×

মুক্তচিন্তা

নগরীয় কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:২১ পিএম

নগরীয় কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি

নিতাই চন্দ্র রায়।

বাংলাদেশের নগরের বসবাসকারী ৫ কোটি মানুষকে কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষতায়ন নিশ্চিত করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। এজন্য জাতীয় পর্যায়ে নগরীয় কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রতিটি নগরে স্থানীয় সরকারের অধীনে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নির্মাণ এবং নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমি। অন্যদিকে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ২২-২৪ লাখ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ ভাগ লোক নগরে বসবাস করছেন। উন্নত শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসার সুযোগের কারণে এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও বন্যায় বাড়িঘর হারিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত আশ্রয় নিচ্ছে নিকটবর্তী নগরগুলোতে। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে নগরবাসীর সংখ্যা ও অপরিকল্পিত নগরের বিস্তৃতি। আমরা ইচ্ছা করলেও মানুষের স্থায়ী ঠিকানা; নগরায়ণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। নগরে বসবাসকারী এই বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নগরীয় কৃষি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে নগরীয় কৃষির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের সফল দৃষ্টান্ত রয়েছে। গতানুগতিক গ্রামীণ কৃষির মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য, পুষ্টি নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে নাÑ এ কথা আমরা বহুদিন ধরেই বলে আসছি।

জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮তে (খসড়া) ছাদকৃষি, হাইড্রোপনিক্স, অ্যারোপনিক্স ও মাশরুম চাষ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু কথা বলা হলেও নগরীয় কৃষি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো কিছু বলা হয়নি। নগরীয় কৃষি হলো, কোনো নগর ও তার আশপাশ এলাকায় খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ ও বাজারজাতকরণের সব কার্যক্রম। শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনই নয়, নগরীয় এলাকায় বা তার আশপাশে শাকসবজি, ফলমূল, মাশরুম উৎপাদন, মাছ ও জলজ প্রাণীর চাষ এবং হাঁস-মুরগি, পশু পালন ও দুগ্ধ উৎপাদনসহ সব কার্যক্রমই নগরীয় কৃষির অন্তর্ভুক্ত। নগরীয় কৃষি পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। নগরীয় কৃষির মাধ্যমে নগরবাসী নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অতিরিক্ত কৃষিপণ্য বিক্রি করে কিছু আয় করার সুযোগ পান। এতে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের নগরবাসীর দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানে পথ সুগম হয়। নগরীয় কৃষির উদ্দেশ্য অনেকÑ এক. নগরবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা। দুই. নগরবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। তিন. নগরীয় এলাকার মানুষের মধ্যে স্বল্পমূল্যে টাটকা ফলমূল, শাকসবজি ও মাছ-মাংস সরবরাহ নিশ্চিত করা। চার. কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরীয় কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। পাঁচ. নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ছয়. বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, মাটি ও পানিদূষণের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করা। সাত. নগরের সব ভবনের ছাদ ও বারান্দায় ফলমূল, শাকসবজি, মাশরুম এবং ভেষজ ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী উদ্ভিদের চাষাবাদ করা। আট. নগরের সব অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের অব্যবহƒত জমিতে জৈব পদ্ধতিতে ফলমূল, শাকসবজি চাষের ব্যবস্থা করা। নয়. নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে রাস্তার ধার, ব্যালকনি ও ছাদে অরনামেন্টাল উদ্ভিদের চাষ করা ইত্যাদি। এছাড়া নগরের তাপমাত্রা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নগরীয় কৃষি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫৪ ভাগের বেশি লোক নগরে বসবাস করে। যত দিন যাচ্ছে নগরবাসীর সংখ্যা ও নগরীয় খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর উৎপাদিত খাদ্যের শতকরা ১৫ ভাগ উৎপাদিত হতো নগরীয় এলাকায়। বর্তমানে তা বেড়ে ৩০-৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকক নগরীর শতকরা ৬০ ভাগ জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেখানকার শতকরা ৭২ ভাগ মানুষ নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিউবার রাজধানী হাভানা শহরে অধিবাসীদের মৌলিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নগরীয় কৃষির যাত্রা শুরু হয়। নগরীয় কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কিউবা সরকার নগরীয় কৃষি বিভাগ গঠন করে এবং নগরের খালি জায়গার ওপর নাগরিকদের দখল এবং সেখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রির অধিকার আইনসিদ্ধ করে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৩ লাখ ২২ হাজার মানুষ নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিউবার নগরীয় কৃষি বিভাগ এদের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা, রোগবালাই, পোকামাকড় দমন ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

করোনা মহামারির ফলে খাদ্য সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী জনাকীর্ণ শহরগুলোতে নগরীয় কৃষি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে ৯০ ভাগ খাদ্য আমদানিকারক ৫৭ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে নগরীয় কৃষি বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। নগর কর্তৃপক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে শহরটির জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ খাদ্য চাহিদা স্থানীয়ভাবে পূরণ করার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শাকসবজির পাশাপাশি নগরীয় এলাকায় মাছ ও ডিম উৎপাদন বাড়ানোরও পরিকল্পনা নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস এবং বাণিজ্য উত্তেজনায় আমদানিতে প্রভাবের কারণে নগরীয় কৃষির ওপর আগে থেকেই জোর দিচ্ছিল সিঙ্গাপুর সরকার। নভেল করোনা ভাইরাস মহামারি একে আরো ত্বরান্বিত করেছে। এডিবল গার্ডেন সিটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে নগরীয় কৃষির মাধ্যমে বেগুন, লাল ঢেঁড়স, শাকসবজি থেকে শুরু করে ৫০ প্রজাতির খাদ্যপণ্য চাষাবাদ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ৮০টির মতো ছাদকৃষি প্রকল্প পরিচালনা করছে। ওইসব প্রকল্পে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাকৃতিক কীটনাশক। শুধু বহুতল ভবনেই নয়, সিঙ্গাপুর সরকার জেলখানা, শিপিংকনটেইনার ও উঁচুতলার ভবনের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ব্যালকনিতেও চাষাবাদ শুরু করেছে। স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদন প্রকল্পে ২ কোটি ২০ লাখ ডলার বরাদ্দ করে সিঙ্গাপুর নগর কর্তৃপক্ষ। চলামান করোনা ভাইরাসের কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের চাহিদা আকাশচুম্বী হতে দেখা যায় হংকংয়ে। ফলে সেখানকার নাগরিকদের মধ্যেও নগরীয় কৃষির প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের নগরের বসবাসকারী ৫ কোটি মানুষকে কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষতায়ন নিশ্চিত করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। এজন্য জাতীয় পর্যায়ে নগরীয় কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রতিটি নগরে স্থানীয় সরকারের অধীনে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ডে নগরীয় কৃষির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া দেশের সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পাঠ্যসূচিতে নগরীয় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে নগর ও নগরীয় কৃষির বাংলাদেশ। তাই যে যাই বলুক, নগরীয় কৃষি ছাড়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না।

নিতাই চন্দ্র রায় : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App