×

জাতীয়

৫০ বছরে বদলে যাওয়া ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:১৯ এএম

বাহাত্তর সাল। রক্তাক্ত উপত্যকার আকাশে-বাতাসে স্বজন হারানোর কান্না। গ্রামেগঞ্জে ক্ষুধার্ত-হাড্ডিসার মানুষের আর্তনাদ। পাকিস্তানি হায়েনাদের তাণ্ডব নৃত্যের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হওয়া গ্রামের পর গ্রামে ছোট্ট খুপড়িতে গাদাগাদি করে জীবনধারণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সঞ্চিত মাত্র ১ টাকা। সেই মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নে দীক্ষা পেল জাতি। বৈষম্যহীন-শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র- এ চার মূলনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি করা হয় সংবিধান। অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিতে আনা হয় নিজস্ব পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডেরর মতো কালো অধ্যায় উন্নয়নকে গলা টিপে হত্যা করতে চাইলেও ৫০ বছরের বাংলাদেশের সাফল্যের খতিয়ান নেহাত কম নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, জিডিপি বৃদ্ধি, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারী উন্নয়ন, রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ, মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর- মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের চমকপ্রদ মুন্সিয়ানায় জাতিসংঘসহ বিশ্বে নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। পঞ্চাশে পা রাখা বাংলাদেশের ছবিটা বদলে গেছে।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়েই এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে গড় মাসিক আয় ছিল ৪৬৪ টাকা। জিডিপির হার ছিল ৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর। বর্তমান কোভিডকালেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। জিডিপির হার ৭ শতাংশের ওপরে। দারিদ্র্য কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার। ২০৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ ডলারের বেশি। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। গড় আয়ু ৭৬ বছর। সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭০। শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের জন্যই করোনাকালেও বিশ্বে রোলমডেল বাংলাদেশ।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকালেও বিশে্ব প্রশংসিত বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসে শেখ হাসিনার নেয়া কর্মসূচি জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।

তবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে এ পরিবর্তনটা এক দিনে হয়নি। উন্নয়নের এক দশকের চিত্র পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশ। অবকাঠামোগত উন্নয়নে গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। আগামী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে বাংলাদেশের ১২-১৩ কোটি নাগরিক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সাড়ে তিন হাজার ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগ রয়েছে। আইসিটির ৪১টি হাই টেক পার্কের কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে যখন সবাই ঘরবন্দি হয়েছেন, তখনও অনলাইনে সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, আদালত বন্ধ থাকলেও চলেছে বিচারকাজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো না খুললেও বন্ধ হয়নি লেখাপড়া। এর সবই সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অর্জন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু। গত ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যানটি স্থাপন করার মধ্য দিয়ে সেতুর মূল কাজটি শেষ হওয়ায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান। স্বাধীনতার ৫০তম বছরের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার আশা করছে সরকার। অন্যদিকে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। করোনার ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক গতিতে ফিরছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ, মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ।

জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, উন্নয়নই সরকারের প্রধান টার্গেট। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১০০ অর্থনৈতিক জোন, ডেল্টা প্ল্যান, মেগা প্রকল্প, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা এবং দুর্নীতি দমনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

তবে পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জও কম নয়। স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে গণতন্ত্র। আজো মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিগোষ্ঠী ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিমুহূর্তে লড়াই অব্যাহত। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির উদ্ধত আচরণ দিন দিন বাড়ছে। মৌলবাদী শক্তির কার্যক্রম বিস্তৃতি করছে। অন্যদিকে দুর্নীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আকাক্সক্ষা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিতে উন্নয়ন সীমাবদ্ধ নয়। সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের আরো দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App