×

মুক্তচিন্তা

অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর চেষ্টা আওয়ামী লীগের আছে কি?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:০২ পিএম

বিরোধী দলের আন্দোলনে বড় ধরনের কোনো অস্বস্তি বা চাপে না পড়লেও সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ ইদানীং ঘন ঘন নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে জড়িয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে। এক সমস্যা কাটতে না কাটতে আরেক সমস্যা এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে। দলের মধ্যে উপদলীয় বিরোধ-কোন্দল কোনোভাবেই চাপা রাখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে দলের প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও দলীয় প্রার্থীদের হারিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভও করছেন। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি জয় পেয়েছেন। মারামারি, হানিহানিও বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগই বেশি হয়েছে। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কাগজে-কলমে বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হলেও মাঠের চিত্র দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। এখন অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। এই যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, এটা কি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার? নাকি এর পেছনে আর কোনো রাজনীতি আছে? আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে কিছু প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না, নেতারা সবাই একমত, একপথ হয়ে চলবে, সেটা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু মতপার্থক্য যখন সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়, তখন তা উদ্বেগের বিষয় না হয়ে পারে না। আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে আবর্জনা পরিষ্কারে এখনই মনোযোগী না হলে পরে বড় সংকটে পড়তে হতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। দুই. ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়র গত ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করেই বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের দোকানগুলো নকশাবহিভর্‚ত এমন অভিযোগ এনে বর্তমান মেয়র ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে বিরোধের সূচনা হয়। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে টাকা দিয়েই তারা দোকানের বরাদ্দ নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা ৩৫ কোটি টাকা দেয়ার কাগজপত্র দেখিয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মামলা করলে সাঈদ খোকন বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করেন। ফজলে নূর তাপস সিটি করপোরেশনের টাকা তার পরিচালনাধীন ব্যাংকে রেখে মুনাফা নিচ্ছেন বলে সাঈদ খোকন অভিযোগ করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক দুই মেয়রের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দলের জন্য নিশ্চয়ই স্বস্তিকর ছিল না। সম্ভবত দলের উচ্চমহলের হস্তক্ষেপে বিরোধের আপাত নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে আবার কোনো উপলক্ষে কার্পেটের নিচে রাখা ময়লা সামনে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারেন? সাঈদ খোকনের বাবা মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা ছিলেন। তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও বহু বছর পালন করেছেন। সাঈদ খোকন মূলত পিতার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করেই রাজনীতিতে স্থান করে নিতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রও নির্বাচিত হন। তবে ২০২০ সালে তাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপসকে। তাপস প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহত যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে। তাপসের ছেড়ে দেয়া ঢাকা-১০ আসনে সাঈদ খোকন নির্বাচন করতে চাইলে তাকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এসব থেকে ধারণা করা হয় যে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের গুডবুকে সাঈদ খোকন নেই। তবে তিনি এখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে আছেন। শেখ তাপস এবং সাঈদ খোকনের বিরোধ নতুন মাত্রা পাবে নাকি এখানেই এর মধুরেণ সমাপয়েত এখন দেখার বিষয় সেটাই। তিন. আওয়ামী লীগের জন্য এখন বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন নোয়াখালী জেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা। এই কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। তিনি ছোট মাপের নেতা হয়েও বড় ঘটনা ঘটিয়ে আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। কাদের মির্জা গত ডিসেম্বর মাস থেকেই একের পর এক এমন সব বক্তব্য দিয়ে চলেছেন যা আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাদের মির্জা দুই মাস ধরে কখনো জনসভায়, কখনো ফেসবুক লাইভে, কখনো সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় অন্তত দুজন সংসদ সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন। তিনি নির্বাচন ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটি আসন ছাড়া বাকি আসনের সংসদ সদস্যরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না বলে মন্তব্য করে কাদের মির্জা সরকারের বিরোধিতাকারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। বড় ভাই ওবায়দুল কাদের এবং তার স্ত্রী ছাড়াও আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা কাদের মির্জার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। কাদের মির্জার বক্তব্য এবং অভিযোগগুলো দল এবং সরকারের জন্য অস্বস্তি ও বিব্রতকর হলেও তাকে কেন থামানো হচ্ছে না, তার এই সাহসের উৎস কোথায় সে প্রশ্ন এখন রাজনীতি সচেতন মহলে জোরালোভাবেই উঠছে। তিনি কেন এমন আচরণ করছেন, তার চাওয়া কী, তাও বুঝতে পারছেন না কেউই। তিনি কি আরো বড় পদ-পদবি চান, না অন্য কারো হাতের পুতুল হয়ে খেলছেন, প্রশ্ন সেটাও। পৌরসভা নির্বাচনে নিজের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য কাদের মির্জা গরম গরম কথা বলছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হলেও নির্বাচনের পরও তিনি একইভাবে তৎপর থাকায় এখন বিষয়টি আর হেলাফেলার পর্যায়ে আছে বলে মনে করছেন না অনেকেই। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় কেন কাদের মির্জার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করছেন, তাও অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। কাদের মির্জা এবং তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের সংঘর্ষে কোম্পানীগঞ্জে বুরহানউদ্দিন মুজাক্কির নামে একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ২৫ বছর বয়সি এই সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিলেও দলীয় নেতৃত্ব মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। নিহত সাংবাদিক বুরহানের বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পিতা নোয়াব আলী বলেছেন, ‘কোথায় আমার ছেলে আমার লাশ দাফন করবে! আর আজ আমাকে আমার ছেলের লাশ দেখতে হলো। এই শোক আমি কীভাবে সইব। প্রধানমন্ত্রী যেন আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি নিশ্চিত করেন।’ স্থানীয় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকেও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়ে। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের অপরাজনীতির শিকার হতে হলো একজন তরুণ সাংবাদিককে। এই গ্রুপ রাজনীতির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে কোম্পানীগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। এই বিরোধ চলতে দেয়া হলে সেটা শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। চার. কুয়েতের আদালতে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে। অর্থ ও মানব পাচার এবং ঘুষ দেয়ার অভিযোগে গত বছরের জুন মাসে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে গত ২৮ জানুয়ারি তাকে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেন কুয়েতের একটি আদালত। বাংলাদেশের কোনো আইনপ্রণেতার বিদেশে দণ্ডিত হওয়া এবং সংসদ সদস্য পদ বাতিলের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো আইনপ্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা হারাবেন এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না। পাপুল ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই আসনটি আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ মুহূর্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থনে পাপুল এমপি নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সরে দাঁড়ানো এবং আওয়ামী লীগের সমর্থন লাভের জন্য পাপুল মোটা অঙ্কের টাকা ঢেলেছিলেন বলে শোনা যায়। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে পাপুল কীভাবে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তা নিয়েও মুখরোচক গল্প আছে। পাপুল যে অত্যন্ত করিৎকর্মা সেটা বোঝা যায়, শুধু নিজে নয়, স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বানানোর মধ্য দিয়ে। টাকার জোর নাকি বড় জোর। পাপুলের ঘটনাটি আমাদের রাজনীতির একটি কুৎসিত চিত্রই সবার সামনে এনেছে। কেনাবেচার রাজনীতি যে নীতিনৈতিকতার ধার ধারে না, সেটা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশেও দুদক পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা ও মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম জামিনে মুক্ত আছেন। বাংলাদেশে অপরাধ করে পার পাওয়ার অনেক পথ আছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে অপরাধ করা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অতীতে এবং বর্তমানে শাসন ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোতে এমন অনেকেই আছেন যারা আইন-আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি দিনাতিপাত করছেন। পাপুলের ঘটনা থেকে কি কেউ কোনো শিক্ষা নেবেন? দুর্বিনীত এবং দুর্বৃত্তদের মাথার ওপর থেকে রাজনীতির ছাতা সরিয়ে নেয়ার কোনো চেষ্টা কি রাজনৈতিক দলগুলোতে কখনো আর দেখা যাবে? পাপুল ধরা খেলেন কিন্তু যাদের সমর্থন-সহযোগিতায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার তারা তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছেন। এক পাপুল কারাগারে, অনেক পাপুল রাজনীতির ঘরে ঘরে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে কেউ কি এগিয়ে আসবেন? দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা পাঁয়তারা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ ও চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দলের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সরকারি দলের কেউ কেউ তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, কিন্তু তাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, দিন চিরদিন সমান যায় না। তাছাড়া ঘরশত্রু বিভীষণরাও নিষ্ক্রিয় বসে নেই। কে কোনদিকে কোন কলকাঠি নাড়ছে তা কি সরকার এবং সরকারি দলের এন্টেনায় ঠিকঠাক মতো ধরা পড়ছে? বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App