×

মুক্তচিন্তা

বাংলা ভাষা ব্যবহার ও বাস্তবতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:১৬ পিএম

সর্বস্তরের বাংলা ভাষার প্রচলনকে গুরুত্ব দিয়েই ভাষা বিকাশের ধারাকে উজ্জীবিত রাখতে হবে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার বিকাশ সাধনে গবেষণা, অনুবাদ, পরিভাষা, শুদ্ধ ভাষার কথন ও উচ্চারণ, প্রমিত বাংলা বানানরীতি, ভাষানীতি ইত্যাদি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। মাতৃভাষা বাংলার বিকশিত রূপই একদিন তাকে জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষার দাবিতে পরিণত করবে এবং বাংলা হবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা। আর এভাবেই বাংলা ভাষা বিশ্বায়নের উপরে এক গভীর ও সুবিশাল প্রভাব বলয় তৈরি করবে।
বাংলা বিশ্বের ২২ কোটি মানুষের মাতৃভাষা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ও সরকারি ভাষা। এক কালের ‘ভাবের ভাষা’ একালের কাজের ভাষাও বটে। বাংলাদেশের সরকারি অফিস-আদালত, বেসরকারি অফিস, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রসমূহ, সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষা বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, মননজীবী সবাই তাদের ধ্যান-ধারণায়, চিন্তা-চেতনায় ও কর্মজীবনে নানাভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দ, সুখ ও গর্বের বিষয়। কেননা ভাষা স্থবির নয় বরং জঙ্গম। তা প্রবাহমান নদীর মতো দু’ক‚ল ছাপিয়ে চলে উদ্দাম গতিতে। পথে নানা স্থান হতে সংগৃহীত হয় নানা উপকরণ যা ভাষাকে সতত সমৃদ্ধ করে চলে। তাই ভাষার বহুমাত্রিক ও কলেবর ক্রমাগত বেড়েই চলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কালের পর কাল। যুগ যুগ ধরে ভাষা সমৃদ্ধশালী হয়। পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয় নতুন আঙ্গিক ও অবয়বে। বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। এর শব্দ ভাণ্ডার অফুরন্ত। রয়েছে নানা বৈচিত্র্য এবং মাধুর্য। শিক্ষিত সমাজ, শিক্ষকদের এবং গণমাধ্যমের জন্য একটি পরিমিত বাংলা ভাষা দরকার। শিক্ষকরা যদি নিজেই ভালো বাংলা না বলতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের গ্রামে এবং শহরে মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা পড়ানোর মতো ভালো কোনো শিক্ষক নেই। এটি একটি বড় সংকট। এক সময়ে স্কুলে পণ্ডিত মশাইরা ছিলেন যারা বাংলা পড়াতেন। শব্দের উৎপত্তি, বাংলা ব্যাকরণে তাদের ভালো দখল ছিল। রাজনৈতিক নানা কারণে সেই পণ্ডিত মশাইরা এখন দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এসব শিক্ষক অত্যন্ত অধ্যবসায়ী ছিলেন। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়েছি তা ভালো কথা, তবে ভাষার দিকে কোনো খেয়াল নেই। এতে আমরা না পারছি ভালো বাংলা বা ইংরেজি শিখতে এবং বলতে। আমরা এখন দাবি করছি জাতিসংঘের ভাষা হবে বাংলা। সেজন্য যদি পরিভাষা তৈরি করতে না পারা যায়, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ব। এজন্য আইন, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ের পরিভাষা তৈরি করতে হবে। কারণ জাতিসংঘ নানা আইন প্রণয়ন করে থাকে। বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে আমাদের উচিত হবে বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করার আগে জরুরি হলো আমরা শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে এবং লিখতে পারি কিনা তা যাচাই করা। যারা বাংলায় লেখালেখি করেন তারা অবগত আছেন ব্যাকরণসম্মতভাবে বাংলা বাক্য তৈরি করা এবং শুদ্ধ বানানে বাংলা শব্দ লিখা কতটা কঠিন। প্রথমত, আমাদের কতকগুলো বিষয় আইনগত বাধ্যবাধকতার ভেতর নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়মত, আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মাঝে মাঝে ইংরেজি বলতে এবং লিখতে পারা মানে বড় কিছু হয়ে হয়ে যাওয়া- এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা খুবই জরুরি। আর একটি বিষয় হলো বিশ্বায়নের যুগে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা। এই বিষয় এখন সারা বিশ্বে আদান-প্রদান হচ্ছে। এক দেশের সাহিত্য অন্য দেশে অনূদিত হচ্ছে এবং প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য জানতে হলেও আমাদের বাংলা ভাষার দুয়ার খুলতে হবে। পৃথিবীর সেরা সাহিত্যগুলো কিন্তু ইংরেজি ভাষায় নয়। আমাদের অনুবাদ সাহিত্য আরো বাড়াতে হবে। কালজয়ী বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। আমাদের মনোজগতে ইংরেজি নিয়ে একটি ঔপনিবেশিকতা তৈরি হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন নেই কিন্তু তাদের চিহ্ন থেকে আমরা বের হতে পারিনি। আমরা চাচ্ছি সর্বস্তরে বাংলা চালু হোক, বাংলা ভাষা যথাযথ মর্যাদা পাক কিন্তু এই ঔপনিবেশিক মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে তা সম্ভব হবে না। আমরা খাদ্য দূষণ, ফরমালিন, ভেজাল তেল, দুধে পানি মেশানোসহ ভোগ্যপণ্যের বিষয়ে খুবই সচেতন। কিন্তু আমাদের ভাষা যে দূষণের কবলে সে বিষয়ে আমরা কথা বলি না। বর্তমানে এফএম রেডিওতে ভাষার কী পরিমাণ দূষণ হয়েছে তা বর্ণনাতীত। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হারিয়ে আমরা জগাখিচুড়ি মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে শব্দ নিয়ে আমরা যে ভাষা তৈরি করছি তা আমাদের আত্মমর্যাদার জন্য অসম্মানজনক। বাংলা ভাষায় কিছু বিদেশি শব্দ রয়েছে যেগুলো আমরা বাংলা হিসেবেই গ্রহণ করেছি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির চরম আত্মোৎসর্গের চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশের মানুষ অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার এক মহান ব্রতে। এই ভাষার দাবি কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল স্বাধিকারের আন্দোলন। এরই প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হল সশস্ত্র সংগ্রাম; অর্জিত হলো আমাদের মহান স্বাধীনতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বপরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম কখনো থেমে ছিল না। অবশেষে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসঘের শিক্ষা, বিজ্ঞানও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো কানাডা প্রবাসী বাঙালি তরুণদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে একুশের চেতনা ধারণ করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর ২০০০ সালে ১৬ মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদাসহকারে বিশ্বের প্রতিটি দেশ উদযাপন করবে। উল্লেখ করা হয় বিশ্বব্যাপী সব মানুষের ভাষার সুরক্ষা এবং উপস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি করাই হবে লক্ষ্য। এ হচ্ছে ভাষাপ্রেমিক বাঙালি জাতির বিশাল অর্জন। আজকাল অনেকেই মনে করেন ইংরেজি জানা লোকেরা হয়তোবা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। এটা কোনো প্রতিষ্ঠিত যুক্তি নির্ভর নয়। কেননা যারা নিজ মাতৃভাষা বা বাংলা ভাষায় সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারে জানেন না তারা অন্য কোনো ভাষায় দক্ষতা বা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন এ কথা বলা যাবে না। প্রথমেই মাতৃভাষার শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে সে অন্য কোনো ভাষায় দক্ষ হতে পারেন। সুতরাং বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ, সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং সঠিক বানান রীতির ওপর বাঙালি হিসেবে সব বাঙালিকে অপরিহার্যভাবে যত্নবান হতে হবে। তাহলেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে। আজকের দিনে যে ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর সব রাষ্ট্র ও জাতিতে স্থান করে নিয়েছে বা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে- সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে হয়তোবা আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলাও পৃথিবীর সব জাতি ও রাষ্ট্রের মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে পৌঁছে যাবে এবং চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। ক্রমে ক্রমে তা আন্তর্জাতিকতার মহিরুহে পরিণত হয়ে যথার্থ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে। সর্বস্তরের বাংলা ভাষার প্রচলনকে গুরুত্ব দিয়েই ভাষা বিকাশের ধারাকে উজ্জীবিত রাখতে হবে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার বিকাশ সাধনে গবেষণা, অনুবাদ, পরিভাষা, শুদ্ধ ভাষার কথন ও উচ্চারণ, প্রমিত বাংলা বানানরীতি, ভাষানীতি ইত্যাদি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। মাতৃভাষা বাংলার বিকশিত রূপই একদিন তাকে জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষার দাবিতে পরিণত করবে এবং বাংলা হবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা। আর এভাবেই বাংলা ভাষা বিশ্বায়নের উপরে এক গভীর ও সুবিশাল প্রভাব বলয় তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরো মুখরিত করে তুলবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভাষার ওপর কোনো উপনিবেশিক চাপ, চক্রান্ত ও ভাষা দূষণের মতো ন্যক্কারজনক কাজকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার জন্য ভাষা প্রেমিক সব মানুষের প্রতি উদার আহ্বান জানাচ্ছি। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App