×

সাময়িকী

বাংলাদেশের উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত ধারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৪৭ পিএম

বাংলাদেশের উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত ধারা

(গত সংখ্যার পর) আবার কখনো বঞ্চনা থেকে মুক্তির আবশ্যকতা (বাঘবন্দি-২০০৪)’র কথা তুলে এনেছেন তিনি তার সাহিত্য ভাণ্ডারে। লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন নিয়ে ‘প্রাচীন নগরীর যাত্রা’। ব্রাত্যমানুষের যাপিত জীবন, দ্রোহ, আর বাঙালি জাতি গঠনের সংগ্রামী ঐতিহ্যচেতনা ও ভাষার বিকাশই তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। শওকত আলী ষাটের শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। উদ্বাস্তু, দেশান্তর, নারীর অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, উত্তরবঙ্গের জীবনযাত্রা তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। বাঙালির জাতিতাত্তি¡ক ঐতিহ্য নিয়ে তার শক্তিশালী কাজ প্রদোষে প্রাকৃতজন। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের আন্তঃদ্ব›েদ্বর আবর্তে অতীত উন্মোচনের মধ্য দিয়ে জাতিসত্তার অন্বেষণ করেছেন এ উপন্যাসে। ইতিহাস-ভ‚গোল-নৃতত্ত¡ আর সাহিত্যের নন্দনতাত্তি¡ক বোধ মিলে রচিত তার এ উপন্যাস বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কাজ। তার তিন খণ্ডের দীর্ঘ ত্রয়ী উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন-এ ষাট ও সত্তর দশকে নারীর নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে বহুমাত্রিক বিষয় ধৃত হয়েছে। তার উপন্যাসের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে দেশভাগ। যাপিত জীবন, গায়ত্রী সন্ধ্যাÑ এ জাতীয় লেখা। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য বা পুরাণ প্রসঙ্গের বিনির্মাণ করেছেন তিনি উপন্যাসে। চর্যাপদ নিয়ে রচিত হয়েছে এ ধরনের উপন্যাস। চাঁদবেনে, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, কাঁটাতারে প্রজাপতি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে রচিত উপন্যাস। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব অন্বেষণ এবং স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণের প্রয়াস সেলিনা হোসেনের শিল্পীসত্তার মৌল প্রেরণার উৎস হলেও তার উপন্যাসে নারীবাদী চেতনাও মূর্ত হয়ে উঠেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে যুগপৎ গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। উপন্যাসটিতে গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা সম্বলিত চিত্রের পাশাপাশি শহর ও গ্রামের জীবনপ্রবাহকে লৌকিক জীবন ধারায় অখÐ তাৎপর্যে রূপায়িত করেছেন। ইলিয়াসের রচনাভঙ্গি, ভাষার জাদুময় গতি ও পটভ‚মি নির্মাণ নিঃসন্দেহে তাকে বাংলা উপন্যাসে স্থায়ী আসনে বসাবে। অকালপ্রয়াত কায়েস আহমেদ মাত্র দুটি উপন্যাস লেখেই তার শক্ত অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। দিনযাপন উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধোত্তর নতুন বাংলাদেশে, নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে, নতুন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে নি¤œবিত্ত হিন্দু সংখ্যালঘুর মনোজগতের নানা প্রতিক্রিয়া ধৃত হয়েছে। দাঙ্গা-যুদ্ধ-মারী-দেশভাগ-বিপ্লব ও ধ্বংসের আগুন পেরিয়ে যারা বেঁচে থাকে, তাদের নিয়েই এ অসাধারণ আখ্যান নির্মাণ করেছেন কায়েস আহমেদ। ছয়ের দশকে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী-তে আহমদ ছফা যে দার্ঢ্যরে পরিচয় দিয়েছেন, পরবর্তীকালে সমান দক্ষতায় লিখে নন্দিত ও নিন্দিত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিন। সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে গ্রাম বাংলার নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, শোষিত, শাসিত, নিপীড়িত মানুষের বুকে সাহসী প্রেরণা জুগিয়েছে সূর্য তুমি সাথী উপন্যাসে। তার অলাতচক্র উপন্যাসের পটভ‚মি বা স্থান তৎকালীন কলকাতা শহর, আর সময় ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কলকাতা শহরে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের উদ্বাস্তু জীবন ও তৎকালীন কলকাতাবাসী মানুষ ও পরিবেশ পরিস্থিতির ঘটনাই উপজীব্য হিসেবে উঠে এসেছে অলাতচক্রে। তবে তার ওঙ্কার উপন্যাস নিঃসন্দেহে একটি ক্লাসিক প্রয়াস। বাংলাদেশের রাজনীতি, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রামের দুই যুগব্যাপী ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ একটি কালখÐের স্পন্দন ও অভিঘাতকে সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করেছেন; যা হয়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশ সৃষ্টির আদিধ্বনি’। দীর্ঘদিনের বামপন্থি রাজনীতিক সত্যেন সেন প্রবীণ বয়সে এসে লিখেছেন অভিশপ্ত নগরী ও পাপের সন্তান নামে দুটি উপন্যাস। নিজের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদী তত্ত¡দৃষ্টি মিলিয়ে মানবসমাজকে দেখার চেষ্টা করেছেন তিনি তার উপন্যাসে। ষাটের শক্তিমান ছোটগল্পকার হাসান আজিজুল হক সাম্প্রতিক সময়ে আগুন পাখি নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। এর আগে ছোট আকারের বেশ কটি উপন্যাস প্রতাশিত হয়েছে তার। একজন নারীকে কেন্দ্র করে দেশভাগের মানবিক বিপর্যয় ও অন্তর্বেদনা রাঢ় অঞ্চলের ভাষায় ধৃত হয়েছে আগুন পাখি উপন্যাসে। সত্তরের দশকে নন্দিত নরকে উপন্যাসের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ তার সৃজনপ্রতিভা ও শক্তিমত্তা নিয়ে আভিভর্‚ত হন। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের উপন্যাসে জনপ্রিয় ধারা নামে একটি ধারা হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে সূত্রপাত ঘটে। মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রের অবগুণ্ঠিত রহস্য সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশের জাদুকরি ক্ষমতা দিয়ে তিনি এ ধারায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে- এ মানব চরিত্রের অন্ধকার ও জটিল মনস্তত্তে¡র চিত্র অত্যন্ত দক্ষতায় তুলে ধরেছেন যার মাধ্যমে তার শক্তির পরিচয় ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের; বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রের এই নিগূঢ় রহস্য আর জটিল মনস্তত্তে¡র নানা দিকেরই উন্মোচন ঘটানোর মধ্যে থেকেছেন। আয়নায় নিজের চেহারা দেখার জন্য মানুষ যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে, হুমায়ূনের লেখায় নিজেদের জীবনের ওইসব রহস্য আর জটিলতার প্রতিফলন দেখে মধ্যবিত্ত বাঙালির অবস্থাটাও ওইরূপ হলো। তিনিও চট করে বাঙালির রগটা ধরতে পেরে জনপ্রিয়তায় গা ভাসিয়ে দিলেন। তবে দেশমাতৃকা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অভিনিবেশের মহত্তম প্রকাশ ঘটেছে কিছু উপন্যাসে। দ্বিতীয় দশকের শুরুতে প্রকাশিত তার শেষ উপন্যাস দেয়াল-এর আখ্যান রচিত হয়েছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনা, জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যাকাÐ নিয়ে। ইতিহাসের সত্য আর লেখকের সৃজনীপ্রতিভায় দেয়াল বাংলা উপন্যাসে শাশ্বত এক দলিল। ইমদাদুল হক মিলন আর আনিসুল হক এ জনপ্রিয় ধারারই দুই লেখক। মিলন অবশ্যই শক্তিশালী ঔপন্যাসিক; যদি তিনি জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটতেন, তবে তাকে আমরা সিরিয়াস লেখক হিসেবেও আখ্যায়িত করতে পারতাম। ধর্মভিত্তিক দেশভাগ কীভাবে মানুষের মননকেও পাল্টে দেয় তার অনুপম চিত্র ধৃত হয়েছে তার অধিবাস উপন্যাসে। সিলেটের অষ্টাদশী নূরজাহানকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মমভাবে হত্যা করে মৌলবাদীচক্র। মিলন এ ঘটনাকে নিয়ে লিখেছেন নূরজাহান উপন্যাস। নূরজাহানকে আশ্রয় করে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের নির্যাতিতা নারীসমাজের বাস্তব চিত্র, উন্মোচন করেছেন মৌলবাদ, ফতোয়াবাজ আর কাঠমোল্লাদের স্বরূপ। পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত আনিসুল হকের উষার দুয়ারে উপন্যাসে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথোপকথনে বর্ণিত হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের একাংশের আলেখ্য। শক্তিশালী কথাকার শহীদুল জহির মাত্র ৩৮ বছর বয়সে লেখেন প্রথম উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। মাত্র বায়ান্ন পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে ঢাকা শহরের একটি মহল্লাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের নির্মম ও বাস্তবচিত্র অঙ্কন করেছেন একেবারে নির্মোহ আবেগে। কথনভঙ্গি, নির্মাণকৌশল আর ভাষার ব্যবহারে তিনি একেবারেই আলাদা পথে হেঁটে নিজের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। জাদুবাস্তবতার প্রয়াসও লক্ষ্য করা গেল তার জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসে। তার দ্বিতীয় উপন্যাস সে রাতে পূর্ণিমা ছিল তার পূর্ববর্তী অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করেছে। অজগর, রুদ্ধদুয়ারের হাত, অন্ধক‚পের জন্মোৎসব ইত্যাদি উপন্যাসে হরিপদ দত্ত তার শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত জন্ম জন্মান্তর উপন্যাসে নৃতাত্তিক-ঐতিহাসিক পরিজ্ঞান আর লেখকের জীবনাভিজ্ঞান মিলে ব্যক্তিমানুষের প্রতীকদেহে মানবপ্রজাতির আত্মিক বিকাশের পরম্পরা ধৃত হয়েছে। তবে তিনি যতটা না প্রাকৃতজীবনের অন্বেষক, সমাজ-রাষ্ট্র-ইতিহাসের বিশ্লেষক; তার চেয়ে বেশি সচেষ্ট স্থানচ্যুত সুচন্দের অস্থি ও শেকড় চিহ্নিতকরণে। এককথায় ‘জন্ম জন্মান্তর হচ্ছে ‘জন্মভ‚মি’ শব্দটির সঙ্কুচিত হয়ে-যাওয়া, ক্রমশ চিহ্নহীন-নামহীন হয়ে-পড়ার কথকতাÑযার শুরু হয়েছিল দূরাতীত কাল থেকে’। শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসটি বেশি মাত্রায় ইতিহাস, কমমাত্রায় উপন্যাস হলেও ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানের প্রচেষ্টা হিসেবে আলোচনার দাবি রাখে। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চেপে বসা সামরিক শক্তি ও তাদের অভ্যন্তরীণ বয়ান হিসেবে না নিয়ে; একজন স্বপ্নবান মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের শত্রæ-মিত্র চিহ্নিত করার প্রয়াসরূপে নেয়া যায় ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসকে। হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের বিশ্বস্ত ও সৃষ্টিশীল দলিল। আজাদ উপন্যাসটিতে দেখিয়েছেন মৌলবাদী সহিংস রাজনীতির বীভৎস চেহারাকে। বিশেষত ২০০১ এর সংসদ নির্বাচনের পর বিজয়ী চারদলীয় জোট সরকারের মদদে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জনপদে মৌলবাদী নেতাকর্মীদের দ্বারা যে ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যা চলতে থাকে তারই প্রত্যক্ষ চিত্র ধৃত হয়েছে ২০০৩ সালে লেখা এ উপন্যাসটিতে। তবে এতে শুধু সমকালের যন্ত্রণাদায়ক বিবরণই প্রকাশ করেননি, সেই পরিস্থিতি থেকে ব্যক্তির উত্তরণের মধ্য দিয়ে জাতির মুক্তিরও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। হরিশংকর জলদাস পরিণত বয়সে লিখতে শুরু করলেও তার অনন্য সৃজনপ্রতিভা দিয়ে পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তার উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্যেও তার সাহিত্য-দক্ষতার পরিচায়ক। দহনকাল উপন্যাসে সমুদ্রোপক‚লীয় জলদাস তথা জেলে-সম্প্রদায়ের যাপিত জীবনের নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন। উপন্যাসটির অনন্যতা এইখানে যে, অদ্বৈতমল্ল বা মানিক নদী পারের জেলে জীবন নিয়ে লিখেছেন, আর হরিশংকর জলদাস লিখলেন সমুদ্র পারের জেলে জীবনের আখ্যান। মানিক-অদ্বৈতমল্লের উপন্যাসে এসেছে সমাজরে উঁচু-নিচুর দ্ব›দ্ব, আর জলদাস এনেছেন জালিক (মাউছ্যা) জেলে আর কৈবর্ত (কৈত্তর) জেলেদের সাম্প্রদায়িক বিভেদের চিত্র। ২০১০ এ প্রকাশিত প্রথম দশকের ঔপন্যাসিক চন্দন আনোয়ারের শাপিতপুরুষ আত্মদর্শনজাত উপন্যাস হলেও মূল বিষয় ধৃত হয়েছে ভারত উপমহাদেশীয় সমস্যা : সাম্প্রদায়িকতা। দুই ধর্মের দুই তরুণ-তরুণী ফারাহ মেহজাবিন রিমা ও সুমন গাঙ্গুলির বিয়ে এবং তাদের মনস্তাত্তি¡ক সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের ভারতবর্ষের চিরায়িত সমস্যাই প্রতিফলিত হয়েছে। রিমার গর্ভের অনাগত সন্তানটি একটি আশাবাদী ইঙ্গিত; প্রজন্ম থেকে প্রজান্মতরে বহমান এই বীজটিই একদিন ধর্মের বিভেদ রেখা ভেঙে প্রতিষ্ঠা করবে মানুষের সমাজ। ২০২০ সালে প্রকাশিত তার অর্পিত জীবন উপন্যাসে ১৯৬৪ থেকে অদ্যাবধি শত্রæ সম্পত্তি আইনের ফাঁদে পড়া বাস্তুভিটা হারা, দেশহারা, শেকড়চ্যুত হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন-বাস্তবতার করুণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

আহমাদ মোস্তফা কামালের নিরুদ্দেশ যাত্রা উপন্যাসে উঠে এসেছে আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশে চেপে বসা এরশাদের সামরিক শাসন এবং তদ্বাভিঘাতেসৃষ্ট মানব মনন ও জীবন অভিজ্ঞানের বয়ান। মানিকগঞ্জের জহিরুল-জাহেদা বেগম তাদের পাঁচ সন্তান নিয়ে যে সহজ-সরল জীবন কাটাচ্ছিলেন ৮২ সালের মার্চে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করলে তাদের সে জীবন বাংলাদেশের মতোই ভিন্ন পথ ধরলো। একে একে উঠে এলো ডাকসু নির্বাচন, ক্যাডার রাজনীতি, প্রহসনের সংসদ নির্বাচন, হ্যাঁ-না ভোট, সংবিধান কাটা-ছেঁড়া, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফ্রিডম পার্টি দিয়ে বেতার-টিভিতে ফিরে আসা, ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষসহ আরো অনেক কিছু। হামিম কামালের কারখানার বাঁশি উপন্যাসে শ্রমজীবী মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি ধৃত হয়েছে। তবে শুধু তাদের উপরিতলের আখ্যান নয় উপন্যাসটি; তার গভীরে নিয়ে যেতে চান আমাদের। সমকালীন অস্থির জীবন ও সামনে অপেক্ষমাণ নিশ্চিত দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার আশা জাগিয়ে রাখে কারখানার বাঁশি। দ্বিতীয় দশকের প্রতিশ্রুতিশীল ঔপন্যাসিক হারুন পাশা ইতোমধ্যে সিরিয়াস পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার উপন্যাস তিস্তা, দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত-এর কথা মনে করালেও তিস্তা-ব্যারেজসৃষ্ট সমস্যা ও সংকট নিয়ে অভিনব রীতিতে রচিত এটিকে সহজেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। পানি সংকট ও আন্দোলন, পরুষতান্ত্রিকতা, প্রেম-প্রতারণা, ছলচাতুরি-লাম্পট্য, লৌকিক-অলৌকিকতা, ধর্ম ও জাদু-বিশ্বাস, ভোটাভুটি তথা জনমানসের বহু বিচিত্র দিকের প্রতিফলন ঘটেছে উপন্যাসটিতে। সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র্য, প্রকরণ ও শৈল্পিকতায় এ-জনপদের সামূহিক লোকাচার, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বোধ ও এর প্রভাবে ব্যক্তিমানসের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় অত্যাচার, ধর্মীয় কূপমণ্ডকতা, সামাজিক অসাম্য ও অস্থিরতা, বুর্জোয়া-সামন্ত শ্রেণির তৎপরতা, মেহনতী কৃষক-শ্রমিকের জীবন সংগ্রাম, রাজনৈতিক-সামরিক জুলুম ইত্যাকার অনুষঙ্গের অভিঘাত ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিক জীবন অভিজ্ঞান ও শৈল্পিকচেতনায় যে অনুরণন তুলেছে, তারই নান্দনিক প্রতিফলন ও প্রতিকায়ন ঘটেছে উপন্যাসে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংগ্রাম, বিচিত্রমুখী জীবনবোধ ও জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে দ্যোতনাসমৃদ্ধ ভাষা এবং কৌশলী ও নান্দনিক বয়নশৈলীতে ১৯৪৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত উপন্যাসের যে নিজস্ব ধারা সৃজন হয়েছে, শিল্পের যে কোনো নিরিখেই তা বিশ্বমানের এবং বেশ ক’টি উপন্যাসই ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। (সমাপ্ত)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App