থমকে আছে যুদ্ধাপরাধের আপিল মামলার শুনানি
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৯ এএম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে করা ২৭ আপিল মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় এক বছর বন্ধ থাকায় বর্তমানে ভার্চুয়াল এবং সরাসরি আদালতে বিচারকাজ চললেও গত এক বছরে যুদ্ধাপরাধের দণ্ডপ্রাপ্তদের কোনো আপির শুনানি হয়নি। সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলে বর্তমান পরিস্থিতিতেও যুদ্ধাপরাধের মামলার আপিল শুনানি সম্ভব বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। আর দীর্ঘদিন মানবতাবিরোধী মামলার আপিল শুনানি না হওয়ায় হতাশ বিচারের দাবিতে আন্দোলনকরীরা।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের সর্বশেষ আপিল শুনানি হয় ২০১৯ সালের বছর ৩ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিলের শুনানি হয় সেদিন। ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কায়সারের আপিল আবেদনের শুনানি করে আদালত রায় দেয়ার জন্য ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন। পরবর্তী সময় গত ১৪ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এরশাদ সরকারের সময়ের প্রতিমন্ত্রী ৭৮ বছর বয়সি কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে কায়সার একই বছরের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগে একটি রিভিউ আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনের শুনানি এখনো মুলতবি রয়েছে। এছাড়া জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায় গত বছরের ১৯ জুলাই তিনি রিভিউ আবেদন করেন। বর্তমানে সেটিও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে ২৭টি আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় থাকলেও ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর কোনো আপিলের শুনানি হয়নি। বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে মোবারক হোসেন, মাহিদুর রহমান, ফোরকান মল্লিক, সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম হোসেন, আতাউর রহমান, ওবায়দুল হক তাহের, শামসুদ্দিন আহম্মেদ, মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া, মো. শামসুল হক ওরফে বদরভাই, এস এম ইউসুফ আলী, সাখাওয়াত হোসেন, মো. মোসলেম প্রধান, মো. আব্দুল লতিফ, ইউনুছ আহমেদ, মো. আমির আহম্মেদ ওরফে আমির আলী, মো. জয়নুল আবেদীন, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. রিয়াজ উদ্দিন ফকির, মো. আকমল আলী তালুকদার, মো. ইসহাক শিকদার এবং আব্দুল জব্বারের আপিল আবেদন।
গত আট বছরে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আবেদনসহ এ পর্যন্ত মাত্র ৯টি আপিল নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম ও জামায়াতে ইসলামীর আরেক নেতা আবদুস সোবহান মারা যাওয়ায় কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে তাদের করা তিনটি আপিল বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্ট।
এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী, এ টি এম আজাহারুল ইসলাম এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায় নিশ্চিত করে শীর্ষ আদালত তাদের রিভিউ আবেদন খারিজ করার পর তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বর্তমানে কারাগারে আছেন।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর সংশোধনী আসে। সংশোধনীতে ৬০ দিনের মধ্যে সাজার বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির বিধান রাখায় আশা করা হয়েছিল যে, সুপ্রিম কোর্ট মামলাগুলোর রায় দ্রæত দেবেন। কিন্তু তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ আইনজীবীরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করার বিধান কেবল একটি নির্দেশনা, বাধ্যতামূলক না।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল দীর্ঘদিন শুনানি না হওয়াটা খুবই দুঃখজনক। প্রথম দিকে কয়েকটি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর থেকে এসব মামলার আপিল শুনানি থমকে যায়। দুটি ট্রাইব্যুনালকে একটি করা হয়। এরপর থেকে আর যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল নিষ্পত্তিতে গতি ফেরে নাই। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ৪০ বছর পর শুরু হওয়া এই বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার দাবি জানিয়ে আসছি। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাইব্যুনালের ভিতরেই একটি বিশেষ আপিল বেঞ্চ করে দিতে পারেন। এতে সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত মামলা শুনানিতে বিঘ্ন ঘটবে না, একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের এসব আপিলও দ্রæত নিষ্পত্তি হবে। তিনি আরো বলেন, এখনো যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত সংগঠনের বিচার শুরু করতে পারিনি। এমনকি পাকিস্তান হাইকমিশনকেও বিচারের মুখোমুখি আনতে পারিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা হচ্ছে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। এখন শুধু পুরনো মামলার শুনানি চলছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেব।