×

বিশেষ সংখ্যা

ধ্বনিই শুধু, এবং প্রতিধ্বনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৪৩ পিএম

ধ্বনিই শুধু, এবং প্রতিধ্বনি
“ভাষার এই অপচয় ও অপব্যবহারের কারণ ভাষার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিলাসী ও শ্রমবিমুখ শ্রেণির দ্বারা, যারা উৎপাদন করে না, অপচয় ও অপব্যবহার করে। শ্রমজীবী মানুষ শব্দের অপচয় জানে ন ”
প্রতিষ্ঠিত কবি একজন অধিকতর প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাব বিস্তারকারী আরেকজন কবির কথা লিখেছেন সম্প্রতি সশ্রদ্ধচিত্তে। তিনি বলেছেন, আমরা যারা প্রেমে পড়েছিলাম অল্পবয়সে ‘শব্দ, শব্দ, শব্দের’ তারা পাগল ছিলাম ওই কবিকে নিয়ে। ওই ‘শব্দ শব্দ শব্দ’, ইংরেজির অনুবাদ, ইংরেজি নাটক থেকে উদ্ধৃতি। সেই নাটকে শব্দের কথা বলা হয়েছে ঠাট্টা করে, বক্তা শব্দপ্রেমিক সেজেছিলেন বলা যায় ব্যঙ্গ করার জন্য। কিন্তু আমাদের কবিদের অনেকেরই শব্দ-প্রেমে প্রহসন নেই, ঠাট্টা করে কেউ বলেন না এখানে যে তিনি পাগল হয়েছে ‘শব্দ, শব্দ ও শব্দ’ নিয়ে। তিনি শব্দ-প্রেমিক যখন বলেন নিজেকে তখন আন্তরিকতা ও সততা নিয়েই বলেন সে কথা। সকলেই অবশ্যি কবি নন, কেউ কেউ কবি। কিন্তু সকলেই ভাষাপ্রেমিক আমরা, বাঙালিরা- মোটামুটি। হয়তো বলা যায় কবিও সবাই আমরা, নীরব-কবি হয়তো, স্বভাব-কবি নিশ্চয়ই। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কাব্যই হচ্ছে প্রধান বিষয়। স্থাপত্য ও চিত্রে আমাদের অবদান সামান্য, সেটা স্বাভাবিক কারণে। কেননা পলিমাটির দেশে এমন নির্মাণ সামগ্রী পাওয়া দুষ্কর যা টিকবে অনেক কাল ধরে। টেকে না, টেকানো যায় না। কিন্তু শব্দরা টিকে থাকে, লোকের মুখে মুখে, জন্ম জন্মান্তরের স্মৃতিতে। ধ্বনিকেই সেই জন্য অবলম্বন করতে হয় সৌন্দর্যবোধ ও হৃদয়ানুভ‚তিকে প্রকাশিত করার জন্য। এবং ধ্বনিকে নিয়েই সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের তুলনায় কাব্য অনেক বেশি প্রাচীন। গদ্য অর্বাচীন বাংলাদেশে, সেই অল্পবয়সের গদ্যের প্রকাশ শক্তির মধ্যে কাব্য থাকাটা স্বাভাবিক এবং তা আছেও। অন্যদিকে কাব্যে যেহেতু ধ্বনির স্থান গুরুত্বপূর্ণ, সেই জন্য কাব্য বিকশিত হয়েছে গদ্যের তুলনায় অনেক বেশি। কাব্য-প্রেম সর্বত্র বিস্তৃত। কবিরাই প্রেমিক হন বেশি এবং তাঁরা প্রেমিক সাধারণত ওই ‘শব্দ, শব্দ এবং শব্দের’। মন্ত্রের শক্তিতে আমরা সকলেই কম-বেশি আস্থা রাখি, রাখতে বাধ্য হই। আত্মশক্তিতে আস্থা স্বল্প বলে। কবিরা শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করেন এবং সমালোচনা যাঁরা লেখেন পত্র ও পত্রিকায় তাঁরাও কাব্যপ্রেমিক। কবিতা লিখে বাংলাদেশে যতো সহজে ও যতো দ্রুত খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটে তেমনটা ঘটে না অন্য কোনো ক্ষেত্রে, অন্য কোনো ব্যবসায়ে তো নয়ই, এমনকি সাহিত্যের অন্য কোনো শাখাতেও নয়। অত্যন্ত তরুণ যে কবি তাঁর কাব্য, এমনকি উপমা নিয়েও, মস্ত মস্ত প্রবন্ধ দেখা যায় সংবাদপত্রে, অত্যন্ত প্রবীণ যে গদ্য লেখক তাঁর ভাষা-ব্যবহার সম্পর্কে প্রবন্ধের কথা স্মরণ করতে হলে স্মৃতি হাতড়ানো আবশ্যক হয়। আর ঘটনা এরকমও যে কাব্য সমালোচনা কখনো কখনো শব্দ বিবেচনায় পর্যবসিত হয়; যে-সমালোচনা ভ্রান্ত হতে বাধ্য। উদাহরণ দেয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ধ্বনি-ব্যবহার স্মরণীয়, কিন্তু তাই থেকে যদি কোনো সমালোচক সিদ্ধান্ত করেন, যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ধ্বনিই আছে অন্যসব কিছুকে ছাপিয়ে তবে সেই মালার্মে-ধর্মী সিদ্ধান্তে ত্রæটি থাকে নিশ্চয়ই। এবং যদি সেই সিদ্ধান্তকে প্রয়োগ করা যায় সমালোচনায়, যেমন কোনো কোনো রবীন্দ্র-সমালোচক করেছেন, তখন দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ কেবলি, থেকে থেকে, একটি স্থির অবিচল জগতের শান্ত নাগরিকে পরিণত হতে চান; তাঁর প্রতিভার সবল চলমানতা মর্যাদা পায় না। ধ্বনির দিকটা প্রধান হয়ে পড়ে, গৌণ হয়ে দাঁড়ায় বক্তব্য ও চিত্র। এবং যে-সকল শব্দ সমালোচক বার বার ব্যবহার করেন তারা এমন একটা ব্যস্ততা সৃষ্টি করে বিবেচ্য কবির সৃষ্টিকে ঘিরে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আড়ালে পড়ে যায় পাঠকদৃষ্টির। সময়ের সঙ্গে ধ্বনির একটা বিরোধ আছে। সময় চলমান, ধ্বনি স্থির, তার চঞ্চলতা পরিধিতে, কেন্দ্র সে সুস্থির। ধ্বনি চায় চলমানকে সময় থেকে ছিনিয়ে নেবে, তাকে ধরে রাখবে নিজের স্থিরতার মধ্যে। আমরা জানি, প্রাচ্য জগৎ সময়জ্ঞানী নয়। আমরা কালের হিসাব করি না। কবি মহাকালের। সেই জন্য দৈনন্দিন সামাজিক জীবনেও দেখা যায় সময়ানুবর্তিতা আসতে চায় না। ধ্বনি-বিচার সময়-বিচারকে গৌণ করে দিতে চায়। আর সময়ের বাইরে যায় যখন মানুষ তখন সে প্রকৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহের কথা বলতে গিয়ে ধ্বনি-বিচারের সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-বিচারে আগ্রহী একজন বিশিষ্ট সমালোচক লিখেছেন, ‘সৃষ্টির এই যে শোভা, এই শোভার মধ্যে মানুষের একটি অংশ আছেÑ মানুষ এই শোভার সঙ্গে সংযুক্ত, সে এই শোভাকে অবলোকন করে এবং তার মাধুর্য নির্ণয় করে, এই শোভায় শোভমান হয়ে সে তার জীবনকে পরিদৃশ্যমান করে।’ এই বিচারে মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারায়, সে হয়ে পড়ে প্রকৃতির অংশ।
আমাদের গান গাওয়ার মধ্যে একটা অপেশাদারিত্ব থাকে। সেটা দুই অর্থে; এক. গান আমরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করি কম এবং দুই. গানের জন্য যে শ্রম ও প্রশিক্ষণ আবশ্যক তার ওপর নির্ভর না করে নির্ভর করি স্বাভাবিক প্রতিভার ওপর। সেই জন্য গান শোনা হয় না ততো যতো গাওয়া হয়। গান শিখি না, নিজে নিজে গাইতে শিখি। কেউ কাউকে শেখাতে চায় না, নিজে নিজে শিখে নেয়। এই বৈশিষ্ট্যটাও সাংস্কৃতিক, অর্থাৎ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তা উপস্থিত।
ধ্বনিকে নিরিখ করলে বস্তুকে যে-ভাবে অবজ্ঞা করতে হয় তার বিপত্তি অনেক, স্বভাবতই। যেমন সংস্কৃতে মহাকাব্য আছে, বাংলায় নেই, এর একমাত্র কারণ হিসেবে উপরোক্ত সমালোচক বলছেন, ‘সংস্কৃতি কাব্যে শব্দ ও ছন্দ ধ্বনিগৌরবে পরিপূর্ণ। ধ্বনিপ্রিয়তার এ নিশ্চয়ই একমাত্র কারণ নয়, ধ্বনিগত কারণের বাইরে বস্তুগত কারণও  নিশ্চয়ই আছে একাধিক, কিন্তু সেটা চোখে পড়েনি, ধ্বনির প্রতি মনোনিবেশের কারণে। এটা উদাহরণ মাত্র। এ ব্যাপার সর্বত্র ঘটছে। শব্দের একটা অর্থগত দিক আছে তাকে অবজ্ঞা করে ধ্বনিগত দিকটাকেই চরম বলে জ্ঞান করা হচ্ছে। অথচ শব্দ-ব্যবহারের ব্যাপারে প্রায় তুলনা-বিরহিত ছিল যাঁর মনোযোগ সেই শিল্পী ফ্লবেয়র, বলেছিলেন এক চিঠিতে যে, তিনি স্বাপ্নিক নন, তাঁর আসল দক্ষতা ‘পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা’। শব্দ নিয়ে এই খেলা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘শব্দ-মদ বেচা’, এটা কবিদের একচেটিয় কিছু নয়। আমরা সকলেই, শিক্ষিত মানুষেরা সকলেই, খেলছি এই খেলা। এমনকি যখন ভাষার প্রশ্ন আসে, তখনো আমরা ধ্বনির কথাই ভাবি প্রধানত ধ্বনির পেছনের অর্থের কথাটা অনেকাংশে বাদ দিয়ে। ধ্বনির প্রচণ্ডতায় অর্থ হারিয়ে যায় বার বার। এবং অনেক সময় ধ্বনিই সত্য হয়ে ওঠে, অর্থকে পেছনে ফেলে। অতিশয়োক্তিতে ও অযথার্থ প্রয়োগ ভাষার যে অপব্যয় প্রতিনিয়ত ঘটে তা আতঙ্কজনক। অপব্যয় অবশ্যি আমাদের জাতীয় ক্রীড়া। বাংলাদেশে সময়ের, যৌবনের, ধনের, জনশক্তিরÑ সব কিছুরই অপচয় চলছে, কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অপব্যয় বোধ করি শব্দের। কেননা শব্দের ওই অপব্যবহারের দিকে তাকাই যদি তবে অন্য সকল অপব্যয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারি, ধ্বনির অপব্যয় শুধু ধ্বনিরই নয়, সে-অপব্যয় জীবনের সামগ্রিক ও সাধারণ অপচয়েরই প্রতিলিপি। সেই জন্যই ব্যাপারটা দুর্ভাবনার। বয়স্ক ছেলে যদি অর্থোৎপাদন বাদ দিয়ে শুধু ধ্বনি উৎপাদন করে তবে পরিবারের দৈন্য যে ঘুচবে কখনো এমন আশা করবার কারণ দেখি না। অথবা যদি উপমাকে বদলে দিই, পূর্বোল্লিখিত কবির ওই উপমাকে স্মরণ করি, বলি আমরা পাগল হয়েছি শব্দ নিয়ে তবে সে-অবস্থাটাও আশাব্যঞ্জক নয়। আর যদি এমন হয় যে আশা করছি শব্দ নিয়েই জীবন চলবে তবে সে বিশ্বাস স্বাস্থ্যবর্ধক হবে না। ভাষার এই অপচয় ও অপব্যবহারের কারণ ভাষার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিলাসী ও শ্রমবিমুখ শ্রেণির দ্বারা, যারা উৎপাদন করে না, অপচয় ও অপব্যবহার করে। শ্রমজীবী মানুষ শব্দের অপচয় জানে ন। যাকে বলা হয় সাধু ভাষা সেই ভাষায় আড়ম্বর অধিক, কর্মের তুলনায়; শব্দেরা সেখানে যতো সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ততো পরিশ্রম করে না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা একে ছিলেন ব্রাহ্মণ তদুপরি পণ্ডিত, সাধারণ মানুষ থেকে তাঁদের শ্রেণি-দূরত্ব তাঁদের হাতের গদ্যকেও ‘অসাধারণ’ করে তুলেছিল। দলিল-দস্তাবেজের ভাষায় যে-একটা সরল যথার্থ ছিল তা এ-ভাষায় পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসাগর যখন ক্রুদ্ধ হয়েছেন তখন তাঁর ভাষার মধ্যে যে একটা জীবন-সংলগ্নতা তথা স্বাভাবিকতা এসেছে তা অন্য সময়ে আসেনি। পরবর্তী কালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যখন গদ্যকে কঠিন করেছেন সযতেœ তখন বোঝা গেছে তিনি এবং তাঁর অনুকারীরা সাধারণ মানুষ থেকে যে দূরে অবস্থান করছেন সেই দূরত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন, এবং দূরত্ববৃদ্ধিকে কাক্সিক্ষত জ্ঞান করছেন। বুদ্ধদেব বসুর সরলতায় অপব্যয় আছে ভাষার, আছে বাসনা জীবন থেকে পলায়নের। বিষ্ণু দে’র শ্রেণি-দূরত্ব মার্কসিজমে তাঁর আস্থা সত্তে¡ও ঘোচেনি। অন্যদিকে সাহিত্যে শব্দ নিয়ে যে ছুতমার্গ প্রকাশ পেয়েছে সেও সামাজিক ব্যাধির প্রকাশ মাত্র। ‘খুন’ শব্দ চলবে কি চলবে না এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জল ও পানির বিরোধ বঙ্গবিভাগের অপরিহার্যতারই স্মারক-চিহ্ন। (জলপানি কিন্তু দিব্যি চলে গেছে, স্কলারশিপ অর্থে; প্রাপ্তিযোগের কারণেই হয়তো বা।) বাংলাদেশের সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি দরবারি ভাষা ছিল; সেই থাকা এই কথাটা জানিয়ে দিয়েছে যে, জনসাধারণ ও রাজদরবারের মধ্যে পরিখা ছিল গভীর। এমনকি যখন বাংলাভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তখনও সেই পরিখা ভরাট হয়নি, কেননা পরিখা ভাষার নয়, অর্থনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থার, ভাষা তার বহির্প্রকাশ মাত্র। আর শব্দ নিয়ে যে হট্টগোল সেটা সৃষ্টি হয়েছে গভীরতর বিষয়ে প্রবেশ করতে অসামর্থ্যরে দরুন। আমরা অভিযোগ করি যে, বাংলা ভাষার যথেষ্ট প্রচলন হচ্ছে না। এ কিছু নতুন অভিযোগ নয়। ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রথম সংখ্যাতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘যত দিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙালিরা বাংলাভাষায় আপন উক্তিসকল বিন্যস্ত করিবেন ততোদিন বাঙালির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নাই; বাংলায় যে কথা উক্ত না হইবে তাহা তিন কোটি বাঙালি কখনো বুঝিবে না বা শুনিবে না। যে কথা দেশের সকল লোক বুঝে না বা শুনে না সে কথায় সমাজের বিশেষ কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নাই।’ কিন্তু যে-প্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব নেই এই উক্তিতে তা হলো, সকল বাঙালি কি এক? ধনী-দরিদ্র শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদ কি নেই? বাংলায় বললেই সব বাঙালি বুঝবে? সমানভাবে বুঝবে? দ্বিতীয় কথা, সমাজের উন্নতি মানে কি সকল বাঙালির উন্নতি বোঝান হচ্ছে? তাই যদি হয় তবে তো ভাষার ব্যবধান কমানোর আগে কমানো দরকার সামাজিক ব্যবধান, সেই ব্যবধান না গেলে ভাষার দূরত্ব থাকবেই, বাংলা ভাষা সকলে ব্যবহার করলেও থাকবে; ধনী-দরিদ্র শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল বাঙালির ভাষা এক হবে না কিছুতেই। অনতিক্রমণীয় পার্থক্য রয়ে যাবে অভিজ্ঞতার, চিন্তার, অনুভবের, যার প্রভাব ভাষার ওপর পড়বেই। বাংলা প্রচলন না-হওয়াটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু অধিকতর মর্মান্তিক হচ্ছে না হওয়ার কারণটা। কারণটা নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ও সামাজিক। দেশের অধিকাংশ মানুষ নির্বাক আগেও ছিল, এখনো আছে, তার কারণ তাদের অর্থনৈতিক দৈন্য ও অশিক্ষা। ধ্বনি যেটুকু আছে তা আর্তনাদের, শোকের ও অভিযোগের। সেই শব্দগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলে থাকে, আলাদা করা যায় না, তারা প্রায়-মৃত। তাদের মধ্যে কোনো বৈচিত্র্য নেই। বৈচিত্র্যপূর্ণ, শিক্ষিত, জীবন্ত ভাষা প্রয়োগ করবার কথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের। কেননা, সেখানে কিছুটা জীবন আছে, আর কিছুটা দক্ষতা। ভাষা ওইখানে বন্দি হয়ে আছে, ওই ভদ্র মধ্যবিত্ত সমাজে। এটা একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুহা। এবং গুহার ভেতর আমরা ধ্বনি তুলছি, এবং কি প্রতিধ্বনি। অনেক সময় ধ্বনিকে ছাড়িয়ে যায় প্রতিধ্বনি, ছাপিয়ে ওঠে সত্যকে। কিন্তু শোনে না, কেউ কারো কথা শোনে না, সকলেই শব্দ করে। গুহার মধ্যেও গুহা আছে আসলে, আত্মকেন্দ্রিকতার গুহা। ভাষা যে বেরিয়ে পড়বে এই গুহা থেকে তা হয়নি। তার কারণ অর্থনীতির অনগ্রসরতা, ভাষার ডাক পড়েনি নানা ক্ষেত্র থেকে, চ্যালেঞ্জ আসেনি বিচিত্র ও বহুমুখী। জীবনে যে বৈচিত্র্য নেই, কর্মের যে উদ্যোগ নেই বিপুল ও প্রবল তার ফলেই ভাষার এই বন্দিদশা। আমরা বলছি সাধারণ মানুষকে টেনে আনতে হবে, আন্দোলন গড়তে হবে সাংস্কৃতিক। কিন্তু এ সকল কথাও গুহার মধ্য থেকেই বলা। আমরাই বলি, আমরাই শুনি, অথবা শুনি না। সাধারণ মানুষ শোনে না, শুনলে বুঝে না, নয়তো ভয় পায় (টানটানি ভয়েরই ব্যাপার, জবরদস্তি এক প্রকার।) আসল কথা, ভেঙে ফেলা আবশ্যক এই গুহা। তবে, এবং শুধু তবেই, ভাষা সুযোগ পাবে যথার্থ প্রসার লাভের, নইলে নয়, তার আগে নয়। বাংলা প্রচলনের একটা উপায় শিক্ষাকে বিস্তৃত করা। কিন্তু শিক্ষা বিস্তারটাও একটা সমাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা। বাংলা ভাষায় উচ্চস্তরে শিক্ষাদানের জন্য পুস্তক দরকার লক্ষ লক্ষ, আমরা পুস্তক প্রকাশ করতে পারছি না এমনকি শত শত। সর্বোপরি শিক্ষাও সীমাবদ্ধ হয়ে আছে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষদের এলাকায়। গুহার আয়তন কিছুটা বিস্তৃত হচ্ছে শুধু, বাড়ছে সংখ্যা নব্যাগন্তুকের, কিন্তু গুহার ভেতরই সমস্ত বিত্ত আটক আছে পুরোপুরি। এবং সকলেই জানেন যে, যে-শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে দেশে তা অনেকাংশে সামন্ততান্ত্রিক ও কিয়দংশে পুঁজিবাদী মানসিকতার সৃষ্টি করে, সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা সৃষ্টি না-করে। এই শিক্ষা গুহা-ভাঙার শিক্ষার নয় কোনো দিক দিয়েই, গুহাকে অক্ষয় রাখার শিক্ষাই আসলে। ব্যাপক হারে বাংলা চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে অনেক সময় উল্লেখ করা হয় পরিভাষার অভাবকে। পরিভাষার দুর্বল ঘাড়ে এই প্রবল বোঝা চাপানোর চেষ্টাটা হাস্যকর নিশ্চয়ই, আবার করুণও। কেননা, এর মধ্যে দিয়ে আবার ধরা পড়ছে ওই ধ্বনিপ্রেম, ধ্বনির কাছে যাচ্ছি ছুটে বার বার। পরিভাষা একেকজন একেক প্রকার তৈরি করছেন। স্মরণীয় যে, বাংলা ভাষা সংস্কারের চেষ্টাও হয়েছে অনেকবার। সকলে যে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করেছেন তাও বোধ হয় নয়, অনেকে হয়তো ভেবেছেন ভাষার সেবাই করছেন সংস্কার করতে চেয়ে। সাহিত্যে যখন কেউ বলেন তাঁর নিজের এলাকার ভাষা চালু করবেন, অথবা বিধান দেন পুঁথির ভাষা গ্রহণের তখনো সেবার মানসিকতাই হয়তো প্রকাশ পায়। কিন্তু মূল কথা গুহাবাসী মানসিকতা, অর্থাৎ কিনা আত্মকেন্দ্রিকতা। আমিই মানদণ্ড, অন্যেরা শুধু অনুকরণ করবে, নয়তো অনুসরণ। শ্রুতি ও স্মৃতি যে আমাদের ধর্মে এবং শিক্ষায় প্রাধান্য পায় তার কারণও আমাদের ধ্বনি-প্রিয়তা। মন্ত্রে আস্থা ধ্বনিতে আস্থাই। এবং মননের সঙ্গে মন্ত্রের একটা স্বভাবগত বিরোধ আছে, যার কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলা আছে ‘অচলায়তন’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যে, ‘মন্ত্রকে মনন-ব্যাপার হইতে যখন বাহিরে বিক্ষিপ্ত করা হয়, মন্ত্র যখন তাহার উদ্দেশ্যে অভিভ‚ত করিয়া নিজেই চরম পদ অধিকার করিতে চায়, তখন তাহার মতো মননের বাধা আর কী হইতে পারে। কতকগুলো বিশেষ শব্দসমষ্টির মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে এই বিশ্বাস যখন মানুষের মনকে পাইয়া বসে তখন সে আর সেই শব্দের উপরে উঠিতে চায় না। তখন মনন ঘুচিয়া গিয়া সে উচ্চারণের ফাঁদেই জড়াইয়া পড়ে।’ আমরা পড়েছি, অনেক কাল ধরে পড়ে আছি, এই ফাঁদে। আমাদের গান গাওয়ার মধ্যে একটা অপেশাদারিত্ব থাকে। সেটা দুই অর্থে; এক. গান আমরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করি কম এবং দুই. গানের জন্য যে শ্রম ও প্রশিক্ষণ আবশ্যক তার ওপর নির্ভর না করে নির্ভর করি স্বাভাবিক প্রতিভার ওপর। সেই জন্য গান শোনা হয় না ততো যতো গাওয়া হয়। গান শিখি না, নিজে নিজে গাইতে শিখি। কেউ কাউকে শেখাতে চায় না, নিজে নিজে শিখে নেয়। এই বৈশিষ্ট্যটাও সাংস্কৃতিক, অর্থাৎ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তা উপস্থিত। আরো একটা সত্য এই যে, গান ঐক্য আনেনি দেশের মানুষের মধ্যে। পল্লীর সঙ্গীত ও শহরের সঙ্গীত ভিন্ন ভিন্ন। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত একই ধরনের গান পছন্দ করে না। মূলগত যে বিচ্ছিন্নতা মানুষে মানুষে, গ্রামে গ্রামে, প্রাচীনকাল থেকে প্রতিষ্ঠিত আছে এই ভ‚মিতে সেই বিচ্ছিন্নতা দূর হয়নি গানের মধ্য দিয়ে, বরং বলা যায় স্বীকৃত ও সমর্থিতই হয়েছে নতুন করে। আমাদের ভাষা-চর্চার মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো এসে গেছে, অনায়াসে। সেখানেও ভাবালুতা, অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদ আছে সুবিস্তৃত ও সুগভীর হয়ে। কর্মের তুলনায় আলস্য ও মেদবাহুল্যেরই আধিক্য। অশিক্ষিত-পটুত্বই প্রধান ভরসা আমাদের। ভাষা সর্বত্র বিস্তৃত হতে পারেনি। বহু মানুষের কর্ম, সম্মিলিত উদ্যম ও পরিশ্রমে বহুল ব্যবহৃত, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। ভাষার মাধ্যমে ঐক্য সেও গড়ে ওঠেনি। আমরা যখন চর্চা করি কি বিজ্ঞানের, কি দর্শনের, কি মানবিক বিদ্যার তখন ধরে নিই, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অপ্রত্যক্ষ রূপে ধরে নিই যে, পৃথিবীটা স্থির হয়ে আছে। স্থিরত্ব অর্থ মৃত্যু। জ্ঞানের চর্চা তাই মৃত্যুর চর্চা হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত। শব্দ, শব্দ এবং শুধুই শব্দের যে কাব্যিক ও গীতিপ্রধান প্রেম তার মধ্যে অপচয় ও প্রহসন দুটোই রয়েছে। আজ যা প্রয়োজন তা শব্দকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রাধান্য দেওয়া অর্থকে, ধ্বনিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া জীবনের দিকে। সাহিত্যের সঙ্গে শত্রæতা অনেক প্রকার হয়, সবচেয়ে বড় শত্রæতা সাহিত্যকে জীবনবিমুখ করা, যে-শত্রæতা অনেক সময় সাহিত্যিকরাই করেন সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে। সাহিত্য তখন শূন্যকুম্ভ হয়ে ওঠে এবং ধ্বনি করে অত্যধিক। কিন্তু সমস্যাটা সাহিত্যিক নয়, ভাষাতাত্তি¡ক তো নয়ই, সমস্যাটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App