×

মুক্তচিন্তা

অভিশংসন বিচার শেষ, ট্রাম খালাস, মুক্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৪৪ পিএম

সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন মুক্ত। ২০ জানুয়ারির পর থেকে তিনি মুখ খোলেননি, এখন হয়তো খুলবেন? এবারকার অভিশংসন প্রক্রিয়ার ভালো দিক হচ্ছে, এটি দ্রুত শেষ হয়েছে। খারাপ দিক হচ্ছে, এটি আদৌ হওয়া প্রয়োজন ছিল না। ইমপিচমেন্টের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট ট্রায়াল ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে সিনেটে ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ট্রাম্প খালাস পেয়েছেন। ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫৭টি, বিপক্ষে ৪৩। ৭ জন রিপাবলিকান ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি দুবার অভিশংসিত হয়েছেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৮-এ ও এন্ড্রু জ্যাকসন ১৮৬৮ সালে ইমপিচড হন, তবে আজ পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্ট দণ্ডিত হননি বা অভিশংসিত হয়ে ক্ষমতা হারাননি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন অভিশংসিত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। দ্বিতীয় দফা অভিশংসন প্রক্রিয়ায় ট্রাম্প দণ্ডিত হবেন না তা প্রায় নিশ্চিত ছিল। একজন প্রেসিডেন্টকে দণ্ডিত করতে হলে সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দরকার। ১শ সদস্যের সিনেটে ৫০:৫০ ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান। ট্রাম্পকে দণ্ডিত করতে ৬৭টি ভোট দরকার, যা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তাই তিনি খালাস পেয়েছেন। ওয়াশিংটন ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থকদের দাঙ্গার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করা হয়, বলা হয় তিনি এদের উস্কে দিয়েছেন। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তড়িঘড়ি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কংগ্রেসে পাস করিয়ে নেন, সেটি ১৩ জানুয়ারি, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস ছাড়ার মাত্র ৭ দিন আগে? কংগ্রেস কিন্তু ইমপিচমেন্ট দলিল সঙ্গে সঙ্গে হাউসে পাঠায়নি, কারণ তখন রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। বাইডেন ক্ষমতা নেয়ার পরই কেবল সেটি সিনেটে পাঠানো হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি সিনেটে বিচারকার্য শুরু হয়, উভয় পক্ষ ত্বরিৎ তা শেষ করতে সচেষ্ট ছিলেন। সিনেটে সংখ্যালঘু নেতা রিপাবলিকান মিচ ম্যাককলেন শনিবার তার সহকর্মীদের জানিয়ে দেন যে, তিনি ট্রাম্পকে ‘নির্দোষ’-এর পক্ষে ভোট দেবেন। ফলে ডেমোক্রেটদের আশা-ভরসা শেষ হয়ে যায়? পূর্বাহ্নে ডেমোক্রেটরা সিনেটে সাক্ষী ডাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু সিনেট মাইনরিটি নেতার অবস্থান পরিষ্কার হওয়ার পর তারা রণে ভঙ্গ দেন এবং ত্বরিৎ সাক্ষী ডাকার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। ফলে ভোটগ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। তবে ট্রাম্পকে ত্বরিৎগতিতে অভিশংসিত করা হয়েছে বলে প্রচলিত ধারণাটি ঠিক নহে! এর আগে ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন তার যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এডুইন এম স্ট্যান্টনকে বরখাস্ত করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় অভিশংসিত হন। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে লেগেছে পুরো এক সপ্তাহ। সিনেটে বিচার শুরুতে ডেমোক্রেট হাউস ম্যানেজাররা তাদের ১৬ ঘণ্টা যুক্তিতর্কে বলতে চেয়েছেন, ট্রাম্পকে দণ্ডিত করার অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতে আর একটি ৬ জানুয়ারি ঘটতে না দেয়া। তারা যুক্তি দিয়েছেন, এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে এটি উস্কে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে ট্রাম্পের অ্যাটর্নিরা তাদের ১৬ ঘণ্টা যুক্তিতর্কে বলেছেন, ইমপিচমেন্টের লক্ষ্য হচ্ছে একজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ, ট্রাম্প ক্ষমতায় নেই, তাই এটি অসাংবিধানিক। তারা যুক্তি দেন যে, ৬ জানুয়ারি ঘটনা হয়তো পূর্বপরিকল্পিত, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাতে সংশ্লিষ্ট নন এবং ট্রাম্প তখন যেসব কথাবার্তা বলেছেন, সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা তিনি বলার অধিকার রাখেন। তারা স্পষ্টটি বলেছেন, ট্রাম্পকে অভিশংসন প্রক্রিয়া একটি ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার বাসনা মাত্র। ৬ জানুয়ারি একদল ট্রাম্প সমর্থক ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল হিলে আক্রমণ চালায়, এতে ৫ জন নিহত হন। এবারকার ট্রাম্প ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া মূলত সেই ঘটনা থেকে উৎসারিত। এমনিতে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এবং ট্রাম্পের মধ্যকার সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত ছিল। ১১ জানুয়ারি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তার সমর্থকদের উস্কে দেয়ার অভিযোগে একটি মাত্র ‘ইমপিচমেন্ট অনুচ্ছেদ’ কংগ্রেসে উত্থাপিত হয়। ১২ জানুয়ারি হাউস ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী উত্থাপন করে ট্রাম্পকে অপসারণের পক্ষে একটি প্রস্তাব পাস করে। ভাইস প্রেসিডেন্ট তা করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ১৩ জানুয়ারি কংগ্রেস ২৩২-১৯৭ ভোটে ‘আর্টিক্যাল অব ইমপিচমেন্ট’ পাস করে। ৪ জন ভোট দেননি, ১০ জন রিপাবলিকান প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ এবং জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ২৫ জানুয়ারি হাউস থেকে ‘আর্টিক্যাল অব ইমপিচমেন্ট’ সিনেটে পাঠানো হয়। পরদিন ভারমন্টের সিনেটর প্যাট্রিক জে লেহি বিচারকার্যের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১০০ জন সিনেটর জুড়ি হিসেবে শপথ নেন। একই দিন রিপাবলিকানরা ‘অভিশংসন প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক’ দাবি করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সিনেটে তা ৪৫-৫৫ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। ৫ জন রিপাবলিকান এ সময় ডেমোক্রেটদের পক্ষ নেন। একই দিন সিনেট সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইমপিচমেন্ট অভিযোগের জবাব দেয়ার ‘সমন’ দেয়। ৩১ জানুয়ারি ট্রাম্প তার পুরনো অ্যাটর্নিদের বাদ দিয়ে নতুন দুজন ডিফেন্স অ্যাটর্নি নিয়োগ দেন। ২ ফেব্রুয়ারি ডেমোক্রেট হাউস ম্যানেজাররা ৮০ পাতার একটি দলিলে ক্যাপিটাল হিল দাঙ্গার জন্য ট্রাম্পকে এককভাবে দায়ী করেন এবং তাকে দণ্ডিত করে ভবিষ্যতে সব নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণার দাবি করেন। ট্রাম্পের আইনজীবীরা একই দিন ১৪ পাতার একটি প্রত্যুত্তর জমা দেন, যাতে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে বিচার করার ক্ষমতা সিনেটের নেই বলে দাবি করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি হাউস ম্যানেজাররা ট্রাম্পকে ‘শপথ নিয়ে’ সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ করেন। ট্রাম্প দ্রুত সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প পক্ষ ৭৮ পাতার একটি জবানবন্দি জমা দেন যাতে সিনেট ট্রায়ালকে ‘পার্টিজান ও রাজনৈতিক থিয়েটার’ বলে বর্ণনা করেন। হাউস ম্যানেজাররা একটি মেমো দিয়ে অভিযোগ খণ্ডন করেন। ৯ ফেব্রুয়ারি সিনেট বিচারিক কার্যের ‘নিয়ম ও প্রক্রিয়া’ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে এবং আনুষ্ঠানিক বিচার কাজ শুরু হয়। ১০-১২ ফেব্রুয়ারি হাউস ম্যানেজার ও ট্রাম্প অ্যাটর্নিরা ১৬ ঘণ্টা করে তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি সিনেটররা কয়েক ঘণ্টার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি সিনেট প্রথমে সাক্ষী ডাকার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে, পরে আবার তা বাতিল করে। একই দিন ৫৭-৪৩ ভোটাভুটিতে ট্রাম্প খালাস পান। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন মুক্ত। ২০ জানুয়ারির পর থেকে তিনি মুখ খোলেননি, এখন হয়তো খুলবেন? এবারকার অভিশংসন প্রক্রিয়ার ভালো দিক হচ্ছে, এটি দ্রুত শেষ হয়েছে। খারাপ দিক হচ্ছে, এটি আদৌ হওয়া প্রয়োজন ছিল না। ইমপিচমেন্টের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে এমনিতেই চলে যাচ্ছিলেন, এ অবস্থায় তাকে ইমপিচ করা যৌক্তিক ছিল না। ডেমোক্রেটরা চাইছিল ট্রাম্পকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা গেলে, তাকে ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ করার সুযোগ হতো, সেটি হচ্ছে না। শুধু ডেমোক্রেটরা নন, কিছু রিপাবলিকানও চান না যে, ট্রাম্প ফিরে আসুক। কিন্তু সেই সম্ভাবনা থেকেই গেল, ২০২৪-এ তিনি আবার ফিরে আসতে পারেন? গত নির্বাচনে তিনি প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ ভোট পেয়েছেন, যা কোনো পরাজিত প্রার্থীর জন্য রেকর্ড। অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে তার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় নেই, কিন্তু ট্রাম্পিজম আছে, থাকবে। শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App