×

মুক্তচিন্তা

ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে ভুট্টো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৫৫ পিএম

পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে তার প্রধান মেন্টর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন : যতদিন ভুট্টো থাকবেন ততদিন পাকিস্তানে শান্তি আসবে না। ভুল বলেননি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ভ‚মিধস বিজয় লাভ করা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণ ঠেকাতে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পেশোয়ারে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিলেন : তিনি এবং তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেন না, ঢাকায় যাবেন না। ভুট্টোকে নিয়ে খেলল পাকিস্তানের সেনা-আমলা অলিগার্কি। মদদ জোগালেন জোসেফ ফারল্যান্ড। ভুট্টোর সঙ্গে ৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষাৎ করলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড। সাক্ষাতে যে বিবরণ তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়েছেন তা অনূদিত হলো। সঙ্গে যুক্ত করা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া ও হুঁশিয়ারি। একাত্তরের পূর্ব পাকিস্তান এপিসোডের মূল খলনায়ক পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। যে কারণে তাকে ফাঁসি দেয়া হয় তা বিতর্কিত হলেও বাংলাদেশে গণহত্যার যেটুকু দায় তার তাতে এটাই প্রাপ্য ছিল।

ভুট্টোর সঙ্গে ফারল্যান্ডের সাক্ষাৎকার রাষ্ট্রদূত তার সাক্ষাৎকারের একটি সারসংক্ষেপ ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়েছেন। অনুলিপি লিখেছেন ঢাকা, লাহোর, করাচি ও পেশোয়ারে আমেরিকান কনসাল জেনারেল এবং ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে। ০১. শুক্রবার ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তার করাচির বাসভবনে সাক্ষাৎ করি। তার আগ্রহেই পুরো ১ ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয় আলোচনা চালিয়ে যাই। ০২. পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক : সম্প্রতি দুজন কাশ্মিরি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফোকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করে পাকিস্তানে নিয়ে আসে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা উড়িয়ে দেয়, যার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় আকাশের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করে দেয়ার বিষয়টি তার আলোচ্য বিষয়ের শীর্ষে ছিল। ভুট্টো আমাকে বললেন, মাত্র কিছুক্ষণ আগে তিনি প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে যা যা ঘটেছে সব জানিয়েছেন। তিনি বলেন, লাহোর এয়ারপোর্টে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে যখন তার কথা হয় এই ঘটনার পরিণতি সম্পর্কে তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি হাইজ্যাকারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন কি না এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। তিনি মনে করেন এ সময় করাচি সফরে ব্যস্ত না থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি ইসলামাবাদে থাকতেন তাহলে সম্ভবত উড়োজাহাজ উড়িয়ে দেয়া এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এড়ানো যেত। যেহেতু পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খান কেবল মাত্র আদিষ্ট হলেই কাজ করেন- এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকার ওপর জোর দেন- তাহলেই কেবল প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতির কালে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের লোকদের দূরে দূরে থাকার প্রবণতা থাকে। কী সিদ্ধান্ত নেয়া যেত সে সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি। ০৩. সংবিধান প্রণয়ন ও পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্ক : ভুট্টো বারবার বলেছেন প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের আগে সংবিধান প্রণয়নের বড় বাধাটা অতিক্রম করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার করারোপ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রশ্নে মতবিরোধ ছাড়াও মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়ে গেছে। সম্প্রতি ঢাকায় চারদিনের বৈঠকে ভুট্টো এ বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। মুজিব বলেছেন প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। ভুট্টো বলেছেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধন দুর্বল তবে তিনি বলেছেন এই বন্ধন আরো পুরু করতে তাদের দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তার ভাষ্য, তিনি ও মুজিব যদি করারোপ ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে মতৈক্য পৌঁছতে পারেন তাহলে অন্যান্য বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করা কঠিন কাজ হবে না।

০৪. জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে ভুট্টো বলেছেন তারিখ এখনো নির্ধারিত হয়নি। আর ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ চলতে না দেয়ার ভারতীয় সিদ্ধান্তে অধিবেশন ডাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারতের ওপর দিয়ে উড্ডয়নে বাধার কারণে সংসদ অধিবেশনে কেন ডাকা যাবে না ভুট্টো তা স্পষ্ট করে বলেননি। ০৫. পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন : যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবিরুদ্ধ কাজের একটি প্রচারণা যে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে ভাঙতে চায়- এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বললেন যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত পাকিস্তান চায় বলেই তিনি বিশ্বাস করেন; তার দলের যারা এ ব্যাপারে সন্দিহান তিনি তাদের তার বিশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন।

০৬. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক : আমাদের পুরো বৈঠকেই ভুট্টো খুব বন্ধুসুলভ ছিলেন। তার নির্বাচন প্রচারণায় যদিও আমেরিকান নীতিকে আক্রমণ করা হয়েছে তা ঢেকে দিতে আমেরিকা ও আমেরিকান জনগণের ওপর তার অশেষ ভক্তি ও আস্থার কথা প্রকাশ করেন। আমেরিকাতে অবস্থানকালীন তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘সেগুলোই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বছর’। তিনি বললেন, তার কন্যাও রেডক্লিফে পড়াশোনা করছে; যদি তিনি যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ না করতেন মেয়েকে এখানে পড়াতেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার মেয়ে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পেতে চান, তিনিও ভবিষ্যতে যাবেন বলে ভাবছেন, তবে সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ হওয়ার আগে তা করতে চাচ্ছেন না, কারণ তাহলে তার বিরুদ্ধে সিআইএর এজেন্ট বলে যে রটনা আছে সফরটাকে তার প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হবে। ভুট্টো প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশংসা করলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাকিস্তান সফরে এলে তার সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাৎ হয়েছে বলে জানান।

০৭. আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভিযোগ : ভুট্টোর দলের অনেক সদস্য এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির মুখপাত্র আমার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে ইন্দোনেশিয়ায় ১০ লাখ মুসলমানের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ীÑ ভুট্টো নিজেই এই প্রসঙ্গটি তুলে বললেন, আসলে তারা বোঝেনি। এই মিথ্যা অভিযোগটি তার নজরে এসেছে এবং এর প্রচারণা বন্ধ করার জন্য যতটা সম্ভব তিনি চেষ্টা করেছেন। এই উদ্যোগের জন্য আমি তাকে সাধুবাদ জানাই।

০৮. রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক : ভুট্টো বলেন, তার দলের নেতা হিসেবে তিনি চাইবেন সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে- তিনি জোর দিয়ে বলেছে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রত্যাশা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তার একই প্রত্যাশা। মার্কিন জনগণের সুবিধিত সহৃদয়তার কথা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও আর্থিক সহায়তার ওপর তিনি জোর দেন। আমি ভুট্টোকে আশ্বস্ত করি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে আমার দেশ বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় এবং যতটা সম্ভব পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে তার দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাধারণ নির্বাচনে তার দলের লক্ষণীয় সাফল্যের জন্য তাকে অভিনন্দন জানাই এবং প্রত্যাশা করি পাকিস্তানে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হবে।

০৯. আলোচনার শেষে ভুট্টো আমাকে তার এলাকা লারকানা সফরের আমন্ত্রণ জানান গর্বের সঙ্গে তার ব্যতিক্রমধর্মী লাইব্রেরি ঘুরিয়ে দেখান ও নেপোলিয়নের ওপর নতুন ও পুরনো গ্রন্থের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ফেব্রুয়ারির ১২-১৩ তারিখে পেশোয়ারে আমাদের আবার দেখা হবে- আমরা সম্মত হলাম। ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি দুজনের সাক্ষাৎ করেছেন, ববে আলোচ্য বিষয় ছিল ভিন্ন। তার আরো দুদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো তার কুখ্যাত ‘পেশোয়ার ঘোষণা’ দিলেন : পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবে না। তিনি বলেন, একটি দলের হাতে এরই মধ্যে তৈরি হওয়া সংবিধান পাস করাতে এবং অপদস্ত হয়ে ফিরে আসার জন্য আমরা সেখানে (ঢাকায়) যেতে পারি না। যদি আমাদের কথা শোনা না হয়, যদি এমনকি যুক্তিযুক্ত প্রস্তাবও বিবেচনায় আনা না হয় তাহলে আমাদের সেখানে যাওয়ার কোনো মানে নেই।

আমাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ছয় দফা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলিনি, কিন্তু যারা ছয় দফার তীব্র সমালোচনা করেছেন, আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় তারাই এখন ছয় দফার প্রশংসা করে বেড়াচ্ছেন। বর্তমান অবস্থায় আমি আমার দলের ৮৩ জন নেতাকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বিপদাপন্ন হতে পারি না। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টোর এই পেশোয়ার ঘোষণাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি হঠকারী ও কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করল। তার লারকানায় বাড়ি পরিণত হলো পাকিস্তানের পূর্বাংশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘরে। ভুট্টোর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাকের একটি সংবাদ শিরোনাম : ‘আগুন লইয়া খেলিবেন না : গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীদের প্রতি আওয়ামী লীগ প্রধানের হুঁশিয়ারি’।

‘জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি কর্মীসমূহের যৌথ অধিবেশনে এক নীতিনির্ধারণী ভাষণদানকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিস্টপন্থা পরিহার করে গণতন্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরু শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানান। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার উদ্দেশ্যে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীদের প্রতি আগুন লইয়া খেলা হইতে বিরত থাকার জন্য তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমার ও ৬ দফার মোকাবিলার জন্য সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার চক্রান্ত চলছে। জনগণের দেয়া অধিকারের বলে ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র রচিত হবে। সাত কোটি বাঙালির বুকের ওপর মেশিনগান বসিয়েও কেহ ঠেকাতে পারবে না।’

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App