালতার যদি মনে না হয় যে বিদেশি বিড়াল, যদি মনে করে দেশি; মনটাই খারাপ হয়ে যায়। শেষে আরও দুইটা দোকান দেখে প্রায় একই দামে একটি খড়গোশ কিনে নেয়। রাস্তা পার হয়ে একটু পায়ে হেঁটে কাঁটাবন মোড় থেকে রিকশা নিল। পায়ের কাছে খাঁচাবন্দি খড়গোশটা রাখল। খাঁচার ভেতর চেয়ে দেখছে অভিক। নিজেকে প্রশ্ন করছেÑ কেমন হলো? আশালতার কোনো জন্মদিনে কেউ কি কখনো খড়গোশ উপহার দিয়েছে? খড়গোশ আশালতা কতটা পছন্দ করে? তবে ভাবনাটা অভিনবÑ এটা ভেবে পুলকিত হলো অভিক। এখন কথা হলো পছন্দ করবে তো? নাকি কারও উপহার, বিশেষ করে প্রিয়জন বা বিশেষ কারও দেয়া উপহার পছন্দ করতে হয় মনে করে পছন্দ করবে, পছন্দ করার ভান করবে। পছন্দ না হলেও কি পছন্দ করতে হয়? কবে থেকে উপহারের রীতি চালু হয়েছে, না পৃথিবীর প্রথম থেকেই ছিল? প্রথম কে কাকে উপহার দিয়েছিল, কী ছিল সেটা? তারপর থেকেই কি উপহার দেয়ার রীতি প্রচলন হয়, না আরও কিছুটা সময় লাগে? উপহার নিয়ে একটা গল্প আছে। বাসরঘরে স্বামী স্ত্রীকে কিছু একটা উপহার দিয়ে থাকে, এমন রেওয়াজই প্রচলিত। আগেকার দিনে সদ্য স্ত্রীর মন পরীক্ষা করার জন্য, শোনা যায়, মহান স্বামী পকেট থেকে উপহারটি বের করার আগে নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে চুপ করে বসে থাকা লাজুক বউটিকে জিজ্ঞেস করে কী চায় সে। কুইজের মতো এর তিনটি উত্তর : মহান স্বামীটিকে চায়, অথবা কিছু একটা চায় (সাধারণত স্বর্ণের আংটি), না হয় কিছুই চায় না। এখানে সঠিক উত্তর হলো স্বামীকে চাওয়া। আর কিছুই না-চাওয়া একেও অনেকটা সঠিক উত্তর হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, কারণ এই উত্তরের ভেতরে প্রচ্ছন্নভাবে স্বামীকে চাওয়ার আকাক্সক্ষা লুকিয়ে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়; এই উত্তর দিলে যদিও মেয়েটি কম নম্বর পায়, তবে পাস করে। আর যদি ফেল করে, অর্থাৎ যদি কিছু একটা চায়, হাজার টাকার গয়না কিংবা দুই টাকার চকলেট; তাহলেই মেয়েটির কপাল পুড়ল। এখানে ধরা যাক মেয়েটি একটি চকলেট চেয়েছে; একসময় তো ছোট ছোট মেয়েদের বিয়ে হতো, যখন তারা পুতুলের বিয়ে দিত তখন নিজেদেরও বিয়ে হয়ে যেত। তো, চকলেট চাওয়ামাত্র সাত রাজার ধন স্বামীটি তাকে একটি চকলেট দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিত। আর কিছুদিনের মধ্যেই কিশোরী মেয়েটির কাছে চলে যেত তালাকনামা। মুঠোফোন বেজে ওঠে। অভিক রিসিভ করলÑ আসছি আমি, অন দ্য ওয়ে। Ñএটুকু বলেই রেখে দিল এবং রিকশাঅলাকে দ্রæত যেতে বলল। এ সময় একটি কথা মনে পড়ল এবং মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশি দিন আগের কথা নয়, সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে দুজনের কথা বলাই বন্ধ ছিল। মেয়েটা এমনÑ দুদিন পর পর ব্রেকাপ করে, আবার ফিরে আসে। এই নিয়ে অভিক মাঝে মাঝে এতই বিরক্ত হয় যে, নিজেই আশালতাকে ছেড়ে দেবে ভেবে মানসিক প্রস্তুতি নেয়। কয়েকবার সে আশালতাকে বলেও দিয়েছে। একবার তো মনে হয়েছিল এবার বুঝি ছাড়াছাড়ি হয়েই গেল। এখন থেকে নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে মুক্ত বাতাসে, উড়ে বেড়ান যাবে আকাশে আকাশে। কিন্তু মুক্ত বাতাসের দেখা দুজনের কেউই পায় না, না আকাশে ওড়ার সাধ। না পারছে সে আশালতাকে ছেড়ে দিতে, না পারছে আশালতা। কিসের মোহে তারা আটকে আছে; প্রেম, নাকি শুধু শরীর? একবার মনে হয় প্রেম, একবার মনে হয় শুধুই শরীর, একবার মনে হয় দুটোই। আবার মনে হয় এ হয়তো এক নেশা, আগুন। কার যেন কবিতা আছে না, প্রেমকে বলা হয়েছেÑ এ তো সেই আগুন, যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না। বছর দুই হলো সম্পর্কের। প্রথম দিককার কথা, তখন আশালতার ফোন এলেই কেমন যেন হয়ে যেত অভিক চৌধুরী। মুঠোফোনের রিং বাজার সাথে সাথেই একটু কেশে নিতো, গলায় ঘা হয়েছে যেন, পরিষ্কার করে নিতো গলা, তারপর রিসিভ করতো। হিসাব করে কথা বলতো। অফিসের বসের সঙ্গেও এতো সতর্ক হয়ে কথা বলতো না। অফিসে যাকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না, তার সাথেও ভাব জমাতে লাগলো। কারণ, আশালতা একদিন হঠাৎ না বলেই অফিসে চলে এসেছে, তখন মনে হয়েছে লোকটা বসের কাছে প্যাঁচ লাগাতে পারে, তা ছাড়া সে সময় অফিসেও প্রায়ই মুঠোফোনে দীর্ঘ সময় কথা হতো আশালতার সঙ্গে। কোনো সময় আশালতাকে ফোনে না পেলে, যতক্ষণ না পাওয়া যেতে ততক্ষণ সে খুবই অস্থির হয়ে উঠতো। আশালতা দেখতে পরীর মতো নয়, কিন্তু তাকে পরী বলে মনে হতো; এখন কিছুই মনে হয় না। আশালতার কানের লতিতে কামড় দিলে সাড়া শরীরে বিদ্যুতের শক খেত; এখন কিছুই হয় না। মুঠোফোনে আশালতার নামটা ভেসে উঠলে আনন্দে আঁতকে উঠত; এখন চোখেমুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে অথবা কিছুই মনে হয় না। দেখা গেল অফিসে অনেক কাজ, ব্যস্ত আছে সে; মুঠোফোন বেজে উঠল আর আশালতার নামটা দেখেই সাইলেন্ট করে রাখল। আগেও অফিসে তার অনেক ব্যস্ততা ছিল, কিন্তু আশালতার ফোন এলেই প্রেমে মুষড়ে পড়ত অভিক। আশালতা আজ কী ড্রেস পরে আসতে পারে! গত রাতে কথা হয়েছে শাড়ি পরে আসবে। শাড়ির কালারও বলেছে। মেয়েদের পোশাকের মধ্যে সাদা হলো আবেদনময়ী কালার। সাদা বা কোনো কালার নিয়ে এখন ভাবছে না অভিক। এখন সে ভাবছে খড়গোশটা পেয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে আশালতার। আশালতা নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে। খড়গোশের দাম সম্পর্কে আশালতার কোনো ধারণা আছে? সে কি বুঝবে এতো দাম দিয়ে তার জন্য একটা খড়গোশ কেনা হয়েছে। সে কি দাম জিজ্ঞাসা করবে? দাম জিজ্ঞেস না করলে কি বলা ঠিক হবে? না, সেটা নিশ্চয়ই শোভনীয় হবে না। খড়গোশের গায়েও তো কোথাও দাম লেখা নেই। কিন্তু দামটা তো তাকে জানাতে হবে, না হয় এতো দামের জিনিসটাই যে বৃথা। স্টার কাবাবের বেয়ারা কি জানতে চাইতে পারে কতো টাকায় খড়গোশটা কেনা হয়েছে। তাহলেও তো জেনে যেত আশালতা। বেয়ারারা কি এসব জানতে চায়? জানতে চাইতে পারেÑ মানুষের তো কতো কৌত‚হল থাকে!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App