×

মুক্তচিন্তা

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ফেরানোর মোক্ষম সুযোগ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৩ পিএম

মিয়ানমারের ক্ষমতায় সু কি না সেনাবাহিনী? তা দেখার চেয়ে আমাদের জরুরি সেনা-সু কি মিলে বাংলাদেশের ওপর চাপানো রোহিঙ্গা বোঝা সরানো। সেই লক্ষ্যে চাপ কেবল অব্যাহত নয়, আরো জোরালো করা। মিয়ানমারে সেনা ক্যু, সেনাশাসন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে-ভাগেযোগে ক্ষমতা ভোগ নতুন নয়। এটি তাদের বৈশিষ্ট্যের মতো। দেশটিতে এবারের সেনা অভ্যুত্থানও একদম আকস্মিক বা আচমকা ছিল না। ভাবনমুনায় স্পষ্ট, আরো কেউ কেউ তা জানত। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু কিও টের পাননি বলে ভাবা যায় না। সু কির হিতাকাক্সক্ষীরাও জানতেন। নইলে জাতিসংঘ ছাড়াও আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরো এক ডজন দেশ কেন ঘটনার অন্তত তিন দিন আগে বিবৃতি দিয়ে ক্ষমতা দখল না করতে আহ্বান জানিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে? সু কির দীর্ঘদিনের মিত্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ওই আহ্বানকে পাত্তাই দেয়নি। এটাই দেশটির সেনাবাহিনীর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-ধর্ম। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ কোনো শক্তি বা আন্তর্জাতিক মহলকে কেয়ার করার অভ্যাস নেই তাদের। তারা এসব ভাবে না। বিশ্বসম্প্রদায় এমন বহু ধমকই দিয়েছে মিয়ানমারকে। আবার তাদের কেউ কেউ সমর্থনও দিয়েছে। মিয়ানমারের এ ঘটনা নিয়ে উপমহাদেশে নতুন কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দেবে কিনা- সেটাও অপেক্ষার বিষয়। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক সময়ের শান্তিদেবী সু কি ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের একটি মওকা যে পেয়েছেন, তা বুঝতে তুখোর ক‚টনীতিক হওয়া লাগে না। সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহতা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু কির ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেগেছে সেটা মোচনের এজেন্ডা নিয়ে কেউ এগুলে এগুক। সেই বাস্তবতা দৃষ্টে পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশকে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল এজেন্ডা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চেষ্টার ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটা ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি হয়, যার শর্ত অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়, কারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। মিয়ানমারে ফেলে আসা বসতভিটা ফেরত দেয়া হবে কিনা, নইলে কোথায় রাখা হবে, নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হবে কিনা, জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে কিনা, মানবিক মর্যাদা দেয়া হবে কিনা- এমন কিছু প্রশ্নের ফয়সালাও দিচ্ছিল না দেশটি। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ ছিল, কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখ চীনের দূতিয়ালিতে আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর মাঝেই মিয়ানমারে আবার সামরিক অভ্যুত্থান। অং সান সু কিসহ তার নেতাদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল, তার দল ন্যাশনাল লিগ ফল ডেমোক্রেসি-এনএলডির ওপর সেনাবাহিনীর গত ক’দিনের নিপীড়ন অনেকটা নিজস্বতায় ভরা। ভাগযোগের গরমিল। এতদিন সোহাগ করেছে, এখন শাসন করছে। গেল নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ জয় পেলেও জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করে। এ নিয়ে মিয়ানমারের বেসামরিক এনএলডি সরকার ও প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর মধ্যে কয়েকদিন ধরে মনোমালিন্য চলেছে। এর জেরেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল। অভ্যুত্থানের পর দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করা সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইং তো বলেই দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ ‘অনিবার্য হয়ে উঠেছিল’। মোটকথা সেনাবাহিনী সেখানে যা করে অভ্যস্ত ঠিক তা-ই করেছে। আবার সু কিসহ মিলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যা করার তা থেকে একটুও সরেনি মিয়ানমারের সাবেক-বর্তমান কোনো সরকারই। রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত-আইসিজেতে চলমান মামলার বিরুদ্ধে পাল্টা আপত্তি দিয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতেই এই আপত্তি মিয়ানমারের। অর্থাৎ ক্ষমতার ভাগযোগে ভেজাল হলেও রোহিঙ্গা নিয়ে হিসাবে কোনো হেরফের নেই। গত মাসে মিয়ানমার আপত্তিটি দাখিল করলেও সেটি সামনে আসতে দেরি হয়েছে। তথ্য-সাবুদে দেখা যায় তারা আপত্তিটি জানিয়েছে ২০ জানুয়ারি। ৮ দিন পর ২৮ জানুয়ারি আইসিজে প্রেসিডেন্ট আবদুলকায়ি আহমেদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক নথিতে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার তাদের আপত্তির কথা আদালতকে জানিয়েছে। তবে ঠিক কোন কোন বিষয়ে আপত্তি তুলেছে তা এখনো স্পষ্ট করেনি। তবে মতলব স্পষ্ট। তা বুঝতে সমস্যার কিছু নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্ব করাই মূল উদ্দেশ্য। এই আপত্তির মধ্য দিয়ে তারা অন্তত আগামী ২০ মে পর্যন্ত গড়িমসির সময় পেয়ে গেছে। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর পেছনে যাবতীয় আয়োজন ও সমর্থন জোগায় শান্তিতে নোবেলজয়ী সু কির সরকার। হত্যাকাণ্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস-আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ওই মামলায় আদালতে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির সাবেক বেসামরিক নেত্রী অং সান সু কি। ১৯৬২ সাল থেকে ৪৯ বছরের একটানা সেনাশাসনে পিষ্ট মিয়ানমার ২০১১ সালে এসে সাময়িক দম ফেলার সুযোগ পেলেও ঠিক ১০ বছর পর আবারো সেই গণতন্ত্র পুনরায় সেনাশাসনের বাক্সবন্দি। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭২ বছরে মিয়ানমারে বেসামরিক লোকজন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন মাত্র ১৫ বছর। এর মধ্যে বিগত ১০ বছর মিয়ানমার শাসিত হয়েছে বেসামরিক শাসকের আদলে। তবে শাসন করেছে সামরিক শাসক। ফলে মিয়ানমার আসলে ১৯৬২ সালের পর থেকেই সামরিক শাসনের আওতায় পরিচালিত হয়েছে। তা ছাড়া ২০০৮ সালে সংবিধানে সংস্কার এনে সেনাশাসনকে তাজা ও সাংবিধানিক করা হয়েছে। পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন, তিনটা মন্ত্রণালয় এবং মিয়ানমারের কমান্ডার-ইন-চিফ হবেন সেনাপ্রধান- এ ধরনের বিধান রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর অবস্থানকে সাংবিধানিক কাঠামোতে বৈধতা দিয়েছে। মিয়ানমারে নতুন করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নড়েচড়ে বসার সুযোগ নিতেই হবে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ অং সান সু কির মুক্তি ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার চাপ দিয়েছে। আর জাতিসংঘের চাপের দ্বিতীয় অংশে রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। দ্বিতীয় অংশটি বাংলাদেশের জন্য কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, মোক্ষমও। কোনোভাবেই যেন ঝুলে না যায় রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়টি। ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নিষ্ঠুর নির্যাতন, নির্বিচার ধর্ষণ এবং পাইকারি অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে ‘জানটা’ হাতে নিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। নতুন-পুরনো মিলে বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস। মিয়ানমারের সব রাজনৈতিক ইস্যুই এখন বাংলাদেশের জন্য ভাবনার বিষয় হলেও প্রায়োরিটিতে রোহিঙ্গাই থাকা উচিত সবার ওপরে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইস্যুগুলো এ সমস্যা সমাধানে কাজে দিতেও পারে। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ চেষ্টার কমতি করছে না। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হচ্ছে- সব চেষ্টাই মার খেয়ে চলছে মিয়ানমারের গোঁয়ার্তুমির কাছে। এর মাঝেই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু কির ক্ষমতাচ্যুতি এবং আবার বন্দিদশা। এ পরিস্থিতির মাঝে সুযোগ খুঁজতে হবে বাংলাদেশকে। নিতে হবে ক‚টনৈতিক কৌশল। সামরিক সরকার শাসনে থাকা বা না থাকাকে রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে মেলালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। বরং না মেলালে সুফলের সম্ভাবনা দেখা দিতেও পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় আলোচনার গতি বাড়ানোর কৌশল নিতে হবে। দেশটির অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অপেক্ষার সৌজন্য বাড়তি বিপদ ডেকে আনতে পারে। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App