×

অর্থনীতি

ভ্যাট দুর্বলতায় রাজস্ব ঘাটতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩১ এএম

ভ্যাট দুর্বলতায় রাজস্ব ঘাটতি

হয়রানির কারণে নিরুৎসাহিত ব্যবসায়ীরা ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি মাইনাস ২ শতাংশ সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৩৯ হাজার কোটি টাকা

রাজস্ব আহরণের প্রধান খাত হিসাবে গত কয়েক বছর ধরেই বিবেচিত হচ্ছে ভ্যালু এডেড ট্যাক্স (ভ্যাট)। ভ্যাটে ভর করে বড় রাজস্ব আহরণ করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাটের পরিধি বাড়াতে সরকার ভ্যাট আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ভ্যাকসিনের সুবাধে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি ফিরলেও গতি হারিয়েছে ভ্যাট। নানা ধরনের জটিলতার কারণে একদিকে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে কমেছে ভ্যাট আদায়। যে কারণে দিনে দিনে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ভ্যাটে হয়রানির অভিযোগ আসে প্রতিনিয়তই। সম্প্রতি রাজধানীর এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ইএফডি বসিয়েছেন তার রেস্টুরেন্টে। আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যালেন্স করে চলতেন। এখন ইএফডি বসাতে ক্ষেপেছেন তারা। বন্ধ হয়ে গেছে উপরি আয়। নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে। এমনি এক ব্যবসায়ী আসেন এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে কথা হয় চেয়ারম্যানের দপ্তরে। তিনি বিদেশ থেকে এসে দুই বন্ধু মিলে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন। এই হয়রানি বন্ধে তিনি চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ চান।

এই অবস্থা শুধু ঢাকায় নয়, রাজধানীর বাইরেও এমন অনেক ভ্যাট হয়রানির বিষয় রয়েছে। যারা হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে চান না। আরিফ (ছদ্মনাম) নামে দেশের উত্তরাঞ্চলের একজন ছোট ব্যবসায়ী। করোনাকালীন ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে না পারার জন্য তাকে লাখ টাকা জরিমানা করে রংপুর কমিশনারেটের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এখানেই শেষ নয়; এই অফিসে অনেককে জরিমানা না নিয়ে ছাড়পত্র দিলেও আরিফকে করা হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা। কারণ এই ব্যবসায়ী করোনাকালীন ভ্যাট রিটার্ন জমা দেননি। যদিও এনবিআর থেকে বলা হয়েছিল, নির্ধারিত সময়ে জরিমানা ছাড়াই ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়া যাবে। পরবর্তীতে জরিমানা জমা দেয়ার পর ছাড়পত্র দেয়া হয়। কিন্তু এই ছাড়পত্রের ফরওয়ার্ডিং মেইল না পাওয়ায় এই ব্যবসায়ীর পণ্য বন্দরে আটকে থাকে আরো দুদিন। সর্বশেষ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কমিশনারের গোচরে এনে মুক্তি পান এই ব্যবসায়ী। ভ্যাট সংক্রান্ত এসব জটিলতার কারণে আমদানি করা চাল প্রায় নয় দিন পোর্টে পড়েছিল বিল সাবমিট করতে না পারার কারণে। প্রতিদিনই জরিমানা গুনতে হয়েছে এই ব্যবসায়ীকে। যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এনবিআর থেকে। গত সোমবার কথা হয় আরেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামিলের (ছদ্ধনাম) সঙ্গে।

তিনি ভ্যাট রিটার্ন দেন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় অবস্থিত একটি ভ্যাটের সার্কেল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভোরের কাগজকে বলেন, ভ্যাট জটিলতা নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতো করে না চললে কারখানা পরির্দশন থেকে শুরু করে নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। অফিসাররা যেমন বলেন; তেমন চললে আর কোনো সমস্যাই থাকে না। নতুন অফিসার এলে কি হয়Ñ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নতুন অফিসার এলে নতুন নিয়মে যেতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে এনবিআরের ভ্যাট বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য ড. আবদুল মান্নান শিকদারের সঙ্গে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ভ্যাট ইস্যুতে কথা বলার বিষয় উল্লেখ করে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া মেলেনি।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এই হয়রানি শুধু ভ্যাটে নয়, আয় করে এরকম অনেক অভিযোগ রয়েছে করদাতাদের যারা আইনি গ্যাঁড়াকলে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি রাজধানীর কর অঞ্চল-১৩ এর একটি সার্কেলে বিপাকে পড়েন এক প্রবাসী কর্মী। যিনি সারাজীবনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাজধানীতে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করেছেন। বছরের পর বছর পরিশ্রম করে করে এক এক করে তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রোষানলে পড়ে তার কর ফাইল অডিটে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার বাড়ি নির্মাণের প্রায় সমপরিমাণ টাকা আয়কর ধার্য করা হয়েছে। যার আপিল এখনো চলমান। শুধু হয়রানির ভয়ে এসব বিষয় নিয়ে করদাতারা কথা বলতে চান না।

এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে অর্থাৎ জুলাই-২০ থেকে জানুয়ারি-২১ পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৭ মাসে ভ্যাটে ঘাটতি ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ভ্যাটে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মাইনাস ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। এনবিআরের তিনটি খাতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে ভ্যাট আদায়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সবাইকে অটোমেশনের আওতায় আনতে না পারা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, হয়রানির কারণে মূলত করোনাকালীন ভ্যাট আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া করোনার কারণে কেনাকাটা কম হওয়ায়ও কমেছে ভ্যাট আদায়।

ভ্যাট আদায় কমে যাওয়ার বিষয় নিয়ে কথা হয় তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্র্জ্জা আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার কারণে অনেক মানুষের আয় কমে গেছে। এ ছাড়া উৎপাদন কমে গেছে। যার প্রমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে নেতিবাচক চিত্র রয়েছে। সবমিলিয়ে কেনাকাট কমেছে, ভ্যাট আদায়ও কমেছে। যার কারণে নানা উদ্যোগের পরও ভ্যাটে স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে অভিমত এই অর্থনতিবিদের।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৩৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির গড় ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এনবিআরের আয়করে সাত মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ হাজার ৪৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৪০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত মাসে আয়করে রাজস্ব ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানি খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৩৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত মাসে আমদানি-রপ্তানিতে ঘাটতি ১৫ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিশ^ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এনবিআর ভ্যাট আদায় বাড়াতে জোর দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- সবাইকে ভ্যাট অটোমেশনের আওতায় আনতে না পারলে ভ্যাটদাতারা এই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। এ ছাড়া ভ্যাটে নানা জটিলতা রয়েছে, সবচেয়ে বড় জটিলতা প্রশাসনিক দক্ষতা। তবে ভ্যাটে রাজস্ব আহরণ কম হলেও আয়কর ও কাস্টমসে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা পরবর্তীতে সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে বলে অভিমত এই অর্থনীতিবিদের। জানা গেছে, ভ্যাট আদায় বাড়াতে জোর দিয়েছে এনবিআর। ইসিআর পদ্ধতি বাদ দিয়ে ইএফডি যুগে প্রবেশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মানুষকে ভ্যাট দিতে উৎসাহী করতে প্রতিমাসের ৫ তারিখে ইএফডি ব্যবহারকারী গ্রাহকদের মধ্যে লটারি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম লটারিও হয়েছে। এই প্রক্রিয়া প্রতিমাসে অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া ভ্যাট রিটার্ন জমা সহজ করতে কাজ করছে এনবিআর। ইতোমধ্যে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। সারাদেশে ভ্যাটের আওতা বিস্তৃত করতে অনলাইন প্রক্রিয়ায় জোরও দেয়া হচ্ছে। যাতে ভ্যাটদাতারা সহজে ভ্যাট দিতে পারেন। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় এনবিআরের কার্যক্রম গতি পাচ্ছে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App