×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংক রাজ্যে নৈতিকতার চরম খরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৪০ পিএম

সুনিপুণ ছকে নিখুঁত লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়মের উৎসব ব্যাংকিং সেক্টরে। জড়িতরা ধরেই নিচ্ছে, দু-চারটা ঘটনা ধরা ধরা পড়লেও শেষতক তাদের কিছু হবে না। বাস্তবেও তাই। কয়েকদিন গণমাধ্যম বা সংশ্লিষ্ট মহলে গরম আলোচনা ছাড়া কারো তেমন কিছু হচ্ছেও না। এককভাবে বিগশট কাউকে ধরা হলে সোজা-সাপ্টা বলে দিচ্ছেন- ‘এ জন্য আমি একা দায়ী নই, অনেকেই দায়ী। এ ঘটনায় আরো অনেকের নাম আসা উচিত।’

যুক্তি এবং সাফাই কিন্তু বড় কড়া। কোনো দুর্নীতি বা লুটপাট একা হয় না। এটি সংঘবদ্ধ ক্রিয়াকর্ম। অনেকের শরিকানাতেই সম্পন্ন হয়। লাভবান অংশীজনরা বড় মাপের মানুষ। ব্যাংকের টাকা লোপাটকারী, ঋণখেলাপি, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে দেশের অর্থসম্পদ করায়ত্তকরণে যাদের নাম আসে তাদের কেউই সাধারণ মানুষ নন। অসাধারণ ‘নক্ষত্রমণ্ডলী’র সদস্য। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট, ডেসটিনি, পি কে হালদার, সম্রাট, এনু-রূপম, শাহেদ, জেকেজি, ড্রাইভার মালেক, মিঠু গং, ফরিদপুরের রুবেলবর্গের ব্যাংকিং সেবা পেতে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে? উপরন্তু দুষ্কর্মে তাদের সেবায়েত প্রচুর। ব্যাংকের লোকরা তাদের সেবা দিয়ে ধন্য। শখ বা লোভ জাগলেও ব্যাংকের টাকা লুট, ঋণখেলাপ, টাকা পাচারকার সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। পাঁচ-দশ হাজার টাকা জমা বা উত্তোলনেও কত হাইকোর্ট দেখানো হয় তাদের। আর দুই-চার লাখ টাকা ঋণ নিলে তো জীবন তামা করে ফেলছেন ব্যাংকের লোকরা।

অবস্থাটি চলতে থাকলে কেবল আমানতকারী বা ব্যবসায়ী নয়, বিদেশি এবং দেশের কমিটেড বিনিয়োগকারীরাও এক সময় ব্যাংকবিমুখ হয়ে যাবেন। তখন প্রণোদনা দিয়েও তাদের ফেরানো যাবে না। এরই মধ্যে লক্ষণ খারাপ ঠেকছে। করোনা মহামারির জেরে বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় কমে গেছে। ব্যাংকগুলো সম্পর্কের ভিত্তিতে বিভিন্ন কৌশলে সিএসএমই, কৃষি, রিটেইল, ক্রেডিট কার্ডসহ ছোটদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা আদায় ভালোই করেছে। কিন্তু বড়দের কাছেও ঘেঁষতে পারছে না।

সরকারের এখানে করণীয় অনেক কিছু নেই। এরপরও অনিয়ন্ত্রিত খেলাপি ঋণ ও খেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়ে আসছে সরকার। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লাগাতার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তৎপর। খেলাপি ঋণ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে সরকারি-বেসরকারি অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তনও আনা হয়েছে। কিন্তু ফল আসেনি। কেন ফল আসেনি? কোথায় গলদ? ঋণ আমানতের ‘নয়ছয়’ ফর্মুলা এবং ঋণের সুদ ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ফলোআপ নেই কেন? এসব প্রশ্ন উহ্যই থেকে যাচ্ছে। এমনকি এ নিয়ে উচিত কথায়ও এখন ঘাটতি। বলে বা লিখে আর কিছু হবে না- এমন একটি বোধ কারো কারো মধ্যে। ব্যাংক বাণিজ্যিক খাত হলেও উলঙ্গ বাণিজ্যের লীলাভ‚মি নয়। কিন্তু সগৌরবে সেটাই চলছে। বিশেষ করে প্রাইভেট ব্যাংকে। এসব ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেরাই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে রেখেছেন। আগে তারা অন্য ব্যাংকের টাকা মারতেন। এখন নিজেরা ব্যাংক করে জনগণের টাকা মারার লাইসেন্সধারী।

খাতটিতে ঐশ্বর্যের সঙ্গে বিশ্বস্ততা ও বিচক্ষণতার রসায়ন জরুরি। ঐশ্বর্য দরকার ব্যাংকের পর্যাপ্ত পুঁজির জন্য। ব্যাংক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য চাই বিচক্ষণতা। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য দরকার সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ততা। বর্তমানে এ সেক্টরে তিন উপাদানেরই বড় আকাল। যা ব্যাংকসহ গোটা অর্থ সেক্টরের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংককে নিয়ে যাচ্ছে ঠুনকো প্রতিষ্ঠানে। ব্যাংক মানুষ নয়। প্রাকৃতিক কিছুও নয়। তাই এর নিজস্ব বিবেক নেই। কৃত্রিম হওয়ার পরও ব্যাংকের লেনদেন প্রকৃত মানুষের সঙ্গে। আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সত্তা আছে। আইনের সৃষ্ট কৃত্রিম সত্তাগুলো নৈতিকতা অগ্রাহ্য করতে পারে না। ব্যাংকের বোর্ডের সদস্যরা এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মানুষ। যারা বিবেক দ্বারা গঠিত ও তাড়িত। তাই মালিকসহ ব্যাংকে কর্মরতদের ব্যক্তিগত নৈতিক দায় এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাদের স্বভাব-চরিত্র এবং ব্যক্তিগত গুণাবলির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাদের দায়বোধ মানবিকতার বাইরে চলে যাওয়ার একেকটি ঘটনা ব্যাংকের আমানতকারীসহ মানুষকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে টাকা সৃষ্টি ও ধ্বংসের ম্যাজিক দেখাচ্ছে সামনে তা কোন প্রলয়ে গড়াবে ভাবলে ক‚লকিনারা মেলে না।

আদর্শ ব্যবস্থায় ব্যাংকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নৈতিকতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তিকে নৈতিক আদর্শ ও রীতিনীতি মেনে চলার ব্যাপার রয়েছে। এ কথাও ঠিক ব্যাংকের মতো কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের সবাই কোনো দিনই এক ধরনের নৈতিক নীতি অনুসরণ করবে না। তবে ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার ন্যূনতম উপস্থিতি জরুরি। যা নির্ধারণ হয় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে। যার লক্ষ্য ক্রেতা ও সেবা গ্রহণকারীকে সন্তুষ্ট করা, টেকসই কার্যক্রম পরিচালনা, সর্বোপরি প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন। এ প্রসঙ্গে হংকং মুদ্রা কর্তৃপক্ষের ডেভিড কার্সের বিশ্লেষণ না করলেই নয়। তার মতে, ব্যাংকে উঁচুমানের নৈতিকতা বিলাসিতাও নয়, বিমূর্ত ধারণাও নয়। তা ব্যাংকের সুনাম রক্ষা করে ও বাড়িয়ে দেয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে এর বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চিত করে। এই নৈতিকতা কেবল কর্তব্য নয়, লাভজনকও বটে।

অপ্রিয় সত্য হচ্ছে- নৈতিকতা নিয়ে দর-কষাকষি চলে না। হতে পারে বাস্তব জগতে আপসহীন নৈতিকতার বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব নয়। তারপরও নৈতিকতা ব্যাংকিং ব্যবসাসহ মানুষের সব কর্মকাণ্ডে একটি পুঁজি বা শক্তি। ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব অন্য কোনো ব্যবসার মতো নয়। ব্যাংকের ঘাড়ে কেবল অন্যের অর্থ হেফাজতের দায়িত্ব নয়, ব্যাংককে অতিরিক্ত অর্থ তৈরির গ্যারান্টি দিতে হয়। তা আবার নতুন আমানত হিসেবে ফিরিয়ে আনার পথও তৈরি করতে হয়। তা নির্ভর করে বাজারে ব্যাংকের সুনামের ওপর। এর বিপরীতে আস্থার খেলাপ দুষ্টচক্র জন্ম দেয়। ব্যাংকের ক্রিয়াকলাপে নৈতিকতার সংকটই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি ব্যাংক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মতো। ঝুঁকি এড়ালে মুনাফা কমে। আবার অতিরিক্ত মুনাফা হাতাতে গেলেও ঝুঁকি আছে। যা ব্যাংকের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলতে পারে। যা ব্যাংক-ব্যবস্থায় আতঙ্ক ও টাকা তুলে নেয়ার হিড়িক জাগায়। তা করপোরেট, যৌথ, ব্যক্তি সব পর্যায়েই।

সম্প্রতি আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকে ঝুঁকির তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন গজানো ব্যাংকও অনেক ঝুঁকি নিচ্ছে। এর বিপরীতে বিশ্বায়নের ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন সুযোগও এসেছে। দুই ক্ষেত্রেই নৈতিকতার বিষয়-আসয় রয়েছে। নৈতিকতা ব্যাংকের কার্যপ্রণালি নয়, অস্তিত্বের ভিত্তি। ব্যাংকের নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে দুই ধরনের চরমপন্থি মতামত রয়েছে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, ব্যাংকের দায়িত্ব হলো আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত পালন সাপেক্ষে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা। আরেক চরমপন্থি মতবাদ নৈতিক ব্যাংক। যা বিকল্প ব্যাংক, সামাজিক ব্যাংক এবং সমমনা ব্যক্তিদের অর্থায়ন নামে পরিচিত। হতে পারে ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব বাস্তবায়নের জন্য গতানুগতিক ব্যাংক বা নৈতিক ব্যাংক কোনোটিই যথেষ্ট নয়। নৈতিকতা বলবৎ করতে বিবেকের তাড়না দরকার। আইন ও আচরণবিধি বাস্তবায়ন করে ব্যক্তি। মোটকথা চ‚ড়ান্ত বিচারে নৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলার মূল দায়িত্ব হলো ব্যাংক যারা চালান তাদের। এটা শুধু তাদের যৌথ দায়িত্ব নয়, তাদের ব্যক্তিগত নৈতিক দায়িত্বও।

ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনার উৎপত্তি নৈতিক বিচ্যুতির কারণেই। ব্যাংকের কর্মচারীদের ক্রিয়াকাণ্ডে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিফলনের আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যৌথ নৈতিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে মুখ্য ভ‚মিকা হচ্ছে পরিচালনা পরিষদের এবং শীর্ষস্থানীয় নির্বাহীদের। মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনাই ব্যাংকের সাফল্যের বড় দাওয়াই। সেই দাওয়াইর মধ্যেই ভেজাল থাকায় আশার জায়গাটা সীমিত হয়ে আসছে। সেখানে জায়গা করে নিতে চাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। চিরাচরিত ব্যাংক-ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা না থাকলেও মাথা ঢুকাতে শুরু করেছে তারা। তা হায় হায় কোম্পানির চরিত্র নিয়েও। নৈতিকতার ভয়াবহ আকাল সেখানেও।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App