×

জাতীয়

অবহেলায় গৌরবগাথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:২৫ এএম

অবহেলায় গৌরবগাথা
অবহেলায় গৌরবগাথা
অবহেলায় গৌরবগাথা
অবহেলায় গৌরবগাথা

ভাস্কর্য দেখাশোনার দায়িত্ব কার

এখানে থমকে যাওয়া সময়ে কথা বলে ইতিহাস। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছেষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন- এসবে যেন ফ্রেমবন্দি বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাস। স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিহত- এমন ১৮ শহীদের মুখাবয়ব দিয়ে পুরো ভাস্কর্য নির্মিত। বেদির শুরুতে ভাষা শহীদের ভাস্কর্য এবং সবার উপরে তর্জনী উঁঁচু করা বঙ্গবন্ধু। আরেক হাতে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজের পতাকা। এতেই শেষ নয়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, তাজউদ্দিন আহমদ, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, লালন ফকির, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসুদন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শিল্পী এসএম সুলতান, দার্শনিক জিসি দেব, কামাল আতাতুর্ক, রাজা রামমোহন রায়, মাও সে তুং, ইয়াসির আরাফাতসহ দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী, রাজনীতিক, বিজ্ঞানীর আবক্ষ মোট ১১৬টি ভাস্কর্য। কিন্তু অযত্নে-অবহেলায় শ্যাওলা জমে শ্বেতশুভ্র ভাস্কর্যগুলো এখন বিবর্ণ। দুয়েকটি ভাস্কর্যের নামফলক থাকলেও নামহীন অনাদরে অনাহুতের মতোই অধিকাংশ আবক্ষ। যেন দেখার কেউ নেই।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, বুয়েট ও সলিমুল্লাহ হলসংলগ্ন সড়ক দ্বীপে বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারক এ ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যটি। বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যে সরেজমিনে দেখা গেছে, মূল ভাস্কর্যের পাদদেশে রাখা ছোট ছোট ভাস্কর্যগুলোর চুনকাম উঠে গিয়ে জরাজীর্ণ অবস্থা। কয়েকটি ভেঙেও গেছে। কয়েকটিতে নামফলক নেই। আর যেগুলোর নামফলক আছে, সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এছাড়া বড় ভাস্কর্যটিতে অনেক আগাছাও জন্মেছে। আর সেখানের আলোর ব্যবস্থাও প্রায় নষ্ট। মালী বাদল গোয়ালা জানালেন, তথ্যকেন্দ্র থাকলেও সেখানে লোক থাকেন না। ১ ঘণ্টা ডিউটি করে চলে যান। রাতে একজন দারোয়ান থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম এবং শাহবাগ থানা সরাসরি তদারকি করে। কোভিডের আগে অনেকেই ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত। কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙার পর থেকে কাঁটাতারের ভেতর কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। অবশ্য ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যটির মতোই অযত্নে-অবহেলায় ধুলোর আস্তরণ গাঢ় হচ্ছে নগরীর অন্য ভাস্কর্যগুলোতেও। ভবঘুরে, ছিন্নমূল মানুষের মলমূত্রসহ দৈনন্দিন প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের দুর্গন্ধের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বেশ কিছু ভাস্কর্য।

ঐতিহ্য হারাতে বসছে ভাস্কর্যগুলো : বৃহস্পতিবার। বেলা ৩টা। স্থান গুলিস্তান মোড়। জীবন বীমা কর্পোরেশনের সামনে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি স্মারক ভাস্কর্য ‘বঙ্গবন্ধু মনুমেন্ট।’ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০০ সালে এ ভাস্কর্য উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চারপাশে মলমূত্রের গন্ধে দাঁড়ানো মুশকিল। এর মধ্যেই একজন রুমাল বিক্রি করছে। চারপাশে রিকশা চলাচল করে। মনুমেন্টের ফোয়ারা বন্ধ। এক পাশে কিসমিস, বাদাম বিক্রি করছে। রুমাল বিক্রেতা মামুন জানান, এক বছর ধরে বিক্রি করছেন তিনি। দিনে ১ হাজার টাকা আয় হয়। মনুমেন্টে কোনো পাহারাদার না থাকায় ছিন্নমূল মানুষেরা প্রাকৃতিক কর্ম সারে। ফলে দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না।

দুপুর সাড়ে ৩টা। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজার মোড়ে ‘সার্ক ফোয়ারা’। জনশূন্য খাঁ খাঁ দুপুরে জলশূন্য ফোয়ারাও খাঁ খাঁ করছে। নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে ফোয়ারায় ময়লা-আবর্জনা জমেছে। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ফোয়ারাটি। পানিবিহীন ফোয়ারায় জমেছে ময়লা, যা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেই। কারওয়ান বাজার মোড়ে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলছেন, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে অচল হয়ে আছে ফোয়ারাটি। খুব বড় কোনো অনুষ্ঠান না হলে জনশূন্য?ই থাকে বলে জানালেন তিনি।

রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের পাশে বিজয় সরণি মোড়ে বাঙালির বিজয়গাথা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘বিজয় সরণি ফোয়ারা’। ফোয়ারার দেয়ালে অঙ্কিত আছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও আমাদের বিজয়ের ইতিহাস। ম্যুরালের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা ব্যানার হাতে অকুতোভয় বাঙালির আন্দোলন। বায়ান্নতে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা। একতারা হাতে আপন মনে গান গাওয়া বাউল। ঢোল বাজিয়ে মাতোয়ারা করছে ঢুলি। গরুর গাড়ি করে যাচ্ছেন গাঁয়ের বধূ। মাটি নিয়ে খেলছে শিশু। কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে পল্লীবালা। নদীতে নৌকা বেঁধে তীরে বসে গল্প করছে মাঝিরা। জমির একদিকে ধান কাটছে কৃষক, অন্যদিকে কৃষক গরু-লাঙল দিয়ে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করছে নতুন ফসল বোনার জন্য। কৃষকের মাথায় মাথাল, হাতে কাস্তে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের উদ্দেশে। কৃষাণিরা ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প করছে। রয়েছে একাত্তরের উত্তাল দিন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বান। অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিকতা। স্বাধীন একটি ভূমি, একটি পতাকা, স্বাধীন দেশ। সাত বীরশ্রেষ্ঠ। আমাদের মহান বিজয়ের আখ্যান নিয়ে নির্মিত এই ফোয়ারাটি এখন মলিন। বৃহস্পতিবার বেলা ৩ বেজে ৪২ মিনিট। বিজয় সরণী মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ফোয়ারায় নামফলক নেই। কবে তৈরি, তাও নেই। ফলে এর ইতিহাস-ঐতিহ্য কেউই জানে না। কর্মরত পুলিশও জানে না। ফোয়ারায় নোংরা পানি। একটি খোলা ট্যাপ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওই নোংরা জলেই মুখ কুলকুচি করছে একজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরীর অধিকাংশ ভাস্কর্যেই বাঙালির প্রতিবাদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা, গতি, উদ্যম, বীরত্ব, গণহত্যাসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্যগুলো। তবে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসছে ভাস্কর্যগুলো। এতে ক্ষোভপ্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব ভোরের কাগজকে বলেন, ভাস্কর্য কখনো সরকারি, আবার বিশেষ ঘটনার কারণে, আবার কখনো বাণিজ্যিক কারণে হয়ে থাকে। কারণগুলো একাকার করা উচিত নয়। ভাস্কর্য শিল্প। শিল্পের পর্যায়ে না হলে রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রয়োজন নেই। ভাস্কর্য নগরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহক। ভাস্কর্যশিল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নগর সরকারের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করে তাদের হাতে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। সেসঙ্গে ভাস্কর্যের নামে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক কারণে করা অখাদ্যগুলোর অপসারণ জরুরি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব শিল্পের লালন-পালন ও ধারণ করা। সুচিহ্নিত করে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সব ভাস্কর্য রক্ষার জন্য কমিটি করেছেন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য। কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাসিমা হক মিতু ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভাস্কর্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। শিগগিরই কার্যক্রম শুরু হবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য সম্পর্কে যতটা জানি, এটি শামীম শিকদার নিজের উদ্যোগে করেছেন, নিজ উদ্যোগেই ওই জায়গায় রেখেছেন এবং এটির তদারকি তিনি নিজেই করেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সরকারিভাবে যেসব ভাস্কর্য তৈরি হয়, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা। নগর পরিকল্পনা, সাজসজ্জা, নগরের পরিচ্ছন্নতা সব এক জায়গা থেকেই হওয়া উচিত। শিল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিল্পীর দায়িত্ব শেষ। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যারা তৈরি করেন, তাদের ওপরই বর্তায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App