×

মুক্তচিন্তা

সৃজনশীল আর নোট-গাইড প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে তফাত কী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:০৫ পিএম

সৃজনশীল আর নোট-গাইড প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে তফাত কী?
দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী সমাজ সবাই নোট-গাইড নিয়ে শঙ্কিত। এ নিয়ে কথাবার্তা, আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখি হচ্ছে দেদার। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা বিশেষ করে মূল্যায়ন পদ্ধতির সমস্যার কারণে নোট ও গাইড বইয়ের বাজার বিস্তৃতি লাভ করেছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা চালু করায় বিষয়টি আরো গতিলাভ করে। আমরা তো বহু বছর ধরেই আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষার্থীর পরিবর্তে পরীক্ষার্থী বানিয়ে রেখেছি, জ্ঞান দেয়া ও আহরণের পরিবর্তে মার্কিংয়ের ওপর জোর দিয়ে এসেছি। বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায়ও মার্কস প্রাপ্তিই গুরুত্ব পাচ্ছে তাহলে শিক্ষার্থী তথা অভিভাবকরা নম্বরের পেছনে দৌড়াবে না কেন? নোট-গাইড যারা তৈরি করেন, বিক্রি করেন তারা তো সেই কাজটিই করছেন। তাহলে তাদের দোষ কোথায়? সৃজনশীল নামে মূলত নোট-গাইড বই বিক্রি করা হচ্ছে। এখন নোট-গাইড বিষয়টি কী? বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বৃহত্তর অর্থে পুরো দেশ চাচ্ছে হু হু করে পাসের হার বেড়ে যাক, জিপিএ ৫ পাওয়ার হার বেড়ে যাক, যাতে এর সঙ্গে জড়িত সবারই সুনাম হয়। শিক্ষার্থীরা কি শিখতে পারল কিংবা না পারল সেটি নিয়ে খুব একটা কেউ ভাবছি না। তাদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে হবে সেখানে তাদের নম্বর দেখা হয়, জিপিএ কত আছে সেটি দেখা হয়। তাহলে অন্য কিছু কেন? জিপিএ ৫ যাতে তারা পায় সেই চেষ্টাই তো সবাই করবে। এটিই তো স্বাভাবিক। সেই চেষ্টার সঙ্গে শামিল হয়েছে নোট-গাইড প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। তারা দাবি করছেন তাদের বইগুলো সৃজনশীল, নোট-গাইড নয়। তারা তো সে দাবি করতেই পারেন। বাংলাদেশে দুই ধরনের প্রকাশক রয়েছেন। দুই দলই নিজেদের সৃজনশীল প্রকাশক বলে দাবি করেন। পার্থক্য হচ্ছে একদল শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠবই ও পাঠ্যবইয়ের সহায়ক বই ছেপে থাকেন। আর একদল প্রকাশক পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত বিভিন্ন লেখকের বই ছেপে থাকেন। দ্বিতীয় ধরনের প্রকাশকদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই নামে সৃজনশীল প্রকাশক। তারাও এক ধরনের ব্যবসায়ী। তারা বিভিন্ন লেখকদের কাছ থেকে মানহীন বই নিয়ে অর্থের বিনিময়ে ছেপে থাকেন। বড় বড় ব্যবসায়ী, অসৎ কর্মকর্তাদের বই, বিদেশে অবস্থানরতদের বই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ছেপে থাকেন। ফলে বই বিতরণ বা মার্কেটিংয়ের কোনো চিন্তা তাদের মধ্যে থাকে না। মানসম্পন্ন বই যারা লেখেন তাদের বইয়ের প্রতি তারা খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। কারণ তাদের বই ছাপলে পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে হবে। কষ্ট করতে হবে, অর্থ খরচ করতে হবে। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম তারা মনে করেন ‘অমর একুশে বইমেলা’। এটি ছাড়া তাদের আর কোনো চেষ্টা নেই, মেকানিজম নেই। তারা মানহীন বই প্রকাশ করে একবারে যে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারেন, মানসম্পন্ন বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দিয়ে অল্প অল্প করে অর্থ লাভ তাদের কাছে আকর্ষণীয় বা উপযোগী মনে হয় না। যে কারণে কাক্সিক্ষতহারে পাঠকের সংখ্যা বাড়েনি, ভালো মানের বই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো কাজটি হচ্ছে না। একবার চুন খেয়ে মুখ পুড়লে সে তো আর দই, দুধ কিংবা মিষ্টি আর সহজে খেতে চাবে না। আমাদের পাঠকদের রুচি আমরা নষ্ট করে ফেলেছি এ ধরনের প্রকাশকদের কারণে। নতুন ও উদীয়মান লেখক সৃষ্টিতেও তারা কোনো ভ‚মিকা রাখেন না। দেশে দু-চারজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য তারা বহু অর্থ ব্যয় করেন, বহু কৌশল অবলম্বন করেন। আবার যারা মানসম্পন্ন বই লেখেন তাদের দিকে তারা ফিরেও তাকান না। ভালো ও নতুন লেখা, প্রয়োজনীয় লেখা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও তারা পালন করেন না। সাহায্যকারী বই কি শিক্ষার্থীরা পড়বে না? আমরা কি শুধু সাদা ভাত খাই? ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের তরকারি, সবজি খেয়ে থাকি খাবারকে উপাদেয় ও সহজপাচ্য করার জন্য। একইভাবে শুধু ক্লাসের বই পড়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো যায় না। বিভিন্ন ধরনের আইডিয়া নেয়া, তুলনা করা, যুক্তিতর্ক তুলে ধরার জন্য মূল বইয়ের সঙ্গে কিছু সাহায্যকারী বই শিক্ষার্থীদের পড়া উচিত। কিন্তু আমাদের পুস্তক প্রকাশনীগুলো কি সেই ধরনের কাজ করছে? তারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে। শিক্ষার্থীরা যেসব উত্তর লিখবে সেগুলো হুবহু নোট-গাইড বইয়ে পাওয়া যায়, যা তাদের সৃজনশীলতাকে প্রস্ফুটিত হতে দেয় না, ধীরে ধীরে তাদের সৃজনশীল প্রতিভাকে চেপে রেখে রেখে ধ্বংস করে দেয়। তাই নোট-গাইড বই বন্ধ করে দেয়ার জন্য শিক্ষাবিদরা সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, অনুরোধ করছেন। পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক যে প্রকাশনাশিল্প গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তারা এক ধরনের দক্ষতা অর্জন করেছে। এটিকে শিল্পের রূপ দেয়া হয়নি, স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অথচ এটি একটি বাস্তবতা, এটি এক ধরনের বাণিজ্যিক শিক্ষা। এটিকে কি আমরা টিকিয়ে রাখব? নাকি বাদ দেব? শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে, অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে, কোচিং সেন্টার থেকে তাদের পঠিত বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে, শিখতে পারে যা গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের নেই। তাদের সঙ্গী হচ্ছে এসব নোট বা গাইড বই। এটি আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমরা তো এটাও চাব না যে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এসব নিম্নমানের বই পড়ে সারাজীবন পেছনেই পড়ে থাকবে। তাহলে কী করা? সমাজের সব স্তরে, সব সেক্টরে চলছে টাকার খেলা সেখানে পুস্তক ব্যবসায়ীরা, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা কেন ব্যবসা করবেন না? পত্রিকায় দেখা যায় যে, শিক্ষক সমিতিগুলোর নেতারা এই প্রকাশকদের কাছ থেকে নোট-গাইড বইয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা চাঁদা নেন। কেন এই চাঁদা নেন? মানহীন বই চালিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করার জন্য আর যেনতেন প্রকারে গড়ে ওঠা প্রকাশকদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে নতুন নতুন সমিতি ও কমিটি গঠিত হয় নিজেদের মতো করে। কেন্দ্রীয় বিভাগ-জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি হয়। সেই কমিটির ছবি ও সংবাদ পত্রিকা ও টিভিতে ফলাও করে প্রচার হয়। সব স্তরে, সব পেশায় চলছে এই টাকার খেলা, কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে কোথাও অপ্রকাশ্যে। সব ক্ষেত্রে চললেও শিক্ষাক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকা দরকার। প্রকাশকরা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন, এ শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। লেখকদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে মানহীন বই প্রকাশ করে বস্তাবন্দি করে রাখা কিংবা জোরপূর্বক কিছু বিক্রির চেষ্টা করা আর নোট-গাইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট করা দুটিই সমান অপরাধ এবং অনৈতিক কাজ। কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রণের তো কোনো নিয়ম-কানুন সে রকম নেই। এখানে চলছে এক ধরনের দেনা-পাওনা, ধস্তাধস্তি, জোরাজুরি, চোর-পুলিশ খেলা। এ বিষয় দুটি একশ শতাংশ নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। এখানে সৎভাবে প্রকৃত শিক্ষিত একদল মানুষ দিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটি একটি নির্দেশনা দেবে যার আলোকে বাণিজ্যিক প্রকাশনাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন সাহায্যকারী বই প্রকাশ ও বিতরণ করবে। মানহীন বই ঘুষ দিয়ে বিক্রি করার প্রথা বন্ধ করতে হবে। মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App