×

পুরনো খবর

আমেরিকার বহুসংস্কৃতি, বহুত্ববাদের সূত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৭ পিএম

বাংলাদেশি এবং ভারতীয়দের নিয়োগ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো বেগবান হতে পারে। জো বাইডেন তার প্রশাসনের নিয়োগে নারী-পুরুষ, বর্ণবিদ্বেষ সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছেন। আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বংশোদ্ভূত মানুষগুলো দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে ফেলো আমেরিকানদের বলেছেন, বাইডেনকে ভোট দিন।

আমেরিকার সিনেটে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের শুনানি চলাকালীন সময়ে উচ্চারিত হলো বাংলার নাম। ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের শুনানি সাংবিধানিকভাবে বৈধ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল সিনেটে। হাউস ইমপিচমেন্টের ম্যানেজার জ্যামি রাসকিন বলেন, ‘আমেরিকান সংবিধানের অনেক ধারণাই ব্রিটেন থেকে ধার করা। বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সময় বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। হেস্টিংস ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম স্থপতি ছিলেন। হেস্টিংস ১৭৮৫ সালে গভর্নরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ব্রিটেন ফিরে যান। শাসক থাকাকালীন অপকর্মের অভিযোগে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সেই দুর্দান্ত প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসক। তারপর ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে তার ইমপিচমেন্টের শুনানি চলে। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, জোর করে অর্থ আদায় এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মহারাজ নন্দকুমারকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হাউস অব লর্ডসে সেসব অভিযোগ থেকে মুক্তি পান হেস্টিংস। কিন্তু শাসনক্ষমতা ত্যাগের পরও তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট হয়েছিল।’ সেই উদাহরণ টেনে রাসকিন আমেরিকার সিনেটে যুক্তি দেন যে, বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল দুর্নীতিপরায়ণ ওয়ারেন হেস্টিংসের ক্ষমতা ত্যাগের পর ইমপিচমেন্টের নজির বিদ্যমান। ওই একই বিষয় ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে রাসকিন যুক্তি তুলে ধরেন। শেষ পর্যন্ত শুনানি শুরু করার পক্ষেই সিনেট রায় দিয়েছিল। মাত্র ৩০ থেকে ৪০ বছর আগের কথা বলছি। আমেরিকা-কানাডাতে এদেশের সাদা নাগরিকদের বাংলাদেশি বললে, তারা ভ্রু কুঁচকে বলত, ‘ব্যাংলাদেশ ঠিক কোথায়?’ আজ ভিন্ন চিত্র এ দেশগুলোতে। আমেরিকার নির্বাচন হয়ে গেল সবেমাত্র। জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন। বিস্ময়করভাবে লক্ষণীয় যে, বাইডেন প্রশাসনে এবার বাংলার কিছু নতুন মুখ জ্বলজ্বল করে উদ্ভাসিত হচ্ছে। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদেরও এবার জয়জয়কার। আমেরিকার নতুন বাইডেন প্রশাসনে ব্যাপক অংশগ্রহণ করে বেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের বংশোদ্ভূতরা। আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন প্রশাসনে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জায়েন সিদ্দিকী। তিনি হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফের সিনিয়ার অ্যাডভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ফারাহ আহমেদ। ফারাহ আহমেদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পল্লী উন্নয়ন সচিবালয়ের আন্ডার সেক্রেটারির চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তৃতীয় ব্যক্তি রুমানা আহমেদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম টিমের অংশ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাজী সাবিল মার্কিন প্রশাসনের হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কাউন্সিলর পদে নিয়োগ লাভ করেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বঙ্গ-তনয়া সুমনা গুহকে দেখা যাবে বাইডেন-হ্যারিস সরকারের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত বিদেশনীতি বিভাগে। জো বাইডেনের প্রশাসনে এসোসিয়েট অ্যাটর্নি জেনারেল পদে দেখা যাবে বনিতা গুপ্তকে। ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত নেহা গুপ্তকে দেখা যাবে হোয়াইট হাউসের এসোসিয়েট কাউন্সিলর পদে। আরেক বঙ্গ-তনয়া সোহিনী চট্টোপাধ্যায়কে দেখা যাবে বাইডেন প্রশাসনের অন্দরে। জাতিসংঘে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের নীতি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করবেন সোহিনী। গরিমা বর্মাকে পছন্দ করেছেন ফার্স্টলেডি জিল বাইডেন। তিনি কাজ করবেন আমেরিকার ফার্স্টলেডির ডিজিটাল ডিরেক্টর হিসেবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পার্সোনেল অফিসে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত গৌতম রাঘবন। হোয়াইট হাউসের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজির অফিসে পার্টনারশিপ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করবেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং কাশ্মির থেকে আমেরিকায় আসা তাইশা শাহ। হোয়াইট হাউসের ডোমেস্টিক ক্লাইমেট পলিসি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন সনিয়া আগরওয়াল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত শান্তি কালাথিন কাজ করবেন বাইডেন প্রশাসনের মানবাধিকার বিভাগে। গুজরাটের বেদান্ত পাটেল মনোনীত হয়েছেন সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে। হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারির পদ পেয়েছেন সাব্রিনা সিংহ। ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত উজরা জেয়া নতুন সরকারের কাজ করবেন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিভাগের সচিব হিসেবে। বাইডেন প্রশাসনের আমেরিকার ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের ডেপুটি ডিরেক্টরের পদটি পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত সমীরা ফজিলি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ ছাবড়া মনোনীত হয়েছেন হোয়াইট হাউসে প্রযুক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগে সিনিয়র ডিরেক্টর হিসেবে। হোয়াইট হাউসে বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের ডেপুটি এসোসিয়েট কাউন্সিলারের দায়িত্ব পেয়েছেন রীমা শাহ। হোয়াইট হাউসের কোভিড রেসপন্স টিমের উপদেষ্টা পদে থাকবেন বিদুর শর্মা। ভারতীয় অভিবাসী নীরা টন্ডনকে বাইডেন মনোনীত করেছেন বাজেট চিফ পদে। আইনজীবী মালা আদিগার নিযুক্ত হয়েছেন আমেরিকার ফার্স্টলেডি জিল বাইডেনের পলিসি ডিরেক্টর পদে। আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণের পরে বাইডেন প্রথম যে বক্তৃতাটি দিয়েছেন, সেটি লিখে দিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিনয় রেড্ডি। তিনি নিযুক্ত হয়েছেন ভাষণ লেখা বিভাগের অধিকর্তা হিসেবে। ভারতের কর্নাটকের বিবেক মূর্তি বাইডেনের কোভিড-১৯ টাস্ক ফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছেন ভরত রামপূর্তি। এর বাইরেও জাতিসংঘের দ্বিতীয় উচ্চ পর্যায়ের আর্থিক ও সামাজিক উপদেষ্টা পদে মনোনীত হয়েছেন অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ। এবার মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার শীর্ষপদে এলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভব্য লাল। তাকে নাসার ভারপ্রাপ্ত চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। মহাকাশ প্রযুক্তির বিশ্লেষণ, নাসার জন্য কৌশল তৈরি, হোয়াইট হাউসের মহাকাশ সংক্রান্ত নীতি তৈরির দায়িত্বও থাকছে তার কাঁধে। এত কিছুর পর কীভাবে দেখবেন আমেরিকার প্রশাসনে বাংলাদেশি এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ভূমিকা? তারা বর্তমানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। এদের কারো জন্ম বাংলাদেশ, কারো জন্ম পশ্চিম বাংলায়, কারো জন্ম ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে। আবার কারো জন্ম আমেরিকাতে হলেও তাদের পিতা-মাতা এদেশ থেকেই একসময় আমেরিকার অভিবাসনে সাড়া দিয়েছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত তাইশা শাহের পরিবার কাশ্মির থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন নিরাপত্তার স্বার্থে। আজ আইশা হোয়াইট হাউসের পার্টনারশিপ ম্যানেজার। গৌতম রাঘবন ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। আজ তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পার্সোনেল অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে হোয়াইট হাউসে উচ্চপদে আসীন ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত উজরা জেয়া। কিন্তু ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের অভিযোগে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন জেয়া। বাইডেনের নতুন সরকার তাকে নিয়োগ করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিভাগের সচিব হিসেবে। ভারতীয় বাঙালি হিসেবে গর্বের নাম সুমনা গুহ। ওবামা প্রশাসনে তিনি ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা। এবার তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিনিয়র ডিরেক্টর অব সাউথ এশিয়া পদে। জাতীয় নিরাপত্তা, সেনাবাহিনী এবং বিদেশনীতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টের যে মঞ্চ রয়েছে, তা হলো হোয়াইট হাউস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। সেই কাউন্সিলে সাউথ এশিয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন সুমনা। কলকাতার বাঁকুড়ার মেয়ে সোহিনী চট্টোপাধ্যায়। বাংলাদেশি হিসেবে মার্কিন প্রশাসনের হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কাউন্সিলর পদে নিয়োগ পান কাজি সাবিল। সাবিল হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ব্রুকলিন ল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক। জো বাইডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বাংলাদেশি এবং ভারতীয়দের নিয়োগ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো বেগবান হতে পারে। জো বাইডেন তার প্রশাসনের নিয়োগে নারী-পুরুষ, বর্ণবিদ্বেষ সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছেন। আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বংশোদ্ভ‚ত মানুষগুলো দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে ফেলো আমেরিকানদের বলেছেন, বাইডেনকে ভোট দিন। ভোট দিন, তার নীতির সমর্থনে না হোক- ট্রাম্পকে ঠেকাতে। যারা প্রশ্ন তোলেন, ট্রাম্পের পরাজয়ে এত হইচইয়ের কী আছে, বাইডেনের ট্র্যাক রেকর্ডও কি খুব স্বস্তির? এই প্রশ্নের জবাব হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার এ নিয়োগগুলোই যথেষ্ট। আমেরিকার দুই দল ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকানদের নীতিতে হয়তো বিশেষ পার্থক্য নেই, কিন্তু পার্থক্য তৈরি করেন প্রতিনিধিরা। দুই প্রশাসনের আসল পার্থক্য কিছু মুখের উপস্থিতি। কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নীতি আর ক্যাপিটলের তাণ্ডব চালানো জনতার নেতার নীতি যে এক হতে পারে না, তা-ই যেন বিশেষভাবে বলে দেয় এ নিয়োগগুলো। বাংলাদেশি এবং ভারতীয় হিসেবে নিশ্চয়ই দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলের মানুষের গর্ব হয়। এ গর্ব সুমনা-ফারাহরা আমেরিকায় গুরুত্ব পাচ্ছেন বলে নয়, এ গর্ব আমেরিকার বহুসংস্কৃতি ও বহুত্ববাদে আমাদের সূত্র থাকল বলে।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App