×

মুক্তচিন্তা

ঘর দেয়ার উৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৫৫ পিএম

হ্যাঁ, উৎসবই বটে। যখন বিশ্বজুড়ে চলছে মহামারির তাণ্ডব; যখন জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থবিত্ত ও শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গর্বিত দেশগুলো করোনার কাছে নতজানু হয়ে অন্য কোনোদিকে তাকানোর ফুরসতই পাচ্ছে না, তখন বাংলাদেশ মরণঘাতী এই ভাইরাসের আক্রমণ মোকাবিলা করে গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারকে ঘর দেয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। একে উৎসব বলা সঙ্গতই। ঘটনাটি ২৩ জানুয়ারি ২০২১-এর। এদিন সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৬৬ হাজার ১৮৯টি গৃহহীন-ভ‚মিহীন পরিবারকে বিনামূল্যে বাসস্থান প্রদানের দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবার ব্যারাকে পুনর্বাসিত হয়েছে। সরকারপ্রধান একেই উৎসব আখ্যায়িত করেছেন। ঘর পাচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ; বেদে, হিজড়া, দলিত বা হরিজন, চা শ্রমিক কেউ বাদ যাচ্ছেন না। অল্প সময়ের ভেতর এত অধিকসংখ্যক গৃহহীন পরিবারকে সরকারি খরচে বাড়ি উপহার দেয়ার ঘটনা মনে হয় বিশ্বে অনন্য নজির হয়েই থাকবে। জানা গেছে, সরকার ইতোমধ্যে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভ‚মিহীন-গৃহহীন পরিবারকে চিহ্নিত করেছে যাদের ঘর প্রদান ও পুনর্বাসিত করা হবে। নিঃসন্দেহে এটি এক মহৎ উদ্যোগ, আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে একধাপ অগ্রগতি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর যেমন সুবিধা আছে, তেমন আছে অসুবিধাও। বর্ষার খরস্রোতা প্রধান নদীগুলোর তীরে বসবাসরত অনেক মানুষের বাড়িঘর-ভ‚সম্পত্তি চোখের পলকে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে পড়েন মানুষগুলো। বিলীন হয় বিস্তর স্থাপনা। গত বর্ষাতেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন স্কুল ধসে যেতে। এমন প্রলয়ঙ্করী দৃশ্য ফি বছরের। নদীগুলোকে টেকসই উপায়ে শাসন ও নিয়মিত খনন করা গেলে হয়তো এই ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। বাস্তবতা হলো, সে সক্ষমতা আমাদের নেই, নেই ফলপ্রসূ উদ্যোগও। কখনো উদ্যোগ নেয়া হলেও ভেস্তে যায় দুর্নীতির কারণে। দুর্নীতির এই কালো ব্যাধি দূর করতে পারলে হয়তো পরিত্রাণ পাওয়া যেত কিছুটা। যা হোক হতাশায় মুহ্যমান হয়ে নিশ্চুপতা অবলম্বনের সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। দুর্নীতির প্রকোপ কমাতে পারলে উদ্যোগ যা নেয়া হচ্ছে তাও কাজে দেবে। তবে ভাঙন থাকবেই কম আর বেশি। ভাঙনের কবলে পড়া গৃহহারা মানুষকে যদি অন্তত বাসস্থানের ব্যবস্থা করে পুনর্বাসিত করা যায় তো সেটিকে বড় কাজ বলেই ধরে নিতে হবে। সরকার সে পথে এগোচ্ছে বলে ধরে নিতে চাই। গৃহহীন মানুষের মর্মযাতনা বিবেচনায় নিয়ে সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে কাজটি করুক এমনটিই প্রত্যাশা করি। কেবল নদীভাঙনের শিকারদের কথা নয়, নিজের ঘরদোর কিংবা ভূসম্পত্তি বলতে কিছু নেই এমন মানুষের সংখ্যা দেশে ভূরিভূরি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করা অসম্ভব। স্বীকার করি, ইতোমধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এটিও স্মরণে রাখা আবশ্যক যে, অগ্রগতির হিস্যা যতদিন হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যে যা জুটছে তা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ সম্ভবপর হলেও সহায়-সম্বল বা স্থাবর সম্পত্তির মালিক হওয়া অসম্ভব। গত এক-দেড় দশক ধরে জমিজমার মূল্য প্রচণ্ড ঊর্ধ্বমুখী। এ রকম চড়া দামে সম্পত্তির মালিকানা অর্জন সম্ভব কেবল ভাগ্যবানদেরই, গরিব মানুষের সম্পত্তির মালিক হওয়া কষ্ট-কল্পনা। বিদ্যমান আর্থ-সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য এখানে প্রকট। অর্থনীতিবিদ কোরাদো জিনির ফর্মুলা অনুসারে বাংলাদেশ বর্তমানে উচ্চ বৈষম্যের দেশ। এই বৈষম্য হ্রাসের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। বৈষম্য নিয়ে গবেষণারত আরেক অর্থনীতিবিদ জোসেফ-ই স্টিগলিজ মনে করেন এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সমাজের বিত্তবান মাত্র ১ শতাংশ মানুষ, অন্যদিকে উপকৃত হবেন ৯৯ শতাংশ মানুষ। সরকার যেপথে চলছে তাতে মনে হয় না তারা এ ধরনের বৈপ্লবিক উদ্যোগ নেবে। বিকল্প পথ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তাদের উদ্দিষ্ট মনে হচ্ছে। গৃহহীনদের গৃহ প্রদানের কর্মসূচি তার দৃষ্টান্ত। সেটিও কম কিছু নয় আপাতত। দেশের সার্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতির ক্রমে উন্নতি হচ্ছিল। দারিদ্র্য-হার নেমে এসেছিল প্রায় ২১ শতাংশে। করোনার অভিঘাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। গবেষণা সংস্থা ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং’ বা সানেম গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের তথ্য নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। তাতে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের দারিদ্র্যের হার ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামে দরিদ্রতা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটিই স্বাভাবিক। গ্রাম এখনো শতকরা প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থানের জোগানদাতা। এ কর্মসংস্থানের ধরনে দুর্বলতা আছে। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সংস্থান অধিকাংশের নেই। অর্থনীতির ভাষায় ছদ্মবেশী বেকারত্ব প্রকট এখানে। তা ছাড়া তাদের একাংশ গ্রামে বসবাস করলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য শহর তাদের মূল অবলম্বন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সূচনা ঘটেছিল জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের হাত ধরে ১৮৮৩ সালে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে আঁতুড়ঘরেই বিনষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এ রকম কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। এরপর ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ধারণাটি গ্রহণ করে সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তৃত করে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ জনকল্যাণকর অনেক বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান শুরু হয়, সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন দেশের সরকার। এ ব্যাপারে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশ বর্তমানে অনেক এগিয়ে। আমাদের দেশেও স্বল্প পরিসরে এর প্রচলন শুরু হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদির প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া অন্যক্ষেত্রে ভাতার অঙ্ক খুব সামান্য। সরকারি হিসাবে দেশের ২৮ শতাংশ মানুষ এর সুবিধাভোগী। তবে এতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশেরও কম, যার বৃদ্ধি একান্ত আবশ্যক। গৃহহীনদের বিনামূল্যে জমিসহ বাসস্থান করে দেয়ার কর্মসূচি সব মহলেই প্রশংসিত। ভেবেছিলাম এর কর্মকাণ্ড নিষ্কলুষ হবে। মানবিক দিক বিবেচনায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা অনিয়ম পরিহার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, যাতে সরকার এ ধরনের কর্মসূচি সম্প্রসারণে অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নরূপ। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ২০ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কীয় এক সম্পাদকীয়তে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো জায়গায় ঠিকাদাররা অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করছেন, কোথাওবা সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে নানা ছুতো-নাতায় অর্থ আদায় করা হচ্ছে। অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না করলে এমন প্রয়োজনীয় একটি কর্মসূচি ভেস্তে যাবে, সরকার প্রশংসার বদলে নিন্দার ভাগীদার হবে। কিছুদিনের মধ্যে সরকার আরো ৫০ হাজার পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। সেই প্রক্রিয়া যাতে ত্রæটি ও দুর্নীতিমুক্ত হয় এমন প্রত্যাশা রইল। নীতি-নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের একালে জোরালো তদারকি ছাড়া কোনো প্রকল্পের সফল সমাপ্তি সত্যিই কঠিন। মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App