×

মুক্তচিন্তা

ভাষার মর্যাদা আজো সুরক্ষিত হয়নি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৭ পিএম

পৃথিবীতে কেবল একটি মাত্র দেশ আছে, যে দেশটি কিনা তার সন্তানদের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে, যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পথ ত্বরান্বিত করেছে; সে দেশটিই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। অথচ ভাষা সংগ্রামের ৬৯তম বছরে এসেও আমরা কি পেরেছি ভাষাশহীদদের সঠিক মর্যাদা দিতে? সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার এই কয়জন ভাষাশহীদের নাম আমাদের ঠোঁটের ডগায় থাকলেও মূলত ভাষাশহীদ কতজন, তা আজো স্পষ্ট করা হয়নি। যার জন্য আগামী প্রজন্ম এভাবেই মাতৃভাষা ও ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার স্থায়ী রূপ দিতে না পারলে শুধু যে ভাষাশহীদদের অমর্যাদা করা হবে তাই নয়, প্রশ্নবিদ্ধ হবে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা। বর্তমানে ভাষার অপব্যবহারে সবচেয়ে বেশি যে দিকটি ফুটে উঠছে তা হলো ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আধিপত্য। ইংরেজি শিক্ষা বা বিদেশি শিক্ষার স্থান যেখানে বাংলা ভাষার পরে রাখার কথা, সেখানে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশের অনেক উচ্চ শিক্ষিত বাংলা শব্দের সঠিক উচ্চারণটা পর্যন্ত করতে পারেন না। সমাজের উঁচু শ্রেণির অধিকাংশ মানুষই আজ ইংরেজিমুখী। শুধু তাই নয়, ইংরেজিমুখী এই মনোভাব আজ উঁচু থেকে নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের ইংলিশ মাধ্যম, আরবি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবাধে বিদেশি ভাষার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, যেখানে উপেক্ষা করা হচ্ছে মাতৃভাষা বাংলাকে। ফলে দেশি শিক্ষার বিপরীতে ছাত্রছাত্রীরা শিখছে বিদেশি শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

আজকাল পথ-ঘাট, দোকান-পাট, ব্যানার-ফেস্টুন, সাইনবোর্ড ইত্যাদিতে অবাধে ইংরেজির বিচরণ দেখা যায়। যেটুকু আবার বাংলাকে উপস্থাপন করা হয় তাও বিকৃত রূপে। রেডিও স্টেশনগুলোতে ভাষার চলিত রূপ বিকৃত করে ব্যবহার করা হচ্ছে। অধিকাংশ অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে ‘হেল্লো লিসেনারস’ এবং শেষটা হচ্ছে ‘গুডবাই, বাববাই’ ইত্যাদি বাক্য দিয়ে। টিভি নাটক-সিরিয়াল এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন ভাষাদূষণ ও ভাষার অপব্যবহারের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সমানতালে। যেমন কেউ বলছে, ‘হোয়াটসঅ্যাপ ব্রু, ডে বাই ডে কেমন সি্লম হয়ে যাচ্ছো। রিডিং বেশি হচ্ছে নাক?’ এগুলো হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিত্য ব্যবহৃত কথামালা। এমনিভাবেই অনেকে বাংলাতে কথা বলার সময় অযোগ্য ও অনুচিত উপসর্গ-অনুসর্গ ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে তো ভাষাদূষণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ফেসবুক। বাংলা-ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু ভাষাগুলোকে একত্রে মিশ্রিত করে এমনভাবে জগাখিচুরি করা হচ্ছে যে তাকে আর বাংলা ভাষা বলা যায় না। বরং বাংলার অপভ্রংশই বলা চলে। এভাবে আমরা বাংলা ভাষাকে একদিকে যেমন বিকৃত করছি ঠিক সঙ্গে সঙ্গে ভাষাশহীদদেরও অমর্যাদা ও অসম্মান করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। মাতৃভাষার দিক থেকে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান পেলেও জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষার ষষ্ঠ স্থানেও জায়গা করে নিতে পারেনি এই ভাষা। আমরা যদি জাতিগতভাবে দেশের সর্বস্তরের বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় বাংলা ভাষার অধিভুক্তি নিয়ে আমাদের দাবি হবে যথেষ্ট অযৌক্তিক। ধারণা করা হয়, বর্তমানে যেভাবে ভাষার অপব্যবহার ও দূষণ হচ্ছে তাতে ২১০০ সালের মধ্যেই বাংলা ভাষা একটি পরাশ্রয়ী ভাষায় রূপ নেবে।

ভাষার এই অস্তিত্ব সংকট, অপব্যবহার ও ভাষার দূষণ থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে চাইলে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা ভাষাকে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবং বাংলা একাডেমিকে ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে হবে যেন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভাষার অপব্যবহার ও অস্বচ্ছ ব্যবহার না হয়। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অচিরেই বাংলা ভাষা আনয়ন করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষা চালু ও উচ্চশিক্ষা বাংলায় প্রদান করতে হবে। দোকান-পাটের নাম, ব্যানার-ফেস্টুন-সাইনবোর্ড, পোস্টার-লিফলেট ইত্যাদিতে ইংরেজি ভাষা ও বিদেশি ভাষা দূরীকরণে ‘শুদ্ধ ভাষা আন্দোলন’ জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি একযোগে দেশের উচ্চ থেকে নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে ‘সঠিক মাতৃভাষা শিক্ষা’র শপথ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই না বাংলা ভাষার মান সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভাষাশহীদদের মর্যাদার যথাযথ সংরক্ষণ হবে।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App