×

জাতীয়

উজি পিস্তলের মালিকানায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৪২ এএম

উজি পিস্তলের মালিকানায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা

উজি পিস্তল

এতদিনেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন ডিসেম্বরেও রিনিউ করিয়েছেন এক ক্রেতা

কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে দেশে আমদানিকৃত সামরিক গ্রেডের আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উজি পিস্তলের মালিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে তদন্তকারী সংস্থা। এর মধ্যে ৫৩টি উজি পিস্তলের লাইসেন্সধারী ক্রেতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। তবে কারো বিরুদ্ধেই পিস্তলের অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ৫৩ জন ক্রেতার মধ্যে ঢাকার ৯ জন থাকলেও বাকিরা দেশের অন্যান্য জায়গার। পুলিশের একজন টিআই ছাড়া এসব ক্রেতার অধিকাংশই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট। নিজেরা না কিনলেও নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের নামে রয়েছে এসব অস্ত্র। এছাড়া রয়েছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীও। গত ডিসেম্বরেও উজির একজন ক্রেতা নিয়মানুযায়ী রিনিউ করিয়েছেন তার পিস্তল। অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, উজি পিস্তলের প্রায় ৮০ ভাগই রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে এর অপব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনো। কয়েকজন ক্রেতা জানিয়েছেন, নরমাল রাইফেল বলেই তাদের কাছে উজি পিস্তল বিক্রি করা হয়েছে।

এদিকে সামরিক বিশ্লেষক ও অপরাধ সংশ্লিষ্টরা বলছে, সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যে অস্ত্রটি নেই তা সাধারণ নাগরিকদের কাছেও থাকা উচিত নয়। কারণ মাদক নিয়ে ধরা পড়া একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে। এটির অপব্যবহার হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য স্বস্তির হবে না। তাই প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দ্রুতই এটি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি গঠন করে সামরিক গ্রেডের আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উজি নিষিদ্ধ করা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ছিল। তবে এখনো কমিটি হয়নি।

গত ২০ আগস্ট এক মাদককারবারিকে গ্রেপ্তারের পর দেখা যায়, লাইসেন্স করা একটি উজি পিস্তলের মালিক তিনি। বিষয়টি পুলিশের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, কারণ নামে পিস্তল হলেও উজি পিস্তল আসলে অতিক্ষুদ্র আকারের সাব-মেশিনগান। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর মেজর উজিয়েল গালের করা নকশায় চল্লিশের দশকে প্রথম এ অস্ত্র তৈরি হয়। তার নামেই এ সাব-মেশিনগানের নামকরণ হয়।

শুরুতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করলেও পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি লাইসেন্স নিয়ে উজি সিরিজের বিভিন্ন আগ্নোয়াস্ত্র তৈরি শুরু করছে। বাংলাদেশে পাওয়া অস্ত্রটি তৈরি করেছে বিখ্যাত জার্মান অস্ত্র নির্মাতা কার্ল ওয়ালথার।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রথম উদ্ধারকৃত অস্ত্রটির ধরন দেখে সন্দেহ হওয়ায় মতামত নিতে সেটি ঢাকা সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্রের লাইসেন্সে পয়েন্ট টু টু বোর লেখা থাকলেও সেমিঅটোমেটিক উজি পিস্তল কেনা যাবে না। এর এক ম্যাগজিনে ২০ রাউন্ড গুলি থাকে, যেখানে সাধারণ পিস্তলে থাকে ১৫ রাউন্ড।

আরো জানা যায়, ৬টি প্রতিষ্ঠান গত ৫ বছরে এ ধরনের মোট ১০৯টি আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করেছে। সবগুলোই আনা হয়েছে পয়েন্ট টু টু বোরের ‘রাইফেল’ ঘোষণা দিয়ে। এর মধ্যে ৫৩টি বিক্রিও হয়েছে। যদিও উজি তাদের আমদানি বা বিক্রি করতে পারার কথা নয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল ভোরের কাগজকে বলেন, উজি পিস্তলের মালিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি। এর মধ্যে উজি পিস্তলের লাইসেন্সধারী ক্রেতাদের প্রায় অধিকাংশের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। তবে কারো বিরুদ্ধেই পিস্তলের অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। উজি পিস্তলের লাইসেন্সধারী ক্রেতা ফরিদপুর সদরের পৌর স্বেচ্ছালীগের সভাপতি ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ী মো. সেলিম হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, লাইসেন্সে রাইফেল রয়েছে। সে অনুয়ায়ী আগ্নেয়াস্ত্রটি আমি কিনি গত ২০১৪ সালে। তবে সম্প্রতি আমি এ বিষয়টি গণমাধ্যমে জানতে পারি। ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশ আমার কাছে এসেছিল। নিয়মানুযায়ী, গত ডিসেম্বরেও আমি আগ্নেয়াস্ত্রটি রিনিউ করিয়েছি। এখন সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই আমি মেনে নেব। অস্ত্র ক্রেতা মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, আমি সরকারকে ৮-৯ লাখ টাকা কর দেই। নিরাপত্তার জন্য আমি সব নিয়ম মেনেই তা কিনেছি। পরে এ অস্ত্রের বিষয়ে গণমাধ্যমে দেখতে পাই। এখন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার যদি নিষিদ্ধ করেন তাহলে তিনি কেনা অস্ত্র ফেরত দেবেন। তবে নিষিদ্ধ করে তা নিয়ে নিলে একটি বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে বলেও আশা করেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহি চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, আর এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত আমদানি করার যদি প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রয়েছে। এমন একটি অস্ত্র যখন আমদানি করা হয় তখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়টি দেখা উচিত ছিল। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলব, অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে আরো সচেতন ও কঠোর হতে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, মিলিটারি গ্রেডের সেমি অটোমেটিক এই আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের হাতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ আর্মস ডিলার এন্ড ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাসির আহমেদ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আসলে এটি পিস্তল মডেল রাইফেল। বাংলাদেশে পাওয়া অস্ত্রটি তৈরি করেছে বিখ্যাত জার্মান অস্ত্র নির্মাতা কার্ল ওয়ালথার। আর এটিকে স্বয়ংক্রিয় বলা হচ্ছে। ২০টি বুলেট ব্যবহার করতে হলে ২০ বার ট্রিগার চাপতে হবে। পৃথিবীর কোনো পিস্তলের গায়েই কখনো পিস্তল লেখা থাকে না। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর এ নিয়ে কয়েক দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পুলিশপ্রধান, র‌্যাব ডিজি ও এসবি প্রধানের উপস্থিতিতে আলোচনা হয়েছে। চলতি মাসেও আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে আমি ছাড়াও বাংলাদেশ আর্মস ডিলার এন্ড ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক তানভীর হোসেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, সেনাবাহিনীর একজন মেজর ও সহকারী পুলিশ কমিশনার রয়েছেন। এই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে ওই অস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকবে কি, থাকবে না? সামনেই আবার আমাদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বৈঠকের তারিখ জানানোর কথা রয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাদের পাওয়া যায়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App