×

জাতীয়

হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৬ এএম

হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের  দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ

হাতিরঝিল। ফাইল ছবি

রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিতে চাইছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিপিপিতে কোনো নির্দেশনা ছিল না বলে দাবি সংস্থাটির। রাজউক বলছে, হাতিরঝিল প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণে বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু হাতিরঝিলের ভেতরে দোকানপাট বরাদ্দসহ অন্যান্য খাত থেকে আসে ১০ কোটি টাকা। বাকি টাকার ঘাটতি টানতে গেলে বছরে অনেক টাকা বাড়তি টানতে হয়। এ কারণে আলোচ্য প্রকল্পের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন প্রস্তাবের বার্ষিক খরচ ১৭ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৬ টাকা সরকারি কর্মসূচি ব্যয় হিসেবে সংগ্রহ করার লক্ষ্য প্রকল্পের প্রস্তাব প্রস্তুত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হলেও মন্ত্রণালয় থেকে এই টাকা দিতে অপারগতা জানানো হয়। এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয় এই অর্থ রাজউককেই বহন করতে হবে। এমন অবস্থায় রাজউক এই অর্থ কোন খাত থেকে বহন করবে তা ঠিক করতে পারছে না। ফলে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা।

হাতিরঝিল প্রকল্প পরিচালকদের দাবি, হাতিরঝিলের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি বাস্তবসম্মত উপদেষ্টা কমিটি এবং একটি মনিটরিং কমিটি থাকা উচিত। যাদের দিকনির্দেশনা এবং সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ হবে। যাতে করে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা বজায় থাকে। তারা বলছেন, নগরবাসীর কাছে প্রশান্তির জনপ্রিয় স্থান এই হাতিরঝিল প্রকল্পের মান নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা বিধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও জনবান্ধব করে রাখা

এই মূহর্তে অত্যন্ত জরুরি। প্রস্তাবিত জনবল এবং প্রাক্কলন ব্যয়ের টাকার জোগান না হলে সমস্ত অবকাঠামোই ভেঙে পড়বে।জানতে চাইলে রাজউকের হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রায়হানুল ফেরদৌস জানান, হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকার দরকার। কিন্তু তা থেকে ১০ কোটি টাকার মতো আসে। বাকি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আয়-ব্যয়ের যে হিসাব মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছিল তা যৌক্তিক। হাতিরঝিল প্রকল্পে আয়ের উৎসগুলো এতদিন করোনার কারণে সরকারি নির্দেশে বন্ধ ছিল। ফলে এখান থেকে আগের মতো আর আয় হচ্ছে না। তিনি বলেন, হাতিরঝিলের নিজস্ব আয়ের বাইরে সরকার থেকে যে অর্থের চাহিদা করা হয়েছে তার সংকুলান না করলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর কার্যকারিতা হারাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২ জুন রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন এবং প্রকল্পগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়- নান্দনিক এই পুরো এলাকাটি নগরবাসীর কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। এই গ্রহণযোগ্যতাকে দীর্ঘমেয়াদি করার লক্ষ্যে পুরো প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে রাজউকের মাধ্যমে আউট সোর্সিং পদ্ধতিতে জনশক্তি নিয়োজিত করে প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্বভার পরিচালনা এবং প্রকল্পের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ও একটি পরিচালন প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে।

ওই বৈঠকে প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বার্ষিক ব্যয় ১৭ কোটি ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ধরা হয়। আর সম্ভাব্য বার্ষিক আয় ধরা হয় ৯ কোটি ৭৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৭৬ টাকা। প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় হাতিরঝিল প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নামে একটি নতুন অর্থনৈতিক বরাদ্দ কোড সৃষ্টি করতে বার্ষিক মোট ব্যয়ের ১৭ কোটি ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা রাজউককে দিয়ে এবং হাতিরঝিল প্রকল্প হতে সম্ভাব্য বার্ষিক আয়ের অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সরকারি নির্ধারিত অর্থনৈতিক কোডে সরকারি খাতে জমার সুপারিশ করেন। পরে কমিটির এই প্রস্তাব পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে রাজউককে এই অর্থ বরাদ্দ না দেয়ার বিষয়ে জানিয়ে দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহবুবুর রহমান সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পটির বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আর্থিক বিধি অনুযায়ী নতুন অর্থনৈতিক কোড সৃজন করে রাজউক কর্তৃক চাহিত অর্থের সংস্থান রাখা সম্ভব নয়। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে রাজউক কর্তৃক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য অথবা অন্য কোনো বিকল্প প্রকল্প পাঠাতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

রাজউক জানিয়েছে, হাতিরঝিল প্রকল্পটি ঢাকা শহরের একটি বৃহৎ এলাকার ‘ক্যাচমেন্ট বেসিন’ হিসেবে প্রকল্পের লেক ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এই লেকের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ কাজ থেমে থাকলে ঢাকা শহরের বড় একটি অংশ অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার স্বীকার হবে। যার কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ১১টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারসন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস), ৪টি মেকানিক্যাল স্ক্রিন, মেইন ডাইভারশন সুয়ারের পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা খুবই জরুরি। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল জরুরি। হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, অব্যবস্থাপনা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাতিরঝিলের পরিবেশ নাগরিক উপভোগের বাইরে চলে যাচ্ছে। পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ। ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হাতিরঝিল প্রকল্পে ভ্রমণ-উৎসব ¤øান করে দিচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত এ পানি। প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর থেকে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে হয় রাজউককে। এ গøানি থেকে মুক্তি পেতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে হাতিরঝিলের পানি শোধন প্রকল্প গ্রহণ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। এরই মধ্যে এক বছরে বেশি সময় পার হলেও এ কাজে অগ্রগতি নেই। করোনার অজুহাতে পুরো প্রকল্পের কাজ প্রায় বছরখানেক ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের লেক একটি স্টর্ম ওয়াটার রিটেনশন বেসিন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু লেকের নালা এরিয়ায় স্টর্ম ও স্যুয়ারেজ লাইন আলাদা ছিল না। ফলে পয়োবর্জ্য মিশ্রিত পানি হাতিরঝিল লেকে পড়ছে। এ ছাড়া নালা এলাকাগুলো থেকে কারখানার বর্জ্যও পড়ছে। তাছাড়া লেকের আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এগুলো নজরদারির কেউ নেই। হাতিরঝিল প্রকল্পের নথিপত্রে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, ৪টি বীজ, ৪টি ওভারপাস, ৩টি ভায়াডাক্ট ও ২টি ইউলুপসহ বিভিন্ন স্থাপনাগুলোর অগণিত ব্যবহার ঢাকা শহরের ট্রাফিক চলাচলে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। কোনো কারণে এসব স্থাপনার ব্যবহার বন্ধ হলে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটবে। এ ছাড়াও হাতিরঝিল এলাকায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি গাছপালা রয়েছে। ঝিলে বিভিন্ন ফুলের গাছ ও ওষুধি গাছ রয়েছে। এসবের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত ২৮ জন কর্মীর জন্য যৌক্তিক প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আয় থেকে ব্যয় নির্বাহের জন্য ফুড কোর্ট, রেস্তোরাঁ, অটোগাড়ি ওয়াশ, চিলড্রেন পার্ক, হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস ও বোট সার্ভিস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ফলে এসব স্থাপনার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত এবং এর নিরাপত্তা, মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় জরুরি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App