×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতির অমিত শাহ ও আমাদের পাখিরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৫ পিএম

মানুষ ও পাখির মধ্যে সম্পর্ক কত যে নিবিড় ও গভীর তা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। ভুলে যাইনি বলেই পাখিবিষয়ক আমাদের অনির্বচনীয় এক আবেগ কাজ করে। পাখি দেখলে মানুষের ভালো লাগে, আনন্দ হয়। কষ্ট স্বীকার করে হলেও পর্যটনের যেসব স্থানে পাখির সমাগম ঘটে সেখানেই দলবেঁধে ছুটে যায় মানুষ। পাখি দেখে, পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি শোনে অনিন্দ্য স্ফূর্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে তারা। তথ্যপ্রযুক্তির শত হাতছানি উপেক্ষা করে মানুষ এখনো পাখি দেখে, পাখিদের নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবে! ফুল, পাখি ও প্রকৃতির প্রতি লগ্ন হওয়ার এই গুণ আছে বলেই না আমরা মানবিক মানুষ। মৃত্যু আতঙ্ক ভাইরাস করোনাও মানুষকে ফুল, পাখি ও প্রকৃতির প্রতি অনুরক্ততা কমাতে পারেনি। মানুষের পাখিপ্রীতি দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতায় বলছি- করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং ক্যাম্পাসে প্রবেশ ‘সীমিত’ হলেও অনেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন পাখির প্রেমে। প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী গেটে এসে ফোন করে জানান, স্যার আমি তো গেটে আসছি কিন্তু ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছি না, যদি গার্ডকে একটু বলে দিতেন...। বলে দিই। আসেন তাদের আত্মীয়স্বজন, ফোন পাই- স্যার আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় সপরিবারে পাখি দেখতে গিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না, যদি দয়া করে একটু ব্যবস্থা করে দিতেন ইত্যাদি। পুরনো বন্ধুরাও আসেন, আসেন তাদের আত্মীয়রাও। দৃশ্যপট প্রায় একই রকম। অর্থাৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনেকেই পাখি দেখতে আসেন। এদের কাউকে চিনি, কেউ আবার আসেন পরিচিতের পরিচিত হয়েও। আমার মতো এরূপ অভিজ্ঞতা ক্যাম্পাসের বসবাস করা অনেকের প্রায় একই রকমের। শুধু জাহাঙ্গীরনগরেই নয়- বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রকৃতি ও পাখির টানে মানুষ ছুটে যায়। পাখি আমাদের সংস্কার সংস্কৃতি, এমনকি টোটেম-ট্যাবুরও অংশ হয়ে আছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের আরাধ্য ল²ী-সরস্বতীরও বাহন যথাক্রমে পেঁচা ও হাঁস। কাক ও কোকিলের গল্প সবারই জানা। টিয়া-ময়না-ময়ূর, কোড়া-কালেম-পানকৌড়ি আমাদের জীবনের সঙ্গে কতভাবেই না সম্পর্কিত! কোন পাখি কখন ডাকলে কী হয়, কোন পাখির ডাক শুভ ও কল্যাণের, কোন পাখি ডাকলে বাড়িতে আত্মীয় সমাগম ঘটে, কোন পাখি দেখলে দিন ভালো যায় কত কী! প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে পাখি নিয়ে বিচিত্র আগ্রহ, আবেগ ও অনুভ‚তি সক্রিয়। মধ্যযুগের শিল্পসাহিত্যেও পাখির অজস্র অনুষঙ্গ বিদ্যমান। পাখি নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কাব্য ও সংগীতের কমতি নেই। লোককবি, পল্লী-পালাকার, কথক গায়েনদের কল্পকথা, গল্প ও কিস্্সায় পাখির ভ‚মিকা কম নয়। রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি পাখির কথোপকথন শোনেই তো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হওয়া ক্লান্ত রাজকুমার দৈত্য বিনাশের সূত্র খুঁজে পান। দৈত্যকুল ধ্বংস ও রাজকুমারীকে উদ্ধার করে ফেরেন। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম অঞ্চলে পৌরাণিক গল্প বা উপকথায় বহুল আলোচিত পাখি নাম ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে এ পাখি দুটি সুবিবেচক, দূরদর্শী এবং পরোপকারী। কিন্তু এই পাখিরা নির্বিশেষে সবারই উপকার করে এমন নয়- যাকে উপকারের যোগ্য মনে করে কেবল তারই উপকার করে। এরা জন্মান্ধ এবং দৈবদৃষ্টি সম্পন্ন। তবে দৈবদৃষ্টি সক্রিয় করার জন্য কখনো কখনো উপকার গ্রহীতার কাছ থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত গ্রহণ করে থাকে। কোনো ব্যক্তিকে তার ভবিষ্যৎ বলার সময় সেই ব্যক্তি একটি মিষ্টি কণ্ঠস্বরের গান শুনতে পান। সেই সুরের সঙ্গে তরঙ্গায়িত হয় ভবিষ্যৎ অনুভূতি। শুকপাখির কথাও আমাদের অজানা নয়। মধ্যযুগের কবি আলাউল তার ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে শুকপাখির অনুষঙ্গ প্রয়োগ করেছেন- নাম তার ‘হীরামন’ পাখি। কাব্যের সফল পরিণতির জন্য এ পাখির ভূমিকা অসামান্য। চকোর পাখিও শিল্পসাহিত্য ও সংগীতে স্থান করে আছে। কাজী নজরুল ইসলাম একাধিক সংগীতে চাঁদ ও চকোরির প্রসঙ্গ এনেছেন। চকোর চাঁদের জোছনা পান করে বাঁচে। ভরা জোছনায় চকোর চাঁদকে ভালোবেসে অশ্রু বিসর্জন করে। চাঁদের জন্য চকোরের ব্যর্থ প্রেম জোছনার উদ্ভাসিত আলোয় চকোরকে কাঁদায়। মহাভারতে কুচেলা যখন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন পথিমধ্যে চকোরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। পরে সে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়। চকোর তাই সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে বিবেচিত। চাঁদ ও চকোরের মিলনকে নিয়ে পৌরাণিক প্রেমের অনেক গল্প আছে। উপমহাদেশে আরেকটি পাখি বেশ আলোচিত। তার নাম চাতক। কী এক নিদারুণ অভিমানে পৃথিবীর পানি পানে তার অনীহা সৃষ্টি হয়। আকাশ থেকে ঝরেপড়া বৃষ্টির সজীব পানিই কেবল সে পান করতে আগ্রহী। মেঘের কাছে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বলে বলেই তার সময় যায়। মহাকবি কালিদাসসহ অনেক বিখ্যাত কবির রচনায় চাতকের প্রসঙ্গ আছে। বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে চারদিক যখন খাঁ খাঁ করে তখন এ পাখির ‘বৃষ্টি হোক, বৃষ্টি হোক’ ডাক শোনা যায়। সব পাখিই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জীবন চালায়। সেই প্রকৃতির কোনো সীমান্ত নেই, সেই সীমান্তে নেই বিজিবি কিংবা বিএসএফের কড়া পাহারাও! পাখি আমাদের নানাভাবে ভাবায়, তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমাদেরও সম্পৃক্ত করে। পাখি নিয়ে কত কথা, কবিতা, গল্প, গান তার শেষ নেই! এ লেখায় দু-একটি পাখির ‘অসমাপ্ত’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলো মাত্র- সাম্প্রতিককালের এ অঞ্চলের রাজনীতির অনুষঙ্গ বিবেচনায়। ‘বাংলাদেশ থেকে একটি মানুষ তো দূরে থাক- একটি পাখিও ঢুকতে দেয়া হবে না’- বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিজেপি নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার এ বক্তব্যে বাংলাদেশের পাখি ও মানুষ সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্যভাব প্রকাশ পেয়েছে তাতে সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ আহত বোধ করেছেন। আবার সান্ত¡নাও খুঁজে পেয়েছেন এই ভেবে যে, ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ এবং ‘দায়িত্বশীল প্রতিবেশী’ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ‘আদর’ করলেও ভারতের ‘মুখের কথা’ ও ‘মনের ইচ্ছা’র মধ্যে ব্যবধানই স্পষ্ট। তাই সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে তারা পাখির মতোই গুলি করে মারে! যেখানে আমরা অতিথি পাখি মারতেও দ্বিধান্বিত হই বারংবার- বিদেশাগত অতিথি পাখির জন্যও আমরা অভয়াশ্রম নিশ্চিত করি। ১১ ফেব্রুয়ারি কোচবিহার ও ঠাকুরনগরের পরপর দুটি নির্বাচনী জনসভায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অমিত শাহ বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই এমন উত্তেজক বক্তব্য প্রদান করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ভোটের রাজনীতিতে জয়লাভের প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছেন অমিত শাহ ও তার দল। তার এ প্রকল্পকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে উসকে দেয়ার প্রচেষ্টা বলেও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার মনে করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অসম্পূর্ণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও মনে করছেন অনুপ্রবেশ ইস্যুর আড়ালে বিজেপি আসলে ‘সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা’ পুনরুজ্জীবিত করছে। কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যুকেই যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ‘হাতিয়ার’রূপে ব্যবহার করছে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জনসভা দুটিতে মানুষকে উত্তেজিত করতেই অমিত শাহ প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘অনুপ্রবেশ নিয়ে আপনারা বিরক্ত কি না বলুন? মমতা ব্যানার্জি কি আদৌ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবেন? জেনে রাখুন ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তবেই কেবল অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে। বিজেপি সরকার গড়লে সীমান্ত দিয়ে মানুষ তো দূরে থাক- একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না, দেখে নেবেন।’ নির্বাচনে জয়লাভের জন্য রাজনীতিবিদদের এমন অমানবিক মিথ্যাচার একশ্রেণির মানুষকে উত্তেজিত করলেও সাধারণকে হতাশই করে। কোচবিহার ও ঠাকুরনগরে জনসভায় উত্তেজনা সৃষ্টির আগের দিন ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অর্থাৎ অমিত শাহর দপ্তরের মাধ্যমেই ঘোষিত হয়েছে যে, ২০১৬ সাল থেকে পরের পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ হ্রাস পেয়ে প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় সাধারণের সরল প্রশ্ন তো উঠতেই পারে যে, তাহলে কি ‘সরকারি তথ্য’ ও ‘মেঠো রাজনীতির’ মধ্যে বিস্তর ফাঁক এবং ফাঁকির রহস্য আছে? বিশ্লেষক মহল বলছেন, ‘অনুপ্রবেশের ভয় দেখিয়ে বিজেপি আসলে এটাই বলতে চায় যে, বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মুসলিমরা এসে পশ্চিমবঙ্গে কোনো এক প্রক্রিয়ায় হিন্দুদের সংখ্যালঘু বানিয়ে দেবে! ফলে এটা একটা সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বক্তব্য। অনুপ্রবেশ শব্দটি আসলে বিজেপির একটি অজুহাত।’ অমিত শাহর বক্তব্য যাই হোক না কেন, মাথার ওপর অনন্ত আকাশ সব পাখির জন্য উন্মুক্ত থাকুক। বিস্তৃত প্রকৃতির সব প্রাঙ্গণ পাখিদের হোক। সব সীমান্তরেখা অতিক্রম করে, রাজনৈতিক সব চক্রজাল ছিন্ন করে পাখিরা উড়ুক অনন্ত ওই অনন্ত আকাশে। পৌরাণিককালের সীমানা পার হয়ে একালের সভ্যতাকেও অতিক্রম করুক আমাদের পাখিরা। বাংলাদেশের পাখি নিয়ে অমিত শাহর খোঁটা আমাদের বিব্রত করেছে। বাংলাদেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি এত অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ লালন করে রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্যরূপে গড়ে তোলা যায় না- যা রাজনীতিকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দুঃখ হয়, অমিত শাহদের মতো নেতারা মানবতার কল্যাণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, কূপমণ্ডুক নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বকে কেবল বিপদেরই সম্মুখীন করে তুলছেন। তাদের ভাবনার খণ্ডিত বিশ্বে সব কিছু ছাপিয়ে ক্ষমতাই কেবল প্রধান হয়ে দেখা দেয়! সেখানে মানুষ, ফুল, পাখি ও প্রকৃতির কোনো স্থান হয় না- এ কেমন রাজনীতি!

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App