×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:২১ পিএম

সব সময় আলোচনায় থাকাই যেন মিয়ানমারের উদ্দেশ্য কিংবা অদৃষ্ট! নানা বিষয়ে অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় ছিল মিয়ানমার। এসব বিষয়ের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু অন্যতম। এখনো আন্তর্জাতিক আদালতে এ বিষয়ে মামলার কার্যক্রম সময় সময় গণমাধ্যমে আসছে। সাম্প্রতিককালে সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর মিয়ানমার আবার নতুনভাবে আলোচনায় ওঠে এসেছে। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন মিয়ানমারের দিকে। আমরাও তা থেকে বিচ্ছিন্ন নই। প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া থাকে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারেও তাই ঘটছে। কিন্তু সামরিক বিধিনিষেধের জাল ছিন্ন করে প্রতিক্রিয়ার সব খবর হয়তো আমরা পাচ্ছি না, সম্ভবও নয়। তবে জানা গেছে, সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর অভ্যুত্থানবিরোধী অসহযোগও মিয়ানমারে শুরু হয়েছে। শুরুটা হয়তো ছোট, কিন্তু সব ছোটই গুরুত্বহীন নয়। চিকিৎসা কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বেশকিছু মানুষের অসহযোগের পাশাপাশি ঘরে বসেও নাকি অনেকে বিভিন্ন কায়দায় সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এমন অহিংস অসহযোগ থেকে একটু একটু করে সম্ভবত বড় ধরনের কোনো আন্দোলন ভেতরে ভেতরে দানাও বাঁধছে। ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো মান্দালা শহরে একদল বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থানবিরোধী স্লোগান দিয়েছে। এদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মন্দালার একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা। বিক্ষোভ থেকে সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাহার এবং আটক নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে স্লোগান দেয়া হয়েছে। জানি না, ছোট আকারের এই বিক্ষোভ ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে কোন পথে নিয়ে যায়। আমরা সব সময়ই রাষ্ট্রের সব মানুষের অধিকারচর্চা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকেই শ্রদ্ধা জানাই। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে সামরিক শাসন চলা মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৫ সাল থেকে গণতন্ত্রচর্চার পথে পুনরায় যাত্রা শুরু করেছিল। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও সেই গণতন্ত্রচর্চার ধারা লক্ষ করা যায়। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারে পুনরায় সেনাশাসন কার্যকর হয়েছে। সেনাশাসন শুরুর প্রচলিত রেওয়াজ অনুসারে দেশের বেসামরিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে গণযোগাযোগের অনেক মাধ্যম। সেনানিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো। বিমানবন্দর বন্ধ করে বৈদেশিক যাতায়াতও স্থগিত করা হয়েছে। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রচর্চার পথে পুনরায় যে যাত্রা আরম্ভ করতে যাচ্ছিল মিয়ানমার, ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানে তা নস্যাৎ হয়ে গেছে। সু কির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করলে দেশটির সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনে। ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থান সংঘটনের পশ্চাতে এই অজুহাতকে সামনে আনা হয়েছে, একই অজুহাতে সেদিন ভোরে স্টেট কাউন্সিলর সু কি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটক করে মিন অং লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। সু কি এবং উইন মিন্ট ছাড়াও শতাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী এবং রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও আছেন। মিয়ানমারে এমন এক সময়ে অভ্যুত্থান ঘটল যখন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদায় এবং ডেমোক্র্যাটিক নেতা জো বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। নতুন মার্কিন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান বিশ্বরাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশই মিয়ানমারের সেনাঅভ্যুত্থানকে নিন্দা জানিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া রাজনীতিকদের দ্রুত মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে। নিন্দা জানিয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো রাষ্ট্রও। পক্ষান্তরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী এবং সব সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান করা চীন অনেকটা নরম স্বরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে নিজেদের সহনশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশও অনেকটা চীনের মতোই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে বিশ্ব নেতারা যে যাই বলুন আর বিভিন্ন রাষ্ট্র যে প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করুক না কেন সমগ্র বিশ্বকেই মিয়ানমার এক ধরনের ভাবনার সংকটে ফেলে দিয়েছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ এক সংকটের মধ্যে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন, সংকটের মধ্যে পড়েছে চীনও। বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনায় চীন ও আমেরিকার মধ্যকার সম্পর্ক ধীরে ধীরে বিশ্ববাসীকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় জারিত করবে। বিশেষ করে চীন ও আমেরিকার ক্ষমতার দাপট ও বাণিজ্যচিন্তাই হয়ে দাঁড়াবে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক মেরুকরণের অন্যতম নিয়ামক। যদিও চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনো আসেনি। জাতিসংঘও মিয়ানমারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। বলাবাহুল্য, জাতিসংঘ তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মিয়ানমারের মতো আর কোনো রাষ্ট্রকেই নানা বিষয়ে এত অধিক নিন্দা জানায়নি। জাতিসংঘ নিন্দাপ্রাপ্তির কোনো তালিকা প্রকাশ করলে কোনো রাষ্ট্রই মিয়ানমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে না! ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা পরিষদের সভা করেছে। চীনের ভেটো প্রদানের জন্য সে সভায় মিয়ানমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। অতীতেও নানা প্রসঙ্গে মিয়ানমারের প্রতি চীনের সখ্য আমরা দেখেছি। এবারো যে এমনটিই হবে তা আগে থেকেই অনেকে ভেবে রেখেছিলেন। মিয়ানমার চীনের পরীক্ষিত মিত্র। পাশাপাশি দীর্ঘ সেনাশাসনের কারণে বিশ্ববাসী এ কথাও নিশ্চিয়ই উপলব্ধি করেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপের যে কোনো সিদ্ধান্তই নিক না কেন তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। ‘একঘরে’ জীবনযাপনেই মিয়ানমার যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে! পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বদলে চীন ও থাইল্যান্ডসহ পূর্ব-এশিয়ার গুটিকতক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে মিয়ানমারের টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে- হচ্ছেও। সুতরাং নতুন কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে বলে আমাদের মনে হয় না। বিগত সময়ে দীর্ঘ ৪৯ বছর স্বৈরশাসনের অধীনে থেকে, নিষেধাজ্ঞার আবর্তে থেকে মিয়ানমার ‘একলা চলা’তেই অনেকটা অভ্যস্ততা অর্জন করে ফেলেছে। তারপরও সাম্প্রতিককালের সেনাঅভ্যুত্থান কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটোর জন্য মিয়ানমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ জাতিসংঘ গণতন্ত্রের পক্ষে এখন বৈশ্বিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্বসহ দেখছে। তাই মিয়ানমারের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহŸান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমারের এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যথেষ্ট পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এবং এই চাপ সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব পক্ষকে সক্রিয় করতে জাতিসংঘ সব কিছু করবে।’ গুতেরেস আরো উল্লেখ করেছেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল এবং জনগণের প্রত্যাশা বদলে ফেলা চরম অগ্রহণযোগ্য। আশা করি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বোঝানো সম্ভব হবে যে, এটা দেশ শাসনের পদ্ধতি নয়, আর এভাবে সামনে এগোনো যায় না।’ মিয়ানমার প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কতটা সামনে এগোতে চায় সেটাও বোধ করি চীন ও তার অন্যান্য মিত্র ছাড়া কেউ জানে না- এমনকি আন্দাজও করতে পারে না! তবে সাম্প্রতিক বিশ্বে গণতন্ত্রের বিপরীতে একক সামরিক স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠাও কম চ্যালেঞ্জ নয়। ২০১৫ সালের পর মিয়ানমারে যে সীমিত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছিল তাও খুব স্বাধীনচেতা ছিল না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই তথ্য সরবরাহে কঠোর নীতি অবলম্বনের জন্য বাকি বিশ্ব ভেতরকার কোনো খবর টেরই পেত না! বাংলাদেশের বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতির আলোকে মিয়ানমারের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আচরণের প্রকাশই করেছে। ইতোমধ্যে ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে একাধিক মন্ত্রী প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিবর্তিত পটভূমিতেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সেনাশাসকদের সঙ্গেও ‘আলোচনা’র পথ প্রশস্ত থাকবে। রাষ্ট্রীয় কোনো শুভ উদ্যোগের পরও পরিবর্তিত অবস্থায় যেখানে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হয় সেখানে বিশ্বব্যাপী তুমুল সমালোচনার মধ্যে পড়ে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করায় মনোযোগ না দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো একটি দীর্ঘকালীন সংকট সমাধানে সেনশাসকরা মনোযোগী হবেন বলে মনে হয় না। তাই আমাদের প্রত্যাশা-পূরণেও যে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হবে সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। বরং এই সম্ভাব্য বাস্তবতা মেনে নিলে প্রত্যাশা পূরণের বিলম্ব তেমন কষ্টদায়ক হবে না। তবে এ কথাও ঠিক যে, আশাবাদী থাকাই মানবিক কল্যাণের জন্য ইতিবাচক। আমাদের আশাবাদী হওয়ার পেছনে একটি শক্তি আছে, যুক্তিও আছে। তা হলো বিগত কয়েক বছরে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি শক্ত একটি ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিচিত্র বিষয়ে ক‚টনৈতিক দক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আমাদের একটি বড় অর্জন। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী না হয়ে আশাবাদী হওয়া যেতেই পারে। মিয়ানমার সংকট নিয়ে ইতোমধ্যেই চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনার টেবিলে বসেছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগটি অভিনব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কৌশলী ক‚টনীতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমাদের আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের দ্রুত অবসান ঘটুক।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App