×

পুরনো খবর

মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণের জন্য জরুরি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৪৪ পিএম

রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সেনাবাহিনীর প্রভাব এবং ক্ষমতা কমে গেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যে বিরাট এবং বিপুল অবৈধ ব্যবসা সেটাও হুমকির মুখে পড়বে। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটনের বিচার হচ্ছে। সেখানেও যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হয়, তার সব দায়-দায়িত্ব তৎকালীন সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল মিন অং হ্লাইংকেই নিতে হবে। ফলে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে গেলে অনেকটা অনিবার্য ছিল।

যুগে যুগে সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের যে ইতিহাস, ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ, তাতে মোটামুটি ‘স্টেরিওটাইপ’ ঘরানার একটা তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে। কেননা অভিজ্ঞতা হচ্ছে তত্ত্ব উৎপাদনের প্রাথমিক মালমসলা। আর অভিজ্ঞতার সাম্যতা তত্ত্বায়নের ন্যায্যতা এবং তত্ত্বে কার্যকারিতাকে নিশ্চিত করে এবং বৈধতা দেয়। তাই পৃথিবীর দেশে দেশে যত সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, তাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের ভাষ্যানুযায়ী প্রধানত গণতন্ত্র রক্ষার নামে, জনগণের অধিকার সুরক্ষার নামে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে এবং সরকারকে গণবিক্ষোভ থেকে রক্ষার নামে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। দখলের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের কাছে ‘জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের এ নির্দিষ্ট সময় সবসময় অনির্দিষ্ট সময় ধরে চলতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার অসংখ্য নজির আছে। বাংলাদেশেও দুই সামরিক সরকার জনগণের নামে, জনগণকে রক্ষার নামে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে ১৫ বছর (১৯৭৫-১৯৯০) রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ছিল। মিয়ানমারেও ঠিক তাই হয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার চুরি হয়েছে, তাই জনগণের বিক্ষোভের মুখে এবং গণবিক্ষোভ থেকে সু কি সরকারকে রক্ষা করতেই সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছে। সেই পুরনো চিত্রনাট্য। শুধু মঞ্চটা আলাদা। মিয়ানমার। যদিও এ মঞ্চে ১৯৬২ সালে এবং ১৯৮৮ সালে আরো দুবার এ চিত্রনাট্যের প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে যে জনগণের বিক্ষোভ থেকে সু কি সরকারকে বাঁচানোর জন্য বা জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য সামরিক অভ্যুত্থান করেছে বলে দাবি করেছে সামরিক বাহিনী, সে জনগণই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধে আজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় উত্তাল প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা ফেরত দেয়ার জন্য মিয়ানমারের শহরে শহরে এবং গলিতে গলিতে স্লোগানমুখর যে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেটা মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণের জন্য জরুরি। কেননা ১৯৬২ সালের পর মিয়ানমারে গণতন্ত্র বলে কোনো কিছুই কখনো ছিলই না। যদিও ২০১১ সালের পর মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়ণ শুরু হয়েছে বলে নানান কথা বাজারে জারি আছে কিন্তু সেটা ছিল সামরিক ছত্রছায়ায় এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে গণতন্ত্রের একটা মুখোশ। তাই আজকে মিয়ানমারে যে আওয়াজ উঠেছে এবং মিয়ানমারের নানান শহরে সে আওয়াজের ভেতর গণতন্ত্রের জন্য একটা তীব্র আকুতি আমি শুনতে পাই। ২০১১ সালের পর একটি নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করে মিয়ানমারের জনগণ সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তাই মিয়ানমারে চলমান বিক্ষোভ কেবল সু কিকে মুক্ত করা নয়; বরঞ্চ মিয়ানমারের সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণের জন্যও সমান জরুরি। তাছাড়া দেশের হাজার হাজার আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ যারা বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনীর নানান অত্যাচার, নির্যাতন এবং জুলুমের শিকার হয়েছে, তারাও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভ সমাবেশে শামিল হচ্ছে এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণের জন্য যে আকুতি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে তার সঙ্গে গলা মিলাচ্ছে। আর এ ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমবিস্তরমান কোরাসে গলা মিলিয়ে বলছে, ‘সামরিক সরকার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। মিয়ানমারের সিভিলিয়ান সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব চলছিল অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু সেনাবাহিনী একটা মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখ মিয়ানমারে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টির ভরাডুবি হয় এবং সু কির নেতৃত্বাধীন পার্টি ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি প্রায় ৮৩ শতাংশের বেশি ভোট পায়। এতে করে সেনাবাহিনীর যে গণভিত্তি সেটা মোটামুটি নড়বড়ে হয়ে যায়, যা সেনাবাহিনী মেনে নিতে পারেনি। বিবিসি জানাচ্ছে যে, ‘এতে করে সেনাবাহিনী বেশ অপমান বোধ করে’। রয়টার্স বিশ্লেষণ করছে এভাবে যে, ‘ভোটের ফলাফল জনগণের কাছে সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ার সাক্ষ্য বহন করছে’। এদিকে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং নবনির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রপতি হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সু কি তাতে রাজি না হওয়ায় সেনাপ্রধানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সেনাবাহিনীর প্রভাব এবং ক্ষমতা কমে গেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যে বিরাট এবং বিপুল অবৈধ ব্যবসা সেটাও হুমকির মুখে পড়বে। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটনের বিচার হচ্ছে। সেখানেও যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হয়, তার সব দায়-দায়িত্ব তৎকালীন সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল মিন অং হ্লাইংকেই নিতে হবে। ফলে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে গেলে অনেকটা অনিবার্য ছিল। এ রকম একটি অবস্থায় সু কি এবং রাষ্ট্রপতিকে গ্রেপ্তার করে ১ ফেব্রুয়ারি নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদের বসার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে সু কি এ অভ্যুত্থান মেনে না নিয়ে, প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান। প্রথম দুয়েকদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। এ বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে বড় আকার ধারণ করছে। বিক্ষোভের চরিত্র, আকার এবং প্রকৃতি দেখে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ বিক্ষোভ যতটা না সু কিকে মুক্ত করার জন্য, ততটা সেনাবাহিনীর হাত থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করার জন্য। ১৯৬২ সালের পর থেকে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকতে থাকতে মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রায় মৃত্যুর মুখে। এ রকম একটি অবস্থায় ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করে সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ রেখে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর কব্জায় রেখে এবং সেনাবাহিনীর প্রধানকে কমান্ডার ইন চিফ করার বিধান রেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অবস্থানকে পাকাপোক্ত করা হয়। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের দশা যে কাহিল হওয়ার জোগাড় সেটা সহজেই অনুমেয়। তবু গণতন্ত্রের সামান্য স্বাদ মিয়ানমারের জনগণ পেয়েছে ২০১৫ সালে সু কির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে এনএলডি না পেরেছে নিজের মতো রাষ্ট্র পরিচালনা করতে, না পরেছে জনগণকে গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাস দিতে। এমতাবস্থায় একটা সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ নেয়ার প্রত্যাশায় যখন ৮৩ শতাংশ মানুষ এনএলডিকে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী করায়, জনগণের সে আশা-আকাক্সক্ষা সেনাবাহিনী পুনরায় ছিনিয়ে নেয়। ফলে জনগণের পক্ষে রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এবং জনগণের এ গণবিক্ষোভ যদি সু কিকে মুক্ত করতে পারে সেটা হবে গণতন্ত্রের বিরাট বিজয়। আমরা জনগণের সামরিক সরকারবিরোধী এবং গণতন্ত্রের মুক্তির এ বিক্ষোভকে সমর্থন করি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু কির অবস্থানকে নিন্দা করলেও মিয়ানমারের মেজরিটি জনগণের কাছে গণতন্ত্রের শেষ প্রদীপটি যে সু কি এটা আমি বিশ্বাস করি। এটা অনস্বীকার্য যে, এ মুহূর্তে মিয়ানমারের সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণের জন্য সু কির কোনো বিকল্পও নেই। তাই সু কির ক্ষমতাচ্যুত হওয়া, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য জনগণের বিক্ষোভকে রোহিঙ্গা নিপীড়নের আয়না দিয়ে দেখলে হবে না। বরঞ্চ এ বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে যদি মিয়ানমারে সত্যিই গণতন্ত্র আসে, সেটাই হবে বাংলাদেশের নগদ লাভ। কেননা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সামরিক বাহিনীর হাতেও নেই, সামরিক ছত্রছায়ায় বেসামরিক গণতান্ত্রিক নাটকেও নেই। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিহিত আছে মিয়ামারের সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণে। সেই সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণের প্রত্যাশায় জনগণের বিক্ষোভের সাফল্যের জন্য শুভ কামনা। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App