×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৫১ পিএম

পারমিতার জগৎ

বড় মেয়ে আর মেজো মেয়ের জামাই আলাপ-আলোচনা করে আজই তারিখটা নিশ্চিত করলো। আপনার দিক থেকে যদি কোন আপত্তি না থাকে, তাহলে আগামী মাসের ১৪ তারিখ শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করতে চাই। সব দিক থেকেই দিনটা ভালো।.....কী কথা বিয়াই সাহেব?.......তা তো নিশ্চয়ই। তবু কথাটা কোন বিষয়ে, যদি একটু ধারনা দিতেন, তাহলে আমার আলাপের আগেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হতো।.....আপনি কি আমার বাসায় আসবেন?....আচ্ছা ঠিক আছে এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে চলে আসুন। দু’জনের কথা শেষ হলো। আব্বার চোখে-মুখে দুঃশ্চিন্তার একটা ছায়া প্রকট হলো। মা আব্বার চেহারা দেখেই অশনি সংকেত টের পেলেন, প্রশ্ন করলেন, “কী হলো? কী বললেন তিনি? তোমার মুখটা কেনো ভার হয়ে গেল?” আব্বা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন, “না তেমন কিছু বলেননি। শুধু বললেন, আগামীকাল আমার সাথে দেখা করে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবেন। কী কথা বলবেন, তা তো বুঝতে পারলাম না।” আব্বার কথায় মা’র দু’চোখেও দুঃশ্চিন্তা ছড়ালো; “উনি কি বড় কোনো সংকটের কথা বললেন? শুভ কাজে কি বাধা পড়লো?” মা’র কথায় আব্বা কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, “কেনো যে সবকিছু নেগেটিভ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করতে চাও! বললাম তো, উনি কিছুই বলেননি। কালকে দেখা হলে বুঝতে পারবো বিষয়টা কী। যাও নিজের কাজ করো। আমি একটু বেরুচ্ছি।” আব্বা বেরিয়ে গেলেন, মা-ও নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন। আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে ভাবনায় নিমগ্ন হলাম। নাজনীন-এর সাথে কীভাবে দেখা হতে পারে, কোথায় কিছুক্ষণ বসে কথা বলা যায়, তাই নিয়ে ভাবছি; ঠিক সেই সময় বাসার ফটকে কেউ কড়া নাড়লো, বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে এলো, সে আমাকেই খুঁজছে, আমি তাকে কাছে ডাকলাম, “কোত্থেকে এসেছো তুমি?” ছেলেটা কিছুটা লজ্জিত মুখে বললো, “নাজনীন আপা আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে।” আমি বিস্মিত হলাম ছেলেটির কথা শুনে, এ যেনো- ‘আমি চাইলাম, বৃষ্টি এলো, পুষ্প সুরভিত হলো দিন।’ প্রশ্ন করলাম, “নাজনীন কি কোনো খবর বলেছে?” মাথা নাড়িয়ে ছেলেটি জানালো, কোন খবর বলেনি নাজনীন, বুকপকেটে হাত দিয়ে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলো। হাতে নিয়েই আমি উত্তেজিত; কাগজটা খুলে মেলে ধরলাম চোখের সামনে, নাজনীন লিখেছে—

পারমিতা প্রিয়তা, শুভেচ্ছা-ভালোবাসা। খুব একটা সংকটে পড়ে তোমার শরণাপন্ন হলাম। জানি না কোন পথে মুক্তি আসবে। আদৌ সংকটমুক্ত হবো কি-না, তা-ও জানি না। তবু আমি তোমার সাথেই পরামর্শ করতে চাই; হয়তো মুক্তি আসবে না, কিন্তু মনের প্রশান্তি নিশ্চয়ই আসবে। গতকাল যেখানে দেখা হয়েছিলো, আজ বিকাল চারটায় সেখানেই এসো। খুব জরুরি কথা আছে। তোমারই নাজনীন।

চিরকুট থেকে চোখ তুলে দেখি ছেলেটা চলে যাচ্ছে। ওকে ডাকলাম, “এই ছেলে চলে যাচ্ছো কেনো? এদিকে এসো।” ছেলেটা ফিরে এলো। প্রশ্ন করলাম, “নাজনীন কী হয় তোমার?” ছেলেটি মৃদুস্বরে বললো, “কিছু না। আমি নাজনীন আপার পাশের বাসায় থাকি।” ছেলেটির হাত ধরে আমি তাকে বসার ঘরে টেনে আনলাম; সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললাম, “একটা কিছু খেয়ে যাও। নাজনীনকে বলো, আমি যথাসময়েই চলে আসবো।” ওকে চিড়ার লাড়ু-মুড়ির লাড়ু খেতে দিলাম, ঘরে ওগুলোই ছিলো। ছেলেটা একটা লাড়ু খেয়ে উঠলো। যাবার সময় আমি একটা কাগজের ঠোঙায় অবশিষ্ট লাড়ুগুলো ওকে জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলাম। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। আমি উদ্বেগ নিয়ে বসে থাকলাম। চারটায় ব্রহ্মপুত্রতীরে নাজনীনের সাথে আমার দেখা হলো। সামান্য কয়েক মিনিট দু’জন হাঁটলাম, তেমন কোন কথা হলো না; আজও নদীতীরে খঞ্জনা ছিলো, গাঙ্গচিল ছিলো, মেছো ঈগলের তৎপরতা ছিলো, কিন্তু আজ কেউ আকর্ষণ করলো না। নাজনীন প্রস্তাব করলো, “চলো দু’জন নৌকায় চড়ে বেড়াই। নৌকায় বসে কথা বলি।” যেই কথা, সেই কাজ। বড় একটা ডিঙি নৌকায় চড়ে বসলাম দু’জন। নৌকা চললো উজানের দিকে। নৌকায় ছোট একটা পাল ছিলো, পালে হাওয়া ধরলে নৌকা উজানে চললো। নৌকার একপ্রান্তে মাঝি, অন্যপ্রান্তে আমরা দু’জন। বাদাম খেতে খেতে আমাদের আলোচনা এগোলো। : পারমিতা, তুমি কি সুমন ভাইয়াকে চেনো? : কোন সুমন ভাইয়া? : নব্য রাজনৈতিক নেতা; স্টেশন রোডে ‘ইন্দ্রাণী ইলেক্ট্রনিক্স’ নামে একটা দোকান আছে তার। : ঠিক চিনি না, তবে কিছুটা জানি, পথালিয়ায় বাড়ি তো? : হুম। সুমন ভাই আমার মামাতো ভাই; মামাতো ভাই, মানে আমার মা’র মামাতো ভাইয়ের ছেলে। সুমন ভাই কয়েক বছর আগেও ছিলো ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি; হঠাৎ যেনো আলাদীনের চেরাগ পেয়ে রাতারাতি ঠিকাদার-ইলেক্ট্রনিক্স ব্যবসায়ী হয়ে গেলো! তার এ প্রাপ্তির রহস্য কেউ জানে না। : আমি মনে হয় কিছুটা জানি। : তুমি জানো? : ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর ১৯৭৬-এ জিয়াউর রহমান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন, ১৯৭৭-এ জিয়া উর্দি গায়ে যখন জাগদল গঠন করতে চাইলেন, তখন তোমার সুমন ভাইয়া হলো সাহসী ভাগ্যবান। জিয়াউর রহমান যখন খালকাটা বিপ্লব করছেন, তখন তিনি ব্রহ্মপুত্র খননের জন্য আসেন, তখন সৌভাগ্যক্রমে তোমার সুমন ভাইয়া জিয়াউর রহমানের সাথে পরিচিত হন, জিয়াউর রহমানের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ে যায় সে। সবাই জেনে যায়, তোমার সুমন ভাইয়া জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠজন। আর সে সেই সুযোগটাই কাজে লাগায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ পেতে থাকে নিয়মিত। রাতারাতি অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যায়। আটাত্তরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখন তোমার সুমন ভাইয়া সেই দলের প্রভাবশালী নেতা হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য তার, সে তেমন উচ্চশিক্ষিত নয়, হলে আরও বড় নেতা-এমপিও হয়ে যেতো। : এতো কথা তুমি কীভাবে জানলে তার সম্পর্কে? : ১৯৭৮-এ জামালপুর মহকুমা জেলায় উন্নীত হলে; তার ভাগ্য আরও খুলে যায়। : আমি তো অবাক হচ্ছি! আমার ভাই সম্পর্কে আমি যতটা জানি, তুমি তো তারচেয়েও অনেক বেশি জানো! : হয়তো বা জানি; কিন্তু তার প্রসঙ্গ আমার সাথে কেনো আলোচনা করছো তুমি? নাজনীন কিছু বলতে গিয়ে আমার চোখে তাকিয়ে হঠাৎ অশ্রæসজল হলো, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কিছু বলতে গিয়ে নাজনীন কেনো কান্নায় ভেঙে পড়লো? এই প্রশ্ন আমাকে ভাবনায় ফেলেছিলো, সুমন আসলে কী চায়? কেনো সে আমার পিছনে লেগেছিলো? জানা মতে তার সাথে তো আমার কোন বিরোধ হয়নি! মানুষের মনের সন্ধান করা আমার কাজ নয়। তবু ভাবনায় এসে যায় সুমন, আমার বিরুদ্ধে কেনো তার এসব তৎপরতা? নাজনীনকে কিছুটা শান্ত হবার সুযোগ দিলাম, তারপর আমি তাকে আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম, “নাজনীন, তোমাকে একটা কথা বলি; জীবনটাকে কখনো খুব বেশি সরলভাবে ভাববে না; জানবে জীবনের বাঁকে বাঁকে অজস্র বিস্ময় লুকিয়ে আছে, সবসময়ই জীবন সরল রেখায় চলবে, এমনটি ভাববার কোনো অবকাশই নেই; অজস্র সংকট আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াবে বারবার; তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না; মনে রাখবে অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে যাবার নামই জীবন সংগ্রাম। বাধা এলেই ভয় পেতে হবে কেনো, যখন ভয় যে-কোনো সময় মাথার উপর খড়্গ হাতে দাঁড়ায়? ভয়কে জয় করবার সাহস বুকে ধারণ করবার শক্তি অর্জন করো। তোমার যদি আমাকে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে না করে, তাহলে কিচ্ছু বলার প্রয়োজন নেই। আর যদি মনে হয়, আমি তোমার বন্ধু, আত্মীয়তার কথা বাদই দাও! বন্ধু হয়েও তোমার সংকটে সহযোগিতা করতে পারি; যদি বন্ধু ভাবো তাহলে সবকিছু খোলাসা করে ফেলো; হয়তো কাজে লেগে যেতেও পারি।” নাজনীন-এর কান্না থামলো। চোখ মুছে বললো, “পারমিতা, আমি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি, এটা ভেবে নয়, যে তুমি আমার আত্মীয় হতে চলেছো; বরং কথা বলতে চেয়েছি এ জন্য, যে আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি।” নাজনীন-এর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “তাহলে যা বুকের ভেতর আছে, তা অকপট বলে ফেলো।” নাজনীন একটুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলো, তারপর বুকের কোন এক অতল খুঁজে কিছু কথা তুলে আনলো যেন, আর আমার দিকে বৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিলো; কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটাগুলোই বর্শা হয়ে বিঁধলো আমার বুকে। “দেখো পারমিতা, মানুষ যে ক্ষমতা পেলে ধরাকে সরাজ্ঞান করে, তা আমি প্রত্যক্ষ করলাম সুমন ভাইয়াকে দেখে; হঠাৎ ভাগ্যগুণে রাতারাতি বিত্তের মালিক হয়ে এখন সবকিছুই নিজের সংকীর্ণতার চোখে মূল্যায়ন করছে।” নাজনীন-এর কথা থামিয়ে বললাম, “ভাগ্যগুণে নয়, দুর্বৃত্তায়ন করে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে সে!

তুমি বল?” নাজনীন ফুস করে উঠলো, “তার কী অধিকার আমার বিয়ে ভাঙার! তুমি জানো সে ইন্ডাইরেক্টলি আব্বাকে থ্রেট করেছে। তোমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কেও সে আজেবাজে মন্তব্য করেছ! তুমি জানো তোমার সম্পর্কেও সে বাজে কথা বলেছে?” আমি হাসলাম, “নাজনীন, সম্মান যেমন কেউ কাউকে দিতে পারে না, কারো সম্মানও কেউ কেড়ে নিতে পারে না। সম্মান নিজেকেই অর্জন করতে হয়। সম্মান পায় মানুষ তার প্রজ্ঞায়-মনীষায়-দূরদর্শিতায়-সহিষ্ণুতায়! কেবল অর্থই যে সম্মানের উৎস হতে পারে না, তার উদাহরণ তোমার সুমন ভাইয়া। কিন্তু কোন্ অভিযোগ তুলে সে তোমার বিয়ে ভাঙতে বলে?” নাজনীন মৃদু হাসে, “অভিযোগ! ‘দিতাম না দাউয়ের আছাড়ি নাই!’ এরচেয়ে বড় অভিযোগ কী হতে পারে আর? আব্বা এখন আমার বিয়ে নিয়ে বড় টেনশানে আছে। আগামীকাল তোমার আব্বার সাথে দেখা করার কথা; হয়তো ভেঙে দিতে চাইবেন সম্পর্ক।” ওর কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল, “গুরুজনদের কথা বাদ দাও, এ বিয়ের ব্যাপারে তোমার কী মত সেটা আগে বল?” নাজনীন আমার হাতটা চেপে ধরলো দু’হাতে, “তোমার ভাইয়াকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তার মধ্যে আলাভোলা একজন মানুষ আছে, তার জন্য বুকে একটা মায়া জমে গেছে। তুমি যা হয় একটা কিছু কর।” নাজনীন-এর কাঁধে মৃদু ঝাকুনি দিয়ে বললাম, “একদম দুশ্চিন্তা করবে না। অতো সহজে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ আমি নই!”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App