×

মুক্তচিন্তা

ভালোবাসা কারে কয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:২৫ পিএম

ভালোবাসা কারে কয়? এ প্রশ্ন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। প্রেমিক পুরুষ কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিদেশিনী প্রেমিকা এমন ভূমিকা রেখেছিলেন, পরে তিনি তার টানে ভারতে এসেছিলেন আর্জেন্টিনার রাজদূত হয়ে। আর সেই বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকম্পোর জন্য হয়তো রবীন্দ্রনাথ দু-দুবার ঘুরে এসেছিলেন সেই দেশ। ভালোবাসার আরো কত কাহিনী আমাদের লেখকদের। নজরুল তো ঢাকায় এসে রানু সোম, পরবর্তীকালে যিনি প্রতিভা বসু সেই বিদুষী রমনীর প্রেমে পড়ে লিখলেন, আমার কোন ক‚লে আজ ভিড়লো তরী কোন সে সোনার গাঁয়। সেই প্রেম যুগে যুগে চলছে, চলবে। তবে আমাদের যৌবনেও কোনো বিশেষ দিন ছিল না ভালোবাসার। এটা মানি এমন একটা বিশেষ দিন থাকা মন্দ কিছু নয়। বরং ভালো। যে যুগ পড়েছে কাজের চাপ আর নানা ধরনের উটকো ঝামেলায় মানুষ সব ভুলতে বসেছে। মা-বাবাকে মনে করারও তাই দিন থাকতে হয়। আমাদের জাতির একটা ভালো দিক তারা যখন কোনো কিছুতে মজে বা ভালোবাসে তখন তাকে উৎসবমুখর করে তোলে। এই ফেব্রুয়ারি মাসে ভালোবাসা দিবস যেমন রঙিন তেমনি ফাগুনের প্রথমদিনটাও লালে লাল। এমনকি শহীদের রক্তমাখা একুশের দিনটিতেও আমরা ভাষার বিজয়ে উৎসব করি বৈকি। ভালোবাসার দিনে ঢাকা ও দেশের এই জেগে ওঠা বিদেশের বাঙালিকেও প্রভাবিত করে। এমনিতেই এসব দেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে জনপ্রিয়। কিন্তু দেশের শিকড়ে বাঁধা নাড়ির টানে জাগা বাঙালি দিনটিকে আরো নিবিড় করে পায় দেশের কল্যাণে। আমার মনে হয় মানুষ যত ভালোবাসার দিকে ঝুঁকবে সমাজে ততবেশি মঙ্গল আর শান্তি নেমে আসবে। আমাদের সমাজে কোনোকালে ভালোবাসার কমতি ছিল না। বলাই হয় মায়ার দেশ আমাদের। ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ? এই সমাজে আজ কেন এই হানাহানি? তার আগে একটা কথা বলি মায়ার আরেক নাম জাদু। এই জাদু আছে বলেই দুয়ারে দাঁড়ানো মায়ের টানে দূরদেশ থেকে উড়ে আসে সন্তান। এই জাদুতে স্বামী দিনরাত পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্তি ভুলে যায়। এই জাদুর টানে প্রেমিক পাগলের মতো ভালোবাসে প্রেমিকাকে। আর চোখের জলে রাত জেগে মেয়েটি ভাবে কখন দেখা হবে আবার। এই সত্য ও সহজবোধগুলো মরে যায়নি। কখনো মরে না। কিন্তু এগুলোকে কৌশলে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে। করপোরেট বাণিজ্যের অনেকগুলো দিক আছে ভালো। আবার এমন কিছু কিছু দিক আছে যার ভেতর ভাঙনের পদধ্বনি। এক সময় ভারতের মেয়েদের ধরে ধরে বিশ্বসুন্দরী ঘোষণা করা হয়েছিল। কারণ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চোখ তখন ভারতের নব্য ধনী আর মধ্যবিত্তের মানিব্যাগে। এখন তা থেমে গেছে। তার মানে কি ভারতের নারীরা আর সুন্দরী না? তারা আগের চেয়ে সুন্দরী হলেও ব্যবসা যে এখন আরেক দেশে আরেকমুখী। তাই সেভাবে সৌন্দর্য বা ভালোবাসার বিচার করা যাবে না। ভালোবাসার মূল জায়গাটা তৈরি হয় মনে। চোখ তার পাহারাদার। আর যদি উল্টোটা হয় মানে চোখে ভালোলেগে মনে খারাপ কিছু তখন আমরা দেখি মেয়েটির কালো মুখ। অপমানিত কিংবা সম্ভ্রম হারানোর অপার বেদনা। ভালোবাসার এমন কোনো দিক থাকতে পারে না। এটা মুদ্রার উল্টো পিঠ। এর নাম ঘৃণা। অজান্তে আমাদের সমাজে ভালোবাসার বদলে এর চাষাবাদ বেড়েছে। তাই আজ ফুলে ফুলে ঢল ঢলে বাস্তবতায় ও মানুষ এক স্ত্রী বা স্বামীতে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। প্রশ্ন উঠতে পারে ভালোবাসা কি একমুখী না তার কোনো দেয়াল আছে? নেই। আর নেই মানে এই না ঘন ঘন সঙ্গী বদলিয়ে ভালোবাসাকে নবায়ন করতে হবে। দাম্পত্য এক বিষয় ভালোবাসা আরেক। এই কারণে আমাদের জানা উচিত ভালোবাসার সংজ্ঞা আসলে কী? ভালোবাসা কেবল একটি মেয়ে বা ছেলের ভেতর আটকে থাকার বিষয় নয়। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড থেকে ইডিপাস সর্বত্র যে আকর্ষণ তার সূচনায় আদম আর ইভ। তাও কিন্তু নিষিদ্ধ ফলের টানে এক খোলা ইতিহাস। ফলে শরীর থাকবেই। কিন্তু এর ব্যবহার আর পরিমিতি বোধ জানার নাম সভ্যতা। এ কারণে মানুষের মনোযোগ ও ভালোবাসায় আরো অনেক বিষয় যোগ করে নিতে হয়। একটা সময় আমাদের অগ্রজরা দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসতেন। স্ত্রীর চেয়ে অধিক টানত বলেই দেশের জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে পেরেছিলেন। জীবনের পরম সম্পদ জান দিতেও কসুর করেননি। আমরা দেখেছি এক সময় রাজনীতিবিদরা বিয়ে করতেন না। তাদের কি সুখবোধ ছিল না, ছিল না নারীপ্রীতি? ছিল। কিন্তু তারা সে ভালোবাসাকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। এমন ভালোবাসার পাগলামি না থাকলে মানুষ এগোতে পারত? বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, কবি, সাহিত্যিক, আঁকিয়ে এমন কত সৃজনশীল পুরুষ-নারী জীবনে বিয়ে করার মানুষ নামের কাউকে সঙ্গী করার সময়ই পাননি। কারণ তাদের ভালোবাসা ছিল তাদের কাজ। জীবন্ত কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকার বিয়ে করেননি। বিয়ে করার দরকার পড়েনি তার। তাই বলে কি তার জীবনে প্রেম আসেনি? তাই বলছিলাম ভালোবাসা কারে কয়? এই প্রশ্ন চিরন্তন। কবি লিখেছিলেন, ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল। সে বিরহবোধ আর বিরহ বেদনা মানুষ স্ত্রীর কাছ থেকেও পেতে পারে। থাকে যদি তেমন টান। আসলে ভালোবাসার এক বিশাল শক্তির নাম পৃথিবী। এখানে কত ঘটনা কত অঘটন। মানুষের কত ওঠানামা। কখনো কখনো মনে হবে মানুষের জীবনে ভালোবাসা আজ আর নেই। মানুষ এখন দানব। ঠিক নয় এই ভাবনা। এর পর পরই আমরা দেখি মানুষের পাশে মানুষরাই দাঁড়ায়। ভালোবাসার কত ধরনের চিহ্ন সারা দুনিয়ায়। দেশে যখন রানা প্লাজার ঘটনা ঘটেছিল এক বৃদ্ধের কথা কখনো ভোলা যাবে না। নিজের খাবারের জোগাড় নেই অথচ হাতে খাবার আর পানির বোতল নিয়ে অশ্রুমাখা চোখে দাঁড়িয়েছিলেন সারারাত। এর নাম ভালোবাসা। আজ যে মেয়েটির প্রথম ঋতুস্রাব হবে সে যেমন নতুন করে চোখে কাজল মাখতে শিখবে তেমনি যার বয়স আজ সত্তরের কাছে তার মনেও ফাগুনের আনন্দ দোলা দেবে। মানুষের জীবন একটাই সে জীবনে তার যদি ভালোবাসা না থাকে তো আসলে কিছুই নেই। আমাদের নদীগুলো ভালোবাসার এক আনন্দ ধারা। আমাদের এমন পাখি আছে যে শুধু বসন্তে গান শোনায়। আমাদের এমন কবি আছে যার গানে বসন্ত জাগ্রত হয় দুয়ারে। এমন কবিতা আছে, ছবি আছে, নাটক আছে, যাত্রা আছে, সাহিত্য আছে, যার জন্য আলাদা দিন বা সময়ের দরকার পড়ে না। বিষয়টাকে আমরা এভাবেও দেখতে পারি, বিশ্বে যখন অশান্তি, সংঘাত, যুদ্ধ আর অমানবিকতা তখন এমন একটা মোহময় দিবস সবাই একসঙ্গে উদযাপন করে, তৈরি হয় ভালোবাসার আবরণ। যে আবরণের ভেতর অনায়াসে আশ্রয় নিতে পারে ক্লান্ত মানুষ। আজকের এই তাপিত অশান্ত বিশ্বে ভালোবাসার বন্ধন জরুরি। আর একটা বিষয় বলতে চাই, আধুনিক দেশ বা সমাজে হুজুগের চেয়ে যে কোনো দিবসের মূল আকর্ষণ থাকে তার আবেদন। এই আবেদন সিডনি তথা পুরো অস্ট্রেলিয়ায় এক ধরনের। সাম্য ও অর্থনৈতিক ভালোবাসা থাকলে যা হয় কিংবা হতে পারে। এসব দেশে রাজনীতি মৃতপ্রায়। আছে সুশাসন। তাই কলহ কম। সুশাসনের সমাজে উৎসব সবার। যিনি ফুল বিক্রি করেন তার ভালোবাসার ফুলের গুচ্ছ হয়তো সবার চেয়ে দামি। আর সেটি যায় এমন একজনের কাছে যে হয়তো এই ফুল দোকানের মালিকের জন্য জমা করে রেখেছে গভীর চুম্বন। সারাদিন ধরে ক্যাফে কালচারে কফি বা পানীয় বানানো আর পরিবেশনে ব্যস্ত মেয়েটির জন্য সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকা যুবক বা মানুষটির বুকে-চোখে যে ভ্যালেনটাইন্স দিন তার আলোয় ডুবে যায় রাতের অন্ধকার। তবু তারুণ্যের হাত ধরে আসে ভালোবাসা দিবস। রাঙিয়ে দিয়ে যায় মানুষের মন। এত রাজনীতি এত কঠিন জীবন এত মারামারি এত গুম-খুন এত ধর্ষণ তারপরও জেগে থাকে প্রেম। আর সে ভালোবাসার আলোয় মায়াবী দেশ বলে সব ভুলে আমার কাছে এসো। দেশের ও দেশের বাইরের বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স দিবসে দয়িতা প্রেমিকা বা যে কোনো কারো ভালোবাসার পাশে থাকুক বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App