×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচনে দলীয় মনোনীত বনাম বিদ্রোহী প্রার্থী, সংঘর্ষ ও বিরোধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৪৬ পিএম

যদি দল যথার্থভাবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে মনোনয়ন দিতে পারে তাহলে জয়লাভের সম্ভাবনা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এই বিষয়টি এখন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা যাচাই-বাছাই করার একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা কার্যকর থাকা জরুরি। সামনের নির্বাচনগুলোতে সেই আমলনামা দেখেই যেন প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া যায়।
দেশে এই মুহূর্তে পৌরসভা নির্বাচনের চতুর্থ পর্ব শেষ হয়েছে, বাকি আর একটি পর্ব রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেসব প্রার্থীকে দল থেকে মনোনয়ন দিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। বিএনপি সিটি করপোরেশন এবং পৌর নির্বাচনগুলোতে অনুরূপভাবে দলীয় মনোনীত প্রার্থী প্রদান করেছে। অনেক পৌর করপোরেশনে বিএনপিরও মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয় বিএনপির কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন। তবে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সে কারণে বিএনপির নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্যের দৃশ্য দেখা গেছে। তবে দীর্ঘদিন যেহেতু দলটি রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় রয়েছে, হতাশায় ভোগছে, আবার অনেকেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সন্তুষ্ট না হতে পেরে নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। ফলে নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেনি। বিএনপি নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়ে নামেনি। সাংগঠনিক এই দুর্বলতার কারণে বিএনপির সমর্থক ভোটাররা কেন্দ্রে ভোট প্রদান করতে সেভাবে জড়ো হয়নি। তারপরও যেখানে দলীয় অবস্থা সংহত আছে, সেখানে বিএনপি মনোনীত কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ পৌর নির্বাচনে মেয়র এবং অন্যান্য পদে যেসব প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করেছে, তাদের নাম সংশ্লিষ্ট উপজেলা, জেলা থেকে কেন্দ্রে সুপারিশ আকারে এসেছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী বোর্ড কর্তৃক যাচাই-বাছাই করে অপেক্ষাকৃত যোগ্যদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বলে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ নেতৃবৃন্দ গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। এবার দলের এসব মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন তাদের নানাভাবে সতর্ক, হুঁশিয়ারি এবং দল থেকে বহিষ্কার করার কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধেও দেয়া হয়েছে। বলাও হয়েছিল যে, অতীতের মতো বিদ্রোহী কাউকে আর দলে ফিরে আসার কিংবা নৌকা প্রতীক দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। বলা চলে এটি একটি চ‚ড়ান্ত সতর্ক বার্তা অনেকের জন্যই ছিল। কিন্তু তারপরও প্রায় বেশিরভাগ পৌরসভাতেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেননি। ফলে ওইসব পৌরসভায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বিভক্ত হতে দেখা গেছে। বেশ কটি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেননি, বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করে এসেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যারা দলের বিদ্রোহী, অথচ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন তাদের এখন কি দল থেকে বহিষ্কার করা হবে? এর চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছে যেটি বড় প্রশ্ন তা হচ্ছেÑ দলীয় মনোনীত যেসব প্রার্থী দলের সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন তাদের পরাজিত হওয়ার কারণ কি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী নাকি নিজেদের জনপ্রিয়তার অভাব? দলীয় মনোনীত প্রার্থী যদি বিএনপির কোনো প্রার্থীর কাছে হেরে যান সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু যেসব পৌরসভায় নির্বাচনের মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয়েছে দলীয় মনোনীত বনাম বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে, বিএনপি প্রার্থী এমন পরিস্থিতিতেও জয়লাভ করতে পারেননি, সেখানে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করার পেছনে জনপ্রিয়তার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল কিনা। হতে পারে মনোনীত প্রার্থীর জনপ্রিয়তার অভাবের কারণে আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ ভোটারদের সমর্থন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি টানতে পেরেছেন। সাধারণত লক্ষ করা গেছে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেই প্রতিক‚ল পরিবেশে প্রচার-প্রচারণায় যুক্ত হতে পেরেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মনোনীত প্রার্থীর কর্মীরা তাদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিয়েছে, কোথাও কোথাও সংঘাতেও কর্মীরা লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে সাধারণ ভোটারদের সমর্থন আক্রান্ত প্রার্থীই বেশি লাভ করেছেন। এভাবেও কেউ কেউ বিজয়ী হয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। মেয়র, কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন পদে এ রকম বিদ্রোহী বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা একেবারেই কম নয়। বিষয়টি শুধু বর্তমান পৌর এবং চসিক নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা নয়। প্রায় সবসময়ই জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনেও এমন অবস্থা আমরা দেখে আসছি। বলা চলে, দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের মনোনয়ন নিয়ে এতসব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অতিক্রম করার পরও নির্বাচনে দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী অনেক ক্ষেত্রেই ভোটারদের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। আসলে দলে মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই করা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই দলের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের মতো নানা বিষয় ভেতরে কাজ করছে বলে বাইরে অনেকেই বলছেন। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভের জন্য অনেকেই আগে থেকে কর্মী-গ্রুপ, তদবির, ওপরের মহলে নানা ধরনের সুপারিশ এবং নিজের জনপ্রিয়তা তাদের চেয়ে বেশি এমন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত সুপারিশ প্রেরণ করার চেষ্টা করে থাকে। অনেকেই এতে সফল হন। কিন্তু যারা সফল হন তাদের সবাই যে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে ভোটারদের মন জয় করার প্রার্থী হন, তা কিন্তু নয়। অনেক প্রার্থী মনোনয়ন লাভের ক্ষেত্রে সফল হলেও সাধারণ ভোটারদের বিবেচনায় খুব একটা ভোট পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না। এই বিষয়টি তৃণমূল থেকে ওপর তথা নির্বাচনী ভোট পর্যন্ত সবসময় যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয় না। এ কারণেই বিপত্তিটি ঘটে। যত ছোট নির্বাচনই হোক, সর্বত্রই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কারো না কারো গ্রহণযোগ্যতা অন্যদের চেয়ে ভালো থাকে। ওই আসনের ভোটাররা ওই প্রার্থীকে ভোটদানে আগ্রহী থাকে। এটি অবশ্য নির্ভর করে ভোটারদের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যিনি যোগাযোগ রাখেন, আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ান, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মতো সাহস ও সততার পরিচয় দেখাতে পারেনÑ ভোটাররা দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠেও অনেক সময় তেমন প্রার্থীদেরই ভোট দিতে আগ্রহী থাকেন। কিন্তু আমাদের এখানে মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরুর সময় দল এই বিষয়গুলো সবসময় গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। কিংবা দলকে সেভাবে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করার কোনো নির্ভরযোগ্য গোষ্ঠীও থাকে না। যারা প্রতিবার মাঠের প্রকৃত চিত্র দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে দিয়ে সহায়তা করতে পারে। সরকারি দল অনেক সময় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রার্থীদের সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু প্রভাবশালী নেতারা অনেক সময়ই এসব মহলকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে প্রকৃত তথ্য প্রার্থীদের সম্পর্কে অনেক সময় ওপরে দেয়া হয় না। আওয়ামী লীগ যেহেতু ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে তাই দলে নেতাকর্মীর সংখ্যা এখন অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এসব নেতার আকাক্সক্ষাও অনেক বেশি। তাদের কেউ কেউ অর্থবিত্তে বেশ প্রভাবশালী। সুতরাং দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই বেশ বড় ধরনের লবিং বিস্তার করার চেষ্টা করছেন। অথচ আওয়ামী লীগে প্রবীণ এবং নবীনদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ত্যাগী, সৎ, যোগ্য এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করার মতো যোগ্য অনেকেই তৃণমূল থেকে ওপরের সংসদ সদস্য হওয়ার মতো রয়েছেন। সবসময় এসব প্রার্থীকে নির্বাচনের জন্য যাচাই-বাছাই করে দেখার কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে নির্বাচনের প্রাক্কালে যে ধরনের হুড়াহুড়ি ও তদবির এবং সুপারিশ বিভিন্ন দিক থেকে আসতে থাকে তাতে নির্বাচনের ওই আসনে যথার্থভাবে জয়লাভ করে আসা যোগ্য প্রার্থী অনেক সময় প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে যান। এতে শেষ বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল। কারণ প্রতিটি নির্বাচনে, প্রতিটি আসনে কারো না কারো জয়ী হয়ে আসার অনুক‚ল পরিবেশ থাকে। তাকে যদি দল যথার্থভাবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে মনোনয়ন দিতে পারে তাহলে জয়লাভের সম্ভাবনা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এই বিষয়টি এখন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা যাচাই-বাছাই করার একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা কার্যকর থাকা জরুরি। সামনের নির্বাচনগুলোতে সেই আমলনামা দেখেই যেন প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া যায়। বিদ্রোহী কেউ যদি হনও, তাহলে তিনি যেন দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে আসার মতো যোগ্য না হন, প্রতিযোগিতায় দলীয় মনোনীত প্রার্থীই যেন ভোটারদের কাছে প্রকৃতই জনপ্রিয় প্রার্থী বলে বিবেচিত হন। বিষয়গুলো আগামী নির্বাচনগুলোর জন্য হয়তো বিবেচনা করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগের যারা শুভানুধ্যায়ী তারা আশা করেন যে, দলীয় মনোনয়ন লাভের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রার্থী যেন হন সেই আসনে আওয়ামী লীগের সেরা প্রার্থী, তাহলেই আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্ব›দ্ব, কোন্দল, নির্বাচনে হানাহানি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। যারা প্রার্থী হবেন তারা জনগণের কাছে সেরা প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার চেষ্টা করবেন। সেই চেষ্টাই হচ্ছে প্রকৃত রাজনৈতিক কাজÑ যা আওয়ামী লীগের মতো আদর্শবান দলের রাজনৈতিক অবস্থা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন-সংগ্রাম দেখে যে কেউ অভিভ‚ত না হয়ে পারবেন না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের অনেকেই ছিলেন যথার্থ অর্থে বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের নেতা। তারা নির্বাচনে বিজয়ী হতে অর্থবিত্ত যেমন খরচ করেননি, দলীয় কোন্দলেও তাদের পড়তে হয়নি। আওয়ামী লীগের এমন গৌরবময় ঐতিহ্য থাকার পরও এখন তৃণমূল থেকে ওপর পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতের জন্য আওয়ামী লীগ আদর্শিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App